কবি–চূড়ান্ত এক মানবিক সাধুসন্ত বিদগ্ধজন। দরবেশের মতো যার নির্নিমেষ দৃষ্টিভঙ্গি। যার দেখার ইচ্ছা এবং সংবেদী অনুভব আছে। সবার অলক্ষ্যে নিজের ভেতর ভিন্ন একটি জগৎ তৈরির ক্ষমতা আছে যার। আবার তিনি সেই কবি যিনি জগতের সমস্ত প্রকার নশ্বরতার বিপক্ষে সটান দাঁড়াতে পারেন। পাহাড়ের খুব উঁচুতে উঠে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণায় যার শরীর বিন্দুবৎ কাঁপে না অথচ পরিপার্শ্ব সমাজ কেঁপে ওঠে।
প্রচলিত যে জীবনব্যবস্থা তার বিপক্ষে সাহস করে বুকের বারুদঘর পুড়িয়ে ক’জনইবা দাঁড়াতে পারেন একমাত্র প্রকৃত কবি ছাড়া! কবিতা অনুভূতির তীক্ষ্ম সংশ্লেষ এবং সংবেদনশীলতার সর্বোচ্চ রঙ। সে কারণে কবিতা প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অথচ সাধারণ মানুষের মতো কবিও সেই সাধারণ সমাজে বসবাস করেন। কিন্তু সমাজের প্রচলিত অনুশাসন তাকে বশ করতে পারে না। সমাজ–রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে থেকেও কবি আলাদা হয়ে ওঠেন স্বভাব চরিত্রে। কবি সর্বদা বোঝা না বোঝার দোলাচালে সাধারণের চোখে থাকেন অধরা। স্পর্শহীন বিগলিত ভাবাবেগ এবং চূড়ান্ত দহন তাকে অন্য দশজন থেকে ক্রমশঃ পৃথক করে তোলে। কবি ধারণ করেন ভিন্ন জীবন প্রবাহ। সৃষ্টির উন্মাদনায় নিজেকে লীন করে দিতে পারেন। প্রচলিত মুদ্রিত ভাষ্য থেকে কবির অনুভূতি রচিত হতে থাকে ভিন্ন ব্যঞ্জনায়। এই অনুভূতির নাভিকূপ সমাজের বীজচারা। পর্যায়ক্রমে সমাজ থেকে উপাদান সংগ্রহ করে নতুন এক অনুষঙ্গের জন্ম দেয়া কবির কাজ। মানুষের মনোজগৎ খুবই জটিল। এই দুর্বোধ্য জটিল গ্রন্থি উন্মোচন করে কবি মোক্ষলাভ করেন। অসম্ভব দুর্মদ প্রাণশক্তি নিয়ে উজ্জীবিত করেন যাবতীয় মানবানুভূতি এবং ভাষার রঙ– যে ভাষার ভেতরে কবির বাস সে ভাষার অনুবাদে কবি ছড়িয়ে পড়েন এক বিশ্ব থেকে অন্য মানববিশ্বে, মহাবিশ্বে। কবি ধ্বনিত করেন সময় সমাজ রাষ্ট্র এবং অন্তঃস্থলে বেড়ে ওঠা স্রোতের দহন, যা তার নিজের। এই উদ্যাপন সমাজ তথা জনগোষ্ঠীর আশা–আকাঙ্ক্ষার চরিত্রায়ন। স্বপ্নের নৈনিতাল একটি বিন্দুতে এসে সিন্ধু হয়ে ঢেউ ওঠা কবির কাজের মহার্ঘ্য অংশ। কবি সবুজ ও নীল রঙের সাঁতারু স্রোতের বিপক্ষে। শব্দের সম্রাট কবি প্রাত্যহিক মানবিক দর্শনের ভেতরে আগাতে চান। কবিতা অনেকটা এভাবে সুন্দর সুস্নাত রবির শুভেচ্ছাদূত। এবং আচ্ছন্ন হতে থাকে ব্যকুল উচ্ছ্বাসে। কোথা থেকে ঝড় উঠে সব তছনছ করে দেওয়া, কোথা সে বিকলাঙ্গ শান্তি, কবি তা খোঁজেন কেন! ঔপনিবেশিক সময়ে কবি ও কবিতা ছিল পাশ্চাত্য শাসিত সমাজের উতুঙ্গ উল্লম্ফনের