হজ ও ওমরাহ উভয়টিই আল্লাহর বিশেষ ইবাদত। কিন্তু ইসলামি শরিয়তে এ দুটির মর্যাদা ও বিধান এক নয়। হজ হচ্ছে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি আর ওমরাহ একটি মুস্তাহাব (অত্যন্ত প্রশংসনীয়) ইবাদত। প্রশ্ন হলো যদি কারো ওপর হজ ফরজ হয় অথচ তিনি আগে ওমরাহ করতে যান তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে তার অবস্থান কী। কুরআনের আলোকে হজ ও ওমরাহ নিঃসন্দেহে এক বরকতময় ইবাদত। কিন্তু এটি ফরজ হজের বিকল্প নয়। যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে তার প্রথম কর্তব্য হলো হজ আদায় করা। তারপর সুযোগ থাকলে ওমরাহ করা।
‘হজ’ অর্থ কোনো মহৎ কাজের ইচ্ছা করা। হজের নিয়তসহ ইহরাম ধারণ করে নির্দিষ্ট দিনে আরাফার ময়দানে অবস্থান করা ও কাবা শরিফ তাওয়াফ করাকে হজ বলে। ‘ওমরাহ’ অর্থ পরিদর্শন করা। ওমরাহর নিয়তে ইহরাম ধারণ করে তাওয়াফ ও সায়ি করে মাথা কামিয়ে ইহরামমুক্ত হওয়াকে ওমরাহ বলে। আল্লাহতাআলা বলেছেন নিশ্চয়ই প্রথম ঘর যা মানুষের কল্যাণের জন্য স্থাপন করা হয়েছে তা মক্কায়। এটি বরকতময় ও বিশ্ববাসীর জন্য হিদায়াত। তাতে রয়েছে স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ আছে মাকামে ইব্রাহিম। আর যে এতে প্রবেশ করবে সে নিরাপদ হয়ে যাবে। আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ওই ঘরের হজ করা তার জন্য অবশ্যকর্তব্য (ফরজ)। আর যারা কুফরি করে তারা জেনে রাখুক আল্লাহ নিশ্চয়ই সৃষ্টিকুল থেকে অমুখাপেক্ষী। (সুরা–৩ আলেু ইমরান : আয়াত : ৯৬–৯৭)। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ (সা.)বলেছেন ইসলামের স্তম্ভ পাঁচটি ১. এ সাক্ষ্য প্রদান করা যে আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোনো উপাস্য নেই এবং নিশ্চয়ই মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর রাসুল, ২. সালাত কায়েম করা, ৩. জাকাত প্রদান করা, ৪. হজ সম্পাদন করা ও ৫. রমজানের সিয়াম পালন করা।
জীবনে অন্তত একবার হজ করা প্রত্যেক মুসলিম নর–নারীর ওপর ফরজ যদি তাঁর হজ সম্পাদনের সামর্থ্য থাকে। হজের মৌসুমে যাতায়াতের খরচ সফরের সময়ে নিজের ও পরিবারের স্বাভাবিক ভরণপোষণের ব্যবস্থা ও শারীরিকভাবে হজের আমলসমূহ আদায়ের সক্ষমতা থাকলে হজের সামর্থ্য প্রমাণিত হয় এবং তখন হজ ফরজ হয়ে যায়। হজের সামর্থ্য থাকলে বা হজ ফরজ হলে কালবিলম্ব না করে দ্রুত হজ সম্পাদন করা উচিত। হজ সম্পাদনের সময় হলো ৮ থেকে ১৩ জিলহজ পর্র্যন্ত। এ সময়ে মক্কা মোকাররমায় মিনা, আরাফাহ, মুজদালিফা ও জামারাতে হজের ফরজ, ওয়াজিব ও সুন্নতসমূহ পালন করতে হয়। হজের মৌসুম হলো ১ শাওয়াল থেকে ১৩ জিলহজ পর্যন্ত। হজের ইহরামের সময় হলো ১ শাওয়াল থেকে ৯ জিলহজ পর্র্যন্ত। এর আগে বা পরে হজের ইহরামের নিয়ত করা যায় না। সামর্থ্য থাকলে বারবার হজ করা যায়। একবার ফরজ হজ আদায় করার পর সুযোগ থাকলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর হজ করা উত্তম। কোনো ব্যক্তির ওপর হজ একবার ফরজ হলে তিনি যদি তা পালন না করেন পরবর্তী সময়ে সামর্থ্য হারালেও সেই ফরজ তাঁর ওপর থেকে উঠবে না। তাই যাঁদের সামর্থ্য রয়েছে তাঁদের উচিত যত দু্রত সম্ভব ফরজ হজ আদায় করা। যদি কেউ হজ ফরজ হওয়ার পর শারীরিকভাবে সক্ষমতা হারান তবে অবশ্যই তাঁর পক্ষ থেকে অন্য কাউকে দিয়ে বদলি হজ করানো ফরজ হয়ে যাবে। আত্মীয়–অনাত্মীয় যে কারও মাধ্যমে বদলি হজ করানো যেতে পারে। তবে শর্ত হলো তাঁর ওপর হজ ফরজ না হতে হবে অথবা তিনি আগে নিজের হজ সম্পন্ন করেছেন। বদলি হজ করার জন্য আগে হজ পালন করা আবশ্যক নয়। হজের ব্যয়ের অর্থ অন্য কেউ প্রদান করলেও হজ আদায় হয়ে যাবে।
