শেষ পর্ব
এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ‘লিরিক’এর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পুরস্কৃত হওয়ার পর এই আড্ডার তরুণেরা উদ্দীপ্ত হয়েছিলেন সন্দেহ নেই। এর কিছুদিন পর এই আড্ডার বেশ ক’জন তরুণের সঙ্গে (সম্ভবত ১৯৯২ সাল) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর আধুনিক কবিতা আন্দোলনের প্রচারকদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। শুরুর দিকে ‘গাঙ্গেয়পত্র’ সম্পাদক অঞ্জন সেন, ‘অমৃতলোক’ সম্পাদক সমীরণ মজুমদার এবং আরও পরে তপোধীর ভট্টাচার্য, সমীরণ মজুমদার, সন্দীপন দাশগুপ্ত, রণবীর পুরকায়স্থ প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্রে তাঁদের মত ও চিন্তার প্রভাবে সবুজ আড্ডার তরুণেরা উত্তর আধুনিক ‘তত্ত্ব’ নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে এজাজ ইউসুফী ও জিল্লুর রহমান প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে এ বিষয়ে জোরালো বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯৯৫ সালে ‘লিরিক’এর উত্তর আধুনিক কবিতা সংখ্যা সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামতও তখন গড়ে উঠেছিল। শুরুর দিকে একসঙ্গে থাকলেও হাফিজ রশিদ খান পরে এই ‘উত্তর আধুনিকতা’র পথ ও মত থেকে সরে এসেছিলেন। এখনও উত্তর আধুনিকতার তত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি, তবে শুরুর দিকের সেই উত্তেজনা আর নেই। ‘সবুজ হোটেলে’র আড্ডা কিন্তু এখনো চলমান, পুরনো ‘মালি’রা কদাচিৎ আসেন বটে, ‘সাতটি পেয়ালা আজও খালি নেই।’
‘স্পার্ক জেনারেশনে’র উত্তেজনা তখন মিইয়ে পড়েছে, ‘সাধু মিষ্টান্ন ভান্ডারে’র প্রায়ান্ধকার, অপরিচ্ছন্ন ঘুপচি ঘরে আর আড্ডাটা ঠিক জমছে না। কারণ, যে বেকার ছন্নছাড়ার দল কাপের পর কাপ চা খেয়ে বিড়ি ফুঁকে ধোঁয়ার মতো উড়িয়ে দিচ্ছিল জীবন, তাঁদের অনেকেই থিতু হয়েছেন, কমবেশি আয়-উপার্জনও শুরু করেছেন। ঠিক এ-সময় শহরের কেন্দ্রস্থল নিউমার্কেট এলাকায় গড়ে উঠেছে ‘চিমবুক’ নামে ঝাঁ চকচকে একটি রেস্তোরাঁ। এই রেস্তোরাঁর অন্দরসজ্জা ও আসবাব যেমন ছিল সুদৃশ্য, তেমনি রাস্তার দিকে ছিল চমৎকার একটি ঝুলবারান্দা। সেই ঝুলবারান্দায় শুরু হলো নবোদ্যমে আড্ডা। আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন কবি শিশির দত্ত। এ ছাড়া কবি স্বপন দত্ত, কমল সেনগুপ্ত, আবসার হাবীব, আহমেদ নেওয়াজ, শহিদুল ইসলাম, মুনির হেলাল, খালিদ আহসান, আসাদ মান্নান প্রমুখ প্রথম দিকে এই আড্ডাকে সরগরম করে রাখলেও পরের দিকে ‘বোস ব্রাদার্সে’র আড্ডারুরাও এখানে ভিড় জমাতে থাকেন। এই সময়ে শিশির দত্তের সম্পাদনায় অত্যন্ত সুদশ্য পত্রিকা ‘সম্পাদক’ প্রকাশিত হয়। ‘সম্পাদক প্রকাশনী’ নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ে ওঠে তখন । এর আগে চট্টগ্রামের ‘বইঘর’ প্রকাশনী সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছিল রুচি ও মননশীল বই প্রকাশের জন্য। সে-অর্থে সম্পাদক প্রকাশনীর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ভিত্তি ছিল না, কিন্তু এই প্রকাশনী থেকে ‘স্বনির্বাচিত’ নামে দেশবরেণ্য কবিদের একটি কবিতার সংকলন এবং নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, আবুল মোমেন ও স্বপন দত্তের পৃথক চারটি কাব্য সংকলন প্রকাশিত হলে এসব গ্রন্থের গুণমানের জন্য দেশব্যাপী প্রশংসিত হয়। এছাড়া এ-সময় ‘সম্পাদক’, ‘গোপন গোলাপ’, ‘চোখ’ প্রভৃতি পত্র-পত্রিকার মুদ্রণ সৌকর্যের কারণে চট্টগ্রামের প্রকাশনা নিয়ে সারা দেশের সাহিত্যমোদীর মনে আগ্রহ ও কৌতূহল সৃষ্টি হয়। এ সময়ে খালিদ আহসান সম্পাদিত ও অলঙ্কৃত ‘চোখ’ পত্রিকাটি মুক্তধারা ও জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পুরস্কার লাভ করে। এ যেন অনেকটা শিশুসাহিত্যিক এখলাসউদ্দিন আহমদের তত্ত্ববধানে বইঘর থেকে প্রকাশিত বইগুলোর গুণমানেরই ধারাবাহিকতা। ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকা প্রকাশের মতো উচ্চাকাঙ্ক্ষী উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল তখন। কিছুদিন প্রকাশের পর এর অনিবার্য মৃত্যুও ঘটেছিল।