চিত্ররূপ। সংস্কৃতি চর্চার নামে এক ধরনের অধীনস্থ শব্দের আর্টিলারি রেজিমেন্টেড ছিল মন ও মননে। এ–ই খোলসের ভেতর কবিতার প্রাণ হাঁসফাঁস করলেও সংস্কৃতির অনুগত দৃষ্টিভঙ্গি বহু দশক ধরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেয়নি। কবিতার ওয়েলকিনে সর্বোচ্চ চক্কর দিয়েছে পাশ্চাত্য ভাবানুষঙ্গ। কেন তার এতো গরজ ; এই জিজ্ঞাসা ও প্রশ্নাকুল অধিবিদ্যা থেকে মূলত কবিতার জন্ম বলে, মানছি। অথচ তার সব অনুষঙ্গ সমাজ ও প্রকৃতির মধ্যেই প্রতিদিন আবর্তিত। অর্থাৎ একথা অনস্বীকার্য আমাদের কবিতা আগাগোড়া ইউরোপ শাসিত এক অভিজ্ঞান। সেখানে আয়ুস্মান হওয়া বিভিন্ন আর্ট ও শিল্পভিত্তিক আন্দোলনের ঘাতপ্রতিঘাত আমাদের মনোজগতে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে দীর্ঘদিন। উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে বাস করেও স্বকীয় অনুভব সম্পাদনে ছিলাম আমরা দুর্বল। উত্তর ঔপনিবেশিক মানস প্রবণতা আমাদের প্রবলতর জাতিগত সংস্কৃতির অনুষঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারেনি। আমরা ওরিয়েন্টাল হয়েও ছিলাম ইউরোপীয় ভাবানুগ্রহে আদারস্। ইউরোপীয় সাহিত্যের আভিজাত্য আমাদের তাদের বিবেচনায় অন্যান্য বা আদারস্ করে রেখেছে। ঘোষিত এই উচ্ছিষ্টতা আর কিছুই নয়, ঔপনিবেশিক হেজিমনি। উপনিবেশিকতার লালনে আমাদের সহজিয়া ৮ নাদীভর্তি মানুষ লোকজ সংস্কৃতি ইতিহাস এবং আমাদের নিজস্ব যে চারণভূমি তা উপেক্ষিত হয়েছে।
কবিতা ইউরোপীয় ঘাটে তরী ভিড়িয়ে জটিল সম্পাদ্যে অনুবর্তীত হয়েছে। আমাদের সবকিছু থাকা সত্ত্বেও আমরা হাস্যসুখে দাস্যসুখ মেনে নিয়েছি। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। প্রদাহ নিয়ে কবিতার সোরাইয়াসিস ফাঙ্গাস এখান থেকেই শুরু। কাঠিন্য নিয়ে একটি জাতির চরিত্র বোঝা যায় না। প্রতিনিয়ত সংগ্রামমুখর একটা জাতির পিঠের ওপর আরোপিত শ্বাস শবানুগমনের মতো। শব্দের লাশ নিয়ে আমরা দৌড়াচ্ছি প্রতিদিন। অথচ কবরের মাটি নেই। কিংবা আমাদের মাটি সেসব লাশের জন্য অধিকার ছাড়ছে না।
আমরা আধুনিকতার দীক্ষা নিয়েছি হুবুহু পশ্চিমাদের ডায়াসে। একটি মনোকলোনি তৈরি করে আমাদের মধ্যে মূল্যবোধহীনতার চর্চা এসেছে। এটি পশ্চিমাদের খুশি করার উপলক্ষ মাত্র। ফলে, অর্থনৈতিক সামাজিক এবং রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের মতো সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বও মেনে নিতে হয়েছে।