ওমরাহর সময় : পবিত্র মক্কায় গিয়ে ওমরাহ পালন করা বিশ্বের লাখ লাখ মুসলিমের সারা জীবনের লালিত স্বপ্ন। অর্থনৈতিক সামর্থ্য আছে এমন মুসলিমরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এ ইবাদত করে থাকেন। বছরের যে কোনো সময় উমরাহ করা যেতে পারে। তবে রমজান মাসে এ আমলের গুরুত্বই আলাদা। রমাদান ছাড়াও আবহাওয়া বিবেচনায় ওমরা পালনের জন্য বছরে আরও কিছু সুবিধাজনক সময় আছে। ওমরাহ পালনের অসংখ্য ফজিলতের কথা হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। নবীজি (সা.)ইরশাদ করেন এক ওমরাহর পর আরেক ওমরাহ উভয়টির মধ্যবর্তী সময়ের গুনাহের কাফফারা। আর জান্নাতই মাবরুর হজের একমাত্র প্রতিদান। ওমরাহ একটি ইবাদত। তাই অন্যান্য ইবাদতের মতো এটিও ইখলাস ও নবীজি (সা.)এর অনুসরণ ছাড়া আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। ওমরা হতে ইখলাসের মর্ম হলো শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও পরকালীন সাফল্যের উদ্দেশে ওমরাহ সম্পাদন করা কোনো ধরনের পার্থিব উদ্দেশ্য এখানে গ্রহণযোগ্য নয় বিশেষ করে প্রচারপ্রিয়তা ইবাদতের সওয়াব নষ্ট করে দেয়। আর নবীজি (সা.)এর অনুসরণের মর্ম হলো তিনি যেভাবে ওমরাহ পালন করেছেন সাহাবিদের শিখিয়েছেন এবং সম্মতি দিয়েছেন সেভাবেই তা পালন করা।
হজ তো বছরে শুধু একবারই আদায় করা সম্ভব। কেননা শরীয়তে হজের জন্য সুনির্দিষ্ট তারিখ রয়েছে। কিন্তু ওমরাহ সারা বছরের যে কোন সময় যতবার ইচ্ছা আদায় করা যায়। তাতে অধিক সময়ের প্রয়োজন হয় না বিধায় অনেকে একই দিনে একাধিকবার ওমরাহ করে নেয়। তবে জিলহজের ৯, ১০, ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ এই পাঁচ দিন ওমরাহ করা মাকরূহ। কারণ এ দিনগুলো হজের জন্য নির্ধারিত। সামর্থ্য বা সুযোগ থাকলে জীবনে অন্তত একবার ওমরাহ পালন করা সুন্নত। ওমরাহ পালনে হজের মূল স্থান আরাফাহ, মুজদালিফা, মিনা ও জামারাতে যেতে হয় না। ফরজ হজ পালন করার আগে বা পরে ওমরাহ করতে কোনো বাধা নেই। রাসুলুল্লাহ (সা.)বিভিন্ন সময়ে ওমরাহ করেছেন। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রমজান মাসে ওমরাহ করলে তা নবীজি (সা.)এর সঙ্গে হজ করার সমান সওয়াবের অধিকারী করে। ওমরাহ করলে হজের ফরজ আদায় হয়ে যায় না।
হজ ফরজ হলে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। ওমরাহ কখনোই ফরজ হজের বিকল্প নয়। ওমরাহ করার পর যদি কারও ওপর হজ ফরজ না হয় তবে তাঁর জন্য হজ পালন বাধ্যতামূলক নয়। ওমরাহ পালন করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত আমল। এটি পুরুষ ও মহিলা সবার জন্য প্রযোজ্য। ওমরাহ করলে হজ ফরজ হয়ে যায় এরূপ কোনো বিধান নেই। এ ছাড়া হজের মাস শাওয়াল ও জিলকদে ওমরাহ করা যায়। জিলহজ মাসের প্রথম আট দিনও ওমরাহ করা যায়। অনেকে হজের মাসসমূহে ওমরাহ করাকে বিশেষ ফজিলতপূর্ণও বলেছেন। কারণ নবিজি (সা.)তার সবগুলো ওমরাহ হজের মাসসমূহেই আদায় করেছিলেন। হোদায়বিয়ার ওমরাহ নবিজি আদায় করেছিলেন জিলকদ মাসে। কাজা ওমরাহ আদায় করেছেন জিলকদ মাসে, জি‘রানার ওমরাহও আদায় করেছেন জিলকদ মাসে। আর বিদায় হজের সাথের ওমরাহও ছিল জিলকদ মাসে।
মনে রাখতে হবে : জীবন অস্থির, মৃত্যু অনিশ্চিত। আজ সামর্থ্য আছে কাল নাও থাকতে পারে। আজ স্বাস্থ্য ভালো কাল হয়তো হুইল চেয়ারেই বসে থাকতে হবে। তাই হজ ফরজ হলে দেরি নয় কিংবা এমনটিও বলা নয় যে ‘ইনশাআল্লাহ পরের বছর যাব’ কারণ এই দেরি বিপদ ডেকে আনতে পারে। আল্লাহ সকলকে কবুল করুক আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট









