কবি আলাওলের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহ্যের স্মারকচিহ্ন ‘আলাওল দিঘি’

জি.এম.জহির উদ্দীন | রবিবার , ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলা অদূরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায়ের প্রবেশদ্বার ২ নং গেজেট এর সামান্য দক্ষিণে আলাওল দিঘির অবস্থান। ঐতিহাসিকদের মতে ১৫ শতাব্দীর গৌড়ের সুলতান রোকন উদ্দিন বারবক শাহ (১৪৭৩১৪৭৪) খ্রিষ্টাব্দে এই দিঘি খনন করেন। যার হিজরী সন ৮৭৮ হিজরী। এ ঐতিহাসিক দিঘিটি হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। বর্তমান চট্টগ্রাম হাটহাজারী মহাসড়ক সংলগ্ন পূর্বপার্শ্বে এ দিঘির অবস্থান। ইতিহাসের বর্ণনা মতে দিঘিটি গৌড়ের সুলতান রোকন উদ্দিন বারবক শাহ কর্তৃক খনন করা হয়েছে এ তথ্যটি পাওয়া গেলেও বর্তমানে এটি আলাওল দিঘি হিসাবে পরিচিত। চট্টগ্রামের লোকমুখে ‘আলওরডি’ নামে প্রচলিত রয়েছে। তবে ইতিহাসবিদরা এ দিঘি খননের সময় কোনও নামকরণ করা হয়েছিল কিনা এ ব্যাপারে নীরব। এ দিঘি খননের সন পাওয়া যায় (১৪৭৩১৪৭৪) খ্রিষ্টাব্দ। তা থেকে হিসাব করলে মহাকবি আলাওয়ের জন্মের প্রায় ১৫০ বৎসর পূর্বে এ দিঘি খনন করা হয়। তারপর কখন কীভাবে আলাওল দিঘি নামকরণ করা হলো এ ধরনের কোনও তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আপাতত মহাকবি আলওল এর স্মরণে এবং তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ দিঘির নামকরণ করা হয়েছে ‘আলওল দিঘি’ এ ধারনাতেই অগ্রসর হবো।

এই আলাওল দিঘির ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। একদিকে প্রাচীন নির্দশন সমূহের একটি হিসাবে এ দিঘির গুরুত্ত্ব যেমন সর্বজনীন তেমনিমধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি, মহাকবি আলাওল এর নামে নামকরণ ও তার স্মৃতিবিজড়িত নির্দশন সমূহ আমাদের চেতনার উৎস। এ দিঘি মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ মুসলিম কবি আলাওলের স্মৃতি রক্ষার্থে নামকরণ করা হয়েছে এ ধারণার স্বপক্ষে বেশ কয়েকটি উপকরণ পাওয়া যায়। তার মধ্যে দিঘির চার পাশে রয়েছে পুরনো কবরস্থান, রয়েছে ঐতিহাসিক আলাওল স্মৃতি পাঠাগার, রয়েছে ঐতিহাসিক আলওয়াল মসজিদ যা নির্মিত হয় ৮৭৮ হিজরীতে (১৪৭৩১৪৭৪) খ্রিষ্টাব্দে। মসজিদের বর্তমান নাম মহাকবি আলাওল জামে মসজিদ সংক্ষেপে আলাওল জামে মসজিদ। মসজিদটি ভেঙে স্থানীয়রা ১৯৯৮ সালে পূনঃনির্মাণ করেন। কিন্তু মসজিদের দেয়ালের শিলালিপিতে অংকিত রয়েছে ৮৭৮ হিজারী তথা ১৪৭৩ খ্রিষ্টাব্দ। দুই লাইনে উৎকীর্ণ শিলালিপিটি বর্তমান নতুন করে নির্মিত মসজিদের মিহরাবের উপরে স্থাপন করা রয়েছে। এই শিলালিপির নাম ‘ফতেহপুর শিলালিপি’ হিসাবে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভূক্ত করে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার অন্তর্ভূক্ত করা হয়। বর্তমানে এটি চট্টগ্রাম জেলার একটি পূরাকীর্তি হিসাবে স্বীকৃত।