আশি–র কবিতার একাংশ যে দেশজ অনুভব্য প্রণোদনায় সামনের দিকে এগিয়েছিল তারই অনুসরণীয় লক্ষ্য যোগ্যতায় প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের কবিতা প্রলম্বিত হয়েছে ভিন্ন বাতাবরণে। যে শৃঙ্খলা ও যুক্তিবোধ তৈরি হয়েছে মাটি ও মানুষের আশাভরীতে, তাতে দেখতে পেয়েছি গ্রাম, মাঠের কৃষক, ধানিজমি, ইতিহাস ঐতিহ্য লোকজ বিশ্বাস।
কবিতা হয়েছে সুবোধ্য সরল ভাষা দাবানোর মিলনকুঞ্জ। বিষয়ে এসেছে খুব কাছে থেকে দেখা অনুষঙ্গের সৃষ্ট চারুতা। এটিকে কাব্য নিরীক্ষাও বলা চলে। শুধু কবিতার উপরিতল এবং প্রতিটি লাইনে শুধুই ম্যাজিক নয়। অন্তর্গত কাব্য স্বভাবে এসেছে বিবিধ মিথ কথন, রূপকের আড়ালে তৈরি হয়েছে গভীর জীবনবোধ। বিষয় বৈচিত্র্যে জীবনের পাঠ হয়েছে প্রভূত পরিমাণে ;
১) মানুষ যাবে মানুষ থেকে দূরে/এটাই তবে নিয়ম বলে মানি! /মেরুন রঙে বিষাদ লেগে আছে/আদরগুলো নিয়ত আসমানি/…আমার খাতা গোধূম–ধোঁয়া রোদে/ আঁকড়ে ধরে ঝরা পাতার শিরা/পেতেছি কান নিজ প্রাণে নিজে/তুলসীবনে বেজেছে মন্দিরা!
(বিচূর্ণতার গান, রিমঝিম আহমেদ)
২) গৌরি ভিজে যাচ্ছে/ ভিজে যাচ্ছে চোখের পাতা/ চোখ, অজাতশ্মশ্রু মুখের বাহাস/ ভিজে যাচ্ছে ছাতিমের গন্ধ/ প্রতিটা সবুজ দরজার সামনে/ পড়ে থাকছে/ ছাতিমের/ অন্ধ/গন্ধ
(বৃষ্টির ঘ্রাণ, শাফিনূর শাফিন )
৩) শরীর মূলত এক মাংসের বন/কাছে বসে যতবার দূরে সরে যাও/ অন্ধ চোখেরা জানে/তুমি ঠিক ততোখানি তোমার শরীর/যতখানি আমাতে মেলাও
(মাংসের বন,সালেহীন শিপ্রা )
৪) আমি একটা ফুল ফোটাব বলে বহুদিন/ অপেক্ষায় আছি, যার পরাগরেণু /গণকবরের মতো ধূসর/ যার পুংকেশর জগৎ জ্যোতির /বিচ্ছিন্ন মাথার মতো ঊর্ধ্বমুখী/
(যুদ্ধের ফুল,আহমেদ মুনির)
৫) সরে আসি দিগভ্রান্ত জানালায়/আমরা পরস্পর জানালা খুলি/ উষ্ণ হতে হতে নিবিড় করি দুরত্ব /দেখি, ছবি দাগি চাঁদের সাথে/ পালিয়ে যাচ্ছে নগ্ন সুন্দর রাত।/এগ্রামে মানুষের পাশে মানুষই দাঁড়ায়/এগ্রামে মানুষের লাশ মানুষই পাড়ায়।/ঈশ্বর নেই বলে, এই গ্রামে আমরাই ঈশ্বর।।
(আমরাই ঈশ্বর, রুবেল সরকার)
৬) এখন আমি রঙের কাছে, চিত্রের খাটে শুই /জয়নুলের ওই কাকে ঢুকে প্রাচীন বাঘকে ছুঁই।/ যখন তুমি জায়গা দাওনি দোষ দিয়েছি তোমার/ এখন আমি দোষ দেব কার–ভাবছি অন্ধ হোমার।
(অন্ধ হোমার,সবুজ তাপস )
৭) যেখানেই থাকো তুমি যে দৃশ্যে/একটাই প্রেম,অজস্র চেহারা/ডুবে যাচ্ছি জেনেও বলি/চলো একপাতে ভাত খাই শেষবেলা ;/উপড়ে যাবে জেনেও লাগাই/
নতুন একটা চারা/পৃথিবী ধ্বংসের মুখে,/ চোখ রয়েছে তোমার চোখে/
(শেষবেলা,আসমা বীথি)
৮) ছিল কি বর্বর হত্যা মানবিক সিলেবাস?/ গাজার শরীর পুড়ছে আবার নাটকীয় রক্তপাতে।/ধিক!ওই পৈশাচিকযজ্ঞে/ ধিক! ওই বুদ্ধিহীন আশরাফুল মাকলুকাতে!