যাই হোক, আড্ডা প্রসঙ্গে ফিরে যাই। চিমবুক রেস্তোরাঁতে তখন কবি লেখক-সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়মিত আড্ডার সুখ্যাতি এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা থেকে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের যে কেউ এলে একবার এই আড্ডায় ঢুঁ মেরে যেতেন। নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, হাবীবুল্লাহ সিরাজীরা তো আসতেনই, তখন তারকাখ্যাতিতে দীপ্যমান অভিনয়শিল্পী আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরিদী বা পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়রাও আড্ডা দিতে আসতেন। আড্ডা থামেনি, কিন্তু তার আগে থেমে গিয়েছিল ‘চিমবুক’। এ নিয়েও বেশ মজার একটি রসিকতা বা রসিকতার আড়ালে নির্মম সত্য গল্প চালু আছে। ‘চিমবুক রেস্তোরাঁ’র টার্গেট গ্রাহক ছিলেন উচ্চবিত্তরা। কিন্তু কবি-লেখকদের আড্ডার ধরন আর চায়ের মধ্যে পরোটা ডুবিয়ে খাওয়ার ‘প্রাকৃত জনোচিত’ আচরণের কারণে নাকি ধীরে ধীরে আসল গ্রাহকেরা বিদায় নিয়েছিলেন। তাতে ব্যবসা লাটে উঠল চিমবুকের। মালিক পক্ষের বড় ক্ষতি হয়ে গেল নিঃসন্দেহে, কিন্তু চট্টগ্রামে সাহিত্য-আড্ডার ইতিহাসে ‘চিমবুক’ নামটা অক্ষয় হয়ে রইল তা-ই বা কম কী!
আন্দরকিল্লার মোড়ে ‘চৌরঙ্গী’ রেস্তোরাঁয়ও উজির-নাজিরের মৃত্যুসংখ্যা নেহাৎ কম নয়! এখানে আড্ডা জমিয়েছিলেন শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, মৃদুল গুহ, সাথী দাশ, অভীক ওসমান, কালাম চৌধুরী, রবীন ঘোষ, আশীষ সেন, অমিত চৌধুরী ও শিবপ্রসাদ প্রমুখ কবি ও লেখকেরা। ধারণা করি, এই আড্ডায় সাহিত্যের পাশাপাশি সমাজ-রাজনীতির চর্চাও চলত সমানতালে। প্রয়াত শওকত হাফিজ খান রুশ্নি ও সাথী দাশ ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। মৃদুল গুহ বা অভীক ওসমান প্রমুখ বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বলেই রাজনীতি এ-আড্ডার অনিবার্য প্রসঙ্গ। কক্সবাজারবাসী অমিত চৌধুরী মাঝে মাঝে আড্ডায় হাজিরা দিতেন। দীর্ঘদিন ধরে ‘মূল্যায়ন’ নামের একটি ছোটকাগজ প্রকাশ করেছেন তিনি। অনিয়মিত ছোটকাগজ ‘মনন’ বের করতেন শিবপ্রসাদ।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দক্ষিণ নালাপাড়ায় সাগরবাবুর দোকানে কবি ময়ুখ চৌধুরীকে ঘিরে এবং জুবিলি রোডের ‘সাবিত্রী পাইচ হোটেলে’ কবি সুনীল নাথকে ঘিরে দুটি প্রাণবন্ত আড্ডা চালু ছিল দীর্ঘদিন। ময়ুখ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘অসভ্য শব্দ’ নামের একটি কবিতা সংকলন নানা কারণে তখন বহুল আলোচিত হয়েছিল; আর সুনীল নাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘মফস্বল’ নামের ছোট কাগজটিতে লেখার মানের দিকে নজর দেওয়া হলেও মুদ্রণ পরিপাট্যকে অবহেলা করা হতো সচেতনভাবেই, যাতে মফস্বলের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন থাকে।
রেয়াজুদ্দিন বাজার এলাকার ‘জলযোগ’ রেস্তোরাঁর কিছুদিন আড্ডা চলেছে ধুন্দুমার। বাঁধাধরা কোনো সময় নেই, যে যার মতো যখন পারছেন এসে হাজির, কেউ না কেউ তো আছেনই অপেক্ষায়, সুতরং জমজমাট প্রসঙ্গে ঢুকে পড়তে সময় লাগছে না। অনেকটা রিলে রেসের মতো এই আড্ডায় কেউ শেষ করে উঠে পড়ছেন তো অন্যজন এসে সেই শূন্যস্থান পূরণ করছেন সকাল থেকে রাত!