এই ঐতিহাসিক দিঘি নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে একটি মিথ প্রচলিত আছে। একসময় এ দিঘিতে নাকি বিয়ে কিংবা মেজবানীর যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে একটি নৌকাসহ ভেসে উঠত। যাদের বিয়ে বা মেজবান হতো তারা তাদের অনুষ্ঠান শেষে করে এগুলো আবার দিঘীর মধ্যে রেখে আসতো। একদিন কোন এক পারিবারিক অনুষ্ঠান থেকে একটি ভাটি হারিয়ে যায় বা কেউ চুরি করে ফেলে এরপর থেকে আর বিয়ের/ মেজবানের সরঞ্জাম দিঘি থেকে উঠে আসে না। আমি এ মিথ এর ব্যাপারে অনুসন্ধান করে স্বচক্ষে দেখেছে এমন কাউকে পাইনি। তবে শুনেছে এমন প্রবীণ লোক এখনো ফতেপুর অঞ্চলে আছে।

কে জানে এ মিথ এর সত্যতা বা যথার্থতা কতটুকু। কিন্তু মানুষের বিশ্বাসের কাছে এ দিঘি পবিত্র ও শুদ্ধতার প্রতীক। এ দিঘি প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক একথা এক বাক্যে স্বীকার করতে কারো আপত্তি নেই। আর যাই হোক এ আলাওল দিঘি ৬০০ বছরের পুরানো ইতিহাসের ধারক।

এবার আমরা মহাকবি আলাওল এর সাথে এ দিঘির নামকরণে কতটুকু সম্পৃক্ততা আছে তা জানবার চেষ্টা করবো। আমরা জানি কবি সৈয়দ আলাওলের জন্ম ১৬০৭ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু ১৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে। মহাকবি আলাওলের জন্মস্থান নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিখ্যাত পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কবি আলাওলের জন্ম ফরিদপুরের ফতেহাবাদ পরগনায়। অধিকাংশ ইতিহাস গবেষক এ মত গ্রহণ করেছেন। আবার স্বনামধন্য আরেক পণ্ডিত ড. এনামুল হকের মতে করি আলাওল ১৬০৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে কবির জন্ম ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে এবং মৃত্যু বৃদ্ধবয়সে ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। তিনি মাদারীপুর জেলার ফতেয়াবাদের জালালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিশ এ কতুবের আমত্য ছিলেন। আলাওল ও তার পিতা জলপথে চট্টগ্রামে যাওয়ার সময় আলওলের পিতা জলদস্যুদের হাতে নিহত হন। অতঃপর আলাওল জলদস্যুদের হাতে ধরা পড়ে এবং ক্রীতদাশ হিসাবে তাকে আরকানে নেয়া হয়। পরে তিনি রাজ ‘সাদ উমাদার’ এর অশ্বারোহী সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তার কাব্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া গেলে তিনি হয়ে যান আরাকান রাজসভায় সভাকবি। তার কাব্য চর্চার উৎসাহদাতা ছিলেন আরাকান রাজার প্রধান কর্মচারী মাগন ঠাকুর। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্রবিদ্যা ও যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। সর্বোপরি জ্ঞান আহরণের মধ্য দিয়ে মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।

অন্যদিকে ‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে ড. মুহাম্মদ এনামূল হক ও আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বিস্তারিত পর্যবেক্ষণধর্মী আলোকপাত করেছেন। তারা নির্দ্বিধায় আলাওলকে চট্টগ্রামের বাসিন্দা হিসাবে বলেছেন। তাদের যুক্তি হলো যেহেতু আলাওলের রচিত সকল কাব্যের পাণ্ডুলিপি চট্টগ্রামেই পাওয়া যায়, এবং আলাওলের নামে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে একটি দিঘি আছে, সেই দিঘি ও দিঘির পাড়ে অবস্থিত মসজিদ আলাওল জামে মসজিদ হিসাবে নামাঙ্কিত আছে এবং দিঘির পাশে চারকানি জায়গায় কবির ব্যবহৃত ভিটা ও পাকা কবর আছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে এবং এখানে শাহ ও সৈয়দ পদবীধারী কয়েকটি পরিবার আলাওলের বংশধর বলে দাবী করে সেহেতু তার জন্মস্থান চট্টগ্রাম হওয়াই সমীচীন। কবি আলাওল তার এক কাব্যে উল্লেখ্য করেন যে তিনি কাদেরিয়া তরিকার খলিফা ছিলেন এ উক্তিতেও তার পৈতৃক বসতভিটা চট্টগ্রামে ছিল এটা মেনে নেয়া যায়। তবে খুব সম্ভব তার পিতা ফরিদপুরের মজলিশ কতুবের আর্মাত্য ছিলেন সেই সুবাদে তিনি ও তার পিতা কিছু সময় ফরিদপুর থাকতে পারেন। এমনকি তার জন্ম ও ফরিদপুর হতে পারে।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, . মুহাম্মদ শহীদুল্লাহও বলেছেন যে, তিনি ও তার পিতা চট্টগ্রাম আসার পথে জলদস্যু কর্তৃক ধৃত হয় এবং তার পিতাকে জলদস্যু কর্তৃক হত্যা করা হয়। তবে কেন চট্টগ্রাম আসছিলেন তার কোন ব্যাখ্যা তার বিবরণীতে নেই। এখানে উল্লেখ্য যে, কবির পিতা তার কর্মস্থল ফরিদপুর থেকে নিজ বাসস্থান চট্টগ্রামে আসার সময় পথিমধ্যে জলদস্যুরা তার পিতাকে হত্যা পারে। হয়তোবা বয়সের স্বল্পতা হেতু বালক আলাওলকে হত্যা না করে জলদস্যুরা আরকান রাজ সভায় কৃতদাস হিসাবে বিক্রি করেছেন। পরবর্তীতে তার প্রজ্ঞা ও কাব্য প্রতিভারগুণে তিনি আরকান রাজ সভার সভাকবি হন। হতে পারে পরিণত বয়সে এসে তিনি আলাওল দিঘির সংলগ্ন পৈত্রিক বসত বাড়ি উদ্ধার করেন। অতঃপর তিনি সেখানে বসবাস করেও থাকতে পারেন। উক্ত দিঘি তার জন্মের পূর্বে গৌড়ের শাসক সুলতান রোকন উদ্দিন বরাবক শাহ খনন করলেও তার কবি খ্যাতির কারণে কালক্রমে উক্ত দিঘির নাম আলওল দিঘি নামকরণ হয়েছে ধরে নেয়া যায়।