(পৈশাচিক রক্তপাত, অনুপম চৌধুরী)
৯) একটুখানি পরশ দিয়ে অনেকখানি দূর/ বনের ভেতর দুলছে পাতা, ক্লান্ত যেন ফুল /হলো মনে শীতের হাওয়ায় নামছ তুমি খুব/ ঊর্ধ্বগামী বাজারদামে বিষণ্ন দুকূল।/ তোমার কথা নতুন করে যাচ্ছে না আর বলা/চারিদিকে ঘনিয়ে ডাকে বিষাদ হরবোলা/কপাল ভাঁজে টনটনিয়ে বাড়ছে জীবন ভার/তুমি যেন এই বাজারের মুদ্রাস্ফীতির হার।
(নাভিশ্বাস,অনুভব আহমেদ)
১০) তোমাদের অবিরাম দৃশ্য হতে সরে যাই/অঙ্গার মমতা থেকে জীবনের মায়া নিয়ে/ সন্তানের ঘুমন্ত মুখের কাছে বসে থাকি/মুগ্ধতার মাত্রা দারুণ আলাদা লাগে।
…/জগতের প্রাণী মরণ জাগিয়ে তোলে/সেই থেকে মানুষেরা পিতার প্রতিমা হয়।
(পিতার প্রতিমা, শেখর দেব)
১১) একদিন পৃথিবী বলে, পড়শী চাঁদ/ দিওনা তোমার ঝাপসা জোছনা জ্যোতি/
বর্তমান উজ্জ্বল আমি তোমার ফাঁদ/শেষ হলো তোমার পূর্ণিমা দাও যতি।/
(পৃথিবী বলে,আজিজ কজল)
১২) তারুণ্যের তাপে তপ্ত এক ইকারুস/ বারণ মানেনি আজ। মোমের নির্মিত/ ডানা ধীরেধীরে মেলে জীবাণু আকাশে/ অতঃপর ক্ষীপ্রতায় আপন স্বভাবে/ সীমানা পেরিয়ে যায় দুর্বার চৈতন্যে/নামেনা প্রদীপ্ত যুবা। ডাকে ডেডেলাস/ মাঠ থেকে অনিবার, শোনে নাকো আর।
(জনশূন্য ছায়াতল, শাহিদ হাসান)
১৩) বাঁশির সুরভি পেয়ে সেদিন আমিই তাহলে/ পায়ের মুদ্রায় সাজিয়েছি নট ও অজস্র নাচশালা।/পায়ে এখনো অবলুপ্ত একখানা নাচের ঘুঙুর।/ছিল ধুলোর নূপুর।/ ছিলাম বিদ্যার কুসুম।
এখন ঘন ভুল।/ পোড়াদহ থেকে /পার্বতীপুর।/শতমাইল পাখিপথ পার হয়ে এসেছি।/পেছনে রসের কারবালা।
(সরস্বতী, নুসরাত নুসিন)