দামপাড়ায় শিল্পকলা একাডেমির সামনে আঙিনায় গোল করে সারিবদ্ধ চেয়ারে বসে নাট্যকার-নির্দেশক রবিউল আলম, নাট্য ও সাংস্কৃতিককর্মী জাহাঙ্গীর কবির, গোলাম মর্তুজা রাজ্জাক, সরোয়ারুল আলম খসরু, জহির উদ্দিন আহমদ, কবি ফাউজুল কবির, এজাজ ইউসুফী প্রমুখ এই কিছুদিন আগেও (কোভিডের পূর্বে) আড্ডা চালিয়ে যেতেন।
সন্ধ্যায় শিল্পকলায় আলোকিত মঞ্চে যখন নানা নাট্যমুহূর্ত তৈরি হচ্ছে, উচ্চকিত সংলাপে নাটকীয়তা, তখন মিলনায়তনের অদূরে আলো-আঁধারির মধ্যে আড্ডারুরাও কিন্তু নিজেদের মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতিবিষয়ক আড্ডায় কম নাটকীয়তা তৈরি করেননি। অনেক তর্ক-বিতর্ক মনোমালিন্য পর্যন্তও গড়িয়েছে, কিন্তু পরদিন বা তারও পরের দিন ঠিকই এসে আবার মিলিত হয়েছেন সকলে।
এরকম আরও কত আড্ডা চলছে শহরের নানা প্রান্তে, সব খোঁজখবর কি আর আমরা জানি? ‘শৈলী প্রকাশন’ ও ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’ নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে ঘিরে সরব আছেন এক ঝাঁক তরুণ লেখকলেখিকা।
কবি ও শিশু সাহিত্যিক রাশেদ রউফ নবীনপ্রবীণ অনেক কবি-ছড়াকার লেখককে একত্র করেছেন এখানে। গল্পে-আড্ডায়-অনুষ্ঠানে প্রাণবন্ত এ-দুটি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে আড্ডারই সমপ্রসারণ বলা চলে। আরেকটি আড্ডা এখনও সচল কবি মনিরুল মনিরের প্রকাশনা সংস্থা ‘খড়িমাটি’ কার্যালয়ে। বইবিপণি ‘বাতিঘর’ বা সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র ‘বিস্তার’, ‘গুটেনবার্গ’ বা ‘যমুনা প্রিন্টার্সে’ আলাপ-ঝালা-বিস্তার চলেছে আড্ডার। কত বিষয়, মত ও অমত নিয়ে আড্ডা প্রাণবন্ত। গল্পগুজব, পরনিন্দা-পরচর্চা, রাজা-উজির মারা সবই তো হয়, আবার এই আড্ডাগুলো থেকেই নানা বিষয়ে জানাশোনা হয়। নতুন বই, নতুন সিনেমা, নতুন গান, রাজনীতির নানা বাঁক কত বিষয়ে সমৃদ্ধ হয়েছেন আড্ডারুরা! সেই অর্থে যুগপৎ অর্থে শিক্ষা ও বিনোদনের এক একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই আড্ডাগুলো। সৈয়দ মুজতবা আলী যেমন বলেছিলেন, ‘আমি ভালোবাসি হেদো, হাতিবাগান, শ্যামবাজার। ওসব জায়গায় তাজমহল নেই, পিরামিড নেই। তাতে আমার বিন্দুমাত্র খেদও নেই। আমি ভালোবাসি আমার চায়ের দোকানটি। সেখানে সকাল-সন্ধ্যা হাজিরা দিই, পাড়ার পটলা, হাবুল আসে, সবাই মিলে বিড়ি ফুঁকে গুষ্ঠীসুখ অনুভব করি আর উজির-নাজির মরি। আমার যত জ্ঞান-গম্মি তা ঐ আড্ডারই ঝড়তি-পড়তি মাল কুড়িয়ে নিয়ে।’ (পঞ্চতন্ত্র পঞ্চম খণ্ড রচনাবলী, প্রথম খন্ড)। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতো পণ্ডিত ব্যক্তিই যদি কবুল করেন যে, আড্ডার ‘মাল’ কুড়িয়ে তিনি জ্ঞান লাভ করেছেন, তাহলে আপনি-আমি কোন ছাড়? তাই আড্ডা চলছে, আড্ডা চলবে।