অন্যদিকে ফরিদপুর তার জন্মস্থান হলেও ওখানে তার বসতভিটা বা স্মৃতি সম্বলিত কোন ঐতিহাসিক স্থাপনা থাকা একান্ত আবশ্যক। আমার জানামতে ফরিদপুরে কবি আলাওলের কোন স্মৃতিচিহ্ন নেই বললে মিথ্যা বলা হবে না। এ দৃষ্টিকোন থেকেও আলাওলের জন্মস্থান চট্টগ্রাম তা আমাদের আবারও স্মারণ করিয়ে দেয়।

তারপরও আলওলের জন্মস্থান নিয়ে মতানৈক্য থেকেই যায়। তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ পদ্মাবতী কাব্যের একজায়গায় লিখেছেন– ‘মুল্লুক ফতেহাবাদ গৌড়েতে পরধান, তথায় জালালপুর অতি পূন্যস্থান’। এখান থেকে আমাদের আবারও তার জন্মস্থানের বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তবে চট্টগ্রাম জেলায়ও ফতেহাবাদ এলাকা রয়েছে, তাছাড়া আলওল দিঘির সংলগ্ন একটি গ্রামের নাম ফতেহপুর। হতে পারে এ অঞ্চল একসময় ফতেহাবাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে কবি তার জন্মস্থান হিসাবে কাব্যে ফতেয়াবাদ উল্লেখ করেছেন। অথবা তার পৈত্রিক বসতবাড়ি চট্টগ্রাম হলেও তার পিতার চাকরিস্থল ফরিদপুরের ফতেহাবাদ এর জালালপুর এ কবির জন্ম হওয়াতে ঐ স্থান উল্লেখ করেছেন। কবি আলাওলের জন্ম ফরিদপুর হতেই পারে কিন্তু চট্টগ্রামের আধি বাসিন্দাদের অর্ন্তভূক্ত তা ধরে নেয়া যায়। অনুরূপ ভাবে হাটহাজারীর স্থায়ী বাসিন্দা আলাওল গৌড়ের ফরিদপুরের ফতেহাবাদ এলাকায় জন্মগ্রহণ করতেই পারেন। উল্লেখ্য চট্টগ্রামের আলোচিত এ অঞ্চল বিভিন্ন সময় গৌড়ের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। ফলে হাটহাজারীর আলাওল গৌড়বাসীও হতে পারেন। মতানৈক্য থাকা স্বত্ত্বেও এতসব তথ্য উপাত্তের উপর ভিত্তি করে একথা বলাই যায় যে, চট্টগ্রামের হাটহাজারীস্থ ‘আলাওল দিঘি’ মহাকবি আলাওল এর নাম অনুসারেই হয়েছিল। তারই স্মৃতি বিজড়িত পূন্যস্থান আলাওল দিঘি ও আলাওল জামে মসজিদ।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের বিলুপ্ত ও বিলীনপ্রায় জলাশয়: এক দশকে ধ্বংসের চিত্র ও বিশ্লেষণ
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে স্বামীকে হত্যার পর স্ত্রীকে ধর্ষণ, ঘাতক আটক