কক্সবাজারে জনপ্রশাসন একডেমির ৭শ একর বনভূমির বন্দোবস্ত বাতিল

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | মঙ্গলবার , ১২ নভেম্বর, ২০২৪ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার শহরতলীর সমুদ্রতীরবর্তী হিমছড়ি পর্বতমালার শুকনাছড়ি পাহাড়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত ৭শ একর বনভূমির বন্দোবস্ত অবশেষে বাতিল করেছে সরকার। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব আমিনুর রহমান স্বাক্ষরিত গত ১০ নভেম্বর প্রেরিত পত্রের মাধ্যমে উল্লিখিত বিষয়ে যথাযথ কার্যক্রম গ্রহণপূর্বক ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানানো হয়েছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে বনভূমির এ বরাদ্দ বাতিল করা হয়।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমি অব পাবলিক এডমিনিস্ট্রেশন’ স্থাপনের জন্য প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা মূল্যের এই ভূমি মাত্র ১ লাখ টাকার প্রতীকি মূল্যে বরাদ্দ দেয় তৎকালীন সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বন্দোবস্তকৃত কক্সবাজার জেলার সদর উপজেলার ঝিলংজা মৌজার বিএস ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত বিএস ২৫০০১ নম্বর দাগের ‘পাহাড়’ শ্রেণির ৪০০ একর ও বিএস ২৫০১০ নম্বর দাগের ‘ছড়া’ শ্রেণির ৩০০ একর মোট ৭০০ একর জমি রক্ষিত বনের গেজেটভুক্ত হওয়ায় উক্ত বন্দোবস্ত বাতিল করা হয়েছে।

গত ২৯ আগস্ট এ বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা একটি আধাসরকারি পত্র প্রেরণ করেন। উপদেষ্টার পাঠানো আধা সরকারি পত্রে বলা হয়, বন্দোবস্তকৃত এলাকা ১৯৩৫ সাল থেকে বন আইন ১৯২৭এর ২৯ ধারার আওতায় রক্ষিত বন হিসেবে ঘোষিত। এই ২১৪৫.০২ একর ভূমির অংশে গর্জন, চাপালিশ, তেলসুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা এবং হাতি, বানরসহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় ২০১১১২ ও ২০১২১৩ সালে এই বনভূমিতে বনায়ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। রেকর্ডে ‘রক্ষিত বন’ উল্লেখ না থাকায় বন বিভাগ এ বিষয়ে মামলা করে। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আরেকটি প্রশিক্ষণ একাডেমি নির্মাণ করতে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ‘রক্ষিত বনভূমির’ প্রায় ৫ হাজার কোটি মূল্যের ৭শ একর ভূমি মাত্র ১ লাখ টাকার প্রতীকি মূল্যে বরাদ্দ দেয় তৎকালীন সরকার। কক্সবাজারটেকনাফ মেরিন ড্রাইভসংলগ্ন ঝিলংজা বনভূমির ওই এলাকা প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন। বন বিভাগ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির আপত্তি উপেক্ষা করে ভূমি মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ দেয়। বন বিভাগ এই জমি তাদের বলে দাবি করে আসছিল।

পাশাপাশি ভূমির বন্দোবস্ত বাতিল চেয়ে একটি রিট মামলাও হাইকোর্টে দায়ের করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগ এ বন্দোবস্তের বিষয়ে স্থগিতাদেশ প্রদান করেন যা আপীল বিভাগে বহাল রয়েছে। এছাড়া শুকনাছড়ি পাহাড়ে সিভিল সার্ভিস একাডেমি নির্মাণের বিরোধিতা করে শুরু করেই কক্সবাজারের পরিবেশবাদীরা আন্দোলন করে আসছিল।

১৯৩৫ সালে ব্রিটিশ সরকার একে রক্ষিত বন ঘোষণা করে। বন বিভাগ এত বছর ধরে এটি রক্ষণাবেক্ষণ করছে। বিপন্ন এশীয় বন্য হাতিসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণীর নিরাপদ বসতি এই বনভূমি। বন আইন অনুযায়ী, পাহাড় ও ছড়াসমৃদ্ধ এই বনভূমির ইজারা দেওয়া বা না দেওয়ার এখতিয়ার কেবল বন বিভাগের। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই জমি বরাদ্দ নিয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এ বনভূমিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করা নিষেধ। এ কারণে বন বিভাগ থেকে সেই সময় ‘এই ভূমি বন্দোবস্তযোগ্য নয়’ উল্লেখ করে বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দেওয়া হয়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দপত্রে দেশের অন্যতম জীববৈচিত্র্যসমৃদ্ধ বনভূমিকে অকৃষি খাসজমি হিসেবে দেখানো হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় বলেছে, বরাদ্দ দেওয়া জমির ৪০০ একর পাহাড় ও ৩০০ একর ছড়া বা ঝরণা। তারা জমির মূল্য ধরেছে ৪ হাজার ৮০৩ কোটি ৬৪ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা। কিন্তু একাডেমির জন্য প্রতীকী মূল্য ধরা হয়েছে মাত্র ১ লাখ টাকা। ভূমি মন্ত্রণালয় এলাকাটিকে অকৃষি খাসজমি দেখালে বন বিভাগ বন মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দিয়ে আপত্তি তোলে।

তারা জানায়, বন আইন অনুযায়ী ওই জমি বন বিভাগের আওতাধীন ‘রক্ষিত বনভূমি’ হিসেবে চিহ্নিত। ‘ওই জমি বন্দোবস্তযোগ্য নয়’ বলে একটি চিঠিও ভূমি রেকর্ড ও জরিপ অধিদপ্তরকে দেয় বন বিভাগ। ২০০১ সালে দেশের বনভূমির যে তালিকা করা হয়, তাতেও ঝিলংজা মৌজা বনভূমি হিসেবে আছে। সরকারের এই বিভাগ বিসিএস বন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত।

ওই সময় জানতে চাইলে প্রধান বন সংরক্ষক (তৎকালীন) আমীর হোসেন চৌধুরী মিডিয়াকে বলেন, ওই বনভূমির মালিক বন বিভাগ। কিন্তু ইজারার জন্য কেউ আমাদের চিঠি দেয়নি। ভূমি মন্ত্রণালয় যে বনভূমি ইজারা দিয়েছে, তাও আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে জানি না।

নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১৮ সালে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন বঙ্গবন্ধু একাডেমি অব পাবলিক অ্যাডমিনিস্টেশনের (বাপা) কার্যালয় নির্মাণের জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অনাপত্তিপত্র চায়। সংস্থাটি ওই বছরই ১৪টি শর্তে অনাপত্তিপত্র দেয়। পরিবেশ অধিদপ্তর মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এর মহাপরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলোর পরিচালকেরা প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য। কিন্তু বন বিভাগ ভূমি মন্ত্রণালয়কে লেখা তাদের চিঠিতে বলেছে, ১৯৯০ সালে জারি করা ভূমি মন্ত্রণালয়েরই একটি পরিপত্রে চট্টগ্রাম বিভাগের পাহাড় ও পাহাড়ের ঢাল বন্দোবস্তযোগ্য নয় এবং ওই জমি মূলত বন বিভাগ বনায়নের জন্য ব্যবহার করবে। বন আইন অনুযায়ী, এ ধরনের রক্ষিত বনে কোনো ধরনের স্থাপনা করা নিষিদ্ধ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাউজানে নিখোঁজ মাদরাসা শিক্ষকের লাশ মিলল খালে
পরবর্তী নিবন্ধতিন নেতার দলীয় পদ সাময়িক স্থগিত