২০২৪ সালের ১৬ জুলাই। সেদিন চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি ছিল বিকাল তিনটায়। কিন্তু সেখানে আগে থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেন। নিরূপায় হয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র–জনতা নগরের মুরাদপুরে অবস্থান করেন। কয়েক দফা ষোলশহর আসার চেষ্টা করলেও পারেনি। ছাত্রলীগের মিছিলও শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করে কয়েক দফা। এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে চলে সংঘর্ষ, মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ। মুরাদপুর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের রাজপথে সেদিন প্রথমবারের মতো আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর সরাসরি গুলিবর্ষণ করা হয়। প্রাণ হারান তিনজন– চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদল নেতা ওয়াসিম আকরাম, ওমর গণি এমইএস কলেজের শিবির কর্মী ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও ফার্নিচার দোকানকর্মী মো. ফারুক।
সেদিন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ওয়াসিম আকরাম গুলিবিদ্ধ হন সংঘর্ষের শুরুর দিকে। নিহতের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি সহযোদ্ধাদের উদ্দেশে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন– সবাই চলে আসুন ষোলশহর। পরে শহীদ হন ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও নিরীহ পথচারী দোকানকর্মী ফারুক।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সেদিন গুলি চালানো হয় অত্যন্ত কাছ থেকে। হামলার নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা নুরুল আজিম রনি ও আওয়ামী লীগ নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। তাদের সঙ্গে ছিলেন যুবলীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক গ্রুপ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চট্টগ্রামের তৎকালীন সমন্বয়ক মশিউর রহমান বলেন, আমরা শুরু থেকেই দুই ভাগে বিভক্ত ছিলাম। একাংশ মুরাদপুর মোড়ে, আরেকাংশ রেললাইনের দিকে। হামলার শুরুতে মুরাদপুরের অংশ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া করতে করতে বহদ্দারহাটের দুই ফ্লাইওভারের মাঝখানে অবস্থান নেই। আরেক অংশ রেললাইন থেকে এসে হামলা প্রতিহত করে, সেখানেই ফয়সাল আহমেদ শান্ত যুবলীগ ক্যাডারদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ফেডারেশনের সাবেক নেতা ও বর্তমানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রাম মহানগরের আহ্বায়ক আরিফ মঈনউদ্দিন জানান, দুপুর আড়াইটার দিকে আমরা মুরাদপুরে গিয়ে দেখি, ওয়াসিম ভাইয়ের নেতৃত্বে ছাত্ররা অবস্থান করছে। হঠাৎ তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে ছাত্রলীগ–যুবলীগ। গুলিবর্ষণে প্রথমেই ওয়াসিম ভাই শহীদ হন। তিনি বলেন, আশপাশের ভবন থেকেও গুলি ছোঁড়া হচ্ছিল। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে শুলকবহরের দিকে সরে যাই। পরে সংগঠিত হয়ে আবার মিছিল নিয়ে মুরাদপুরে ফিরে যাই। প্রতিরোধ গড়ে তুলি এবং ছাত্রজনতা মুরাদপুর মোড় পুনরুদ্ধার করে।
তিন শহীদ পরিবারে শোকের ছায়া : এই তিন শহীদের পরিবারে এখনো শোকের ছায়া। শহীদ ওয়াসিমের মা হারিয়েছেন শ্রবণশক্তি, বাবা শফি আলম সৌদি আরব থেকে ফিরে ছেলের জানাজা পড়তে পেরেছিলেন শুধু। তিনি বলেন, বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ– এটা যেন কেউ না দেখে। আমি শুধু চাই, আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার হোক।
শহীদ ওয়াসিমের স্মৃতিচারণ করে চবি ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ওয়াসিমের সঙ্গে আগে থেকেই আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ ছিল। তাকে হারানোর এই বেদনা আমাকে আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে। তবে ওয়াসিমের ত্যাগ–শ্রমেই আমরা আজ মুক্ত। এ জাতি চিরকাল ওয়াসিমদের স্মরণে রাখবে। সবার মুখে মুখে থাকবে ওয়াসিমের সেই সাহসী বার্তা ‘চলে আসুন ষোলশহর’।
আদরের ছেলেকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ শান্তর মা কোহিনূর বেগম। তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না যে, তার ছেলে আর নেই। সেদিনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কহিনুর বলেন, এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে বারবার আমাকে জেরা করে নানা কিছু জেনে নেন, কিন্তু কোনোভাবেই আমার ছেলের হদিস দেন না। একপর্যায়ে পুলিশ আমাকে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যায়। সেখানে বিভিন্ন কাগজে সই করতে বলে। তখনই বুঝতে পারি ময়নাতদন্তের জন্য অনুমতিপত্রে আমার সই নেওয়া হচ্ছে। বুকটা ভেঙে যায় আমার। জানতে পারি, আমার ছেলের পায়ে নয়, গুলি করা হয়েছে বুকে। এরপর আমি জ্ঞান হারাই। শান্তর ফেসবুক প্রোফাইলে লেখা ছিল ‘যে হৃদয় শাহাদাতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা লালন করে, সে হৃদয় কখনো হতাশ হয় না’– এটি এখন অনেকে ফেসবুকে শেয়ার করছেন।
তৃতীয় শহীদ ফারুক ছিলেন একজন দোকানকর্মী। আন্দোলনে জড়িত ছিলেন না। হামলার সময় কর্মস্থলে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন। তার স্ত্রী সীমা আক্তার বলেন, আমার স্বামী কোনো মিছিলে ছিল না। শুধু রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছিল। কেন তাকে মারা হল? আমি এর বিচার চাই।
পেকুয়া প্রতিনিধি জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিম আকরামের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। মৃত্যু দিবসে ওয়াসিমের স্মরণে করা হচ্ছে নানা আয়োজন। গতকাল বুধবার সকালে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন ও সিনিয়র সহসভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে ছাত্রদলের একটি প্রতিনিধি দল পেকুয়া মেহেরনামায় ওয়াসিমের কবর জিয়ারত করেন। এর আগে ওয়াসিমের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে ওয়াসিমের বাবা–মায়ের সাথে দেখা করেন তারা। এসময় পরিবারের খোঁজ খবর নেন।
কবর জিয়ারত শেষে নাছির উদ্দীন সাংবাদিকদের জানান, মৃত্যুবার্ষিকীতে ওয়াসিমকে যেভাবে স্মরণ করার কথা ছিল সেরকম কোনো আয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে চোখে পড়েনি, যা আমাদের হতাশ করেছে। আমরা মনে করি, বর্তমান সরকার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করছে ওয়াসিমকে। যার কারণে সবখানে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে শহীদ ওয়াসিম।
এদিকে ১৬ জুলাই শহীদ দিবস উদযাপন উপলক্ষে পেকুয়া উপজেলা প্রশাসনের আয়োজনে দোয়া মাহফিল, জুলাইয়ের গল্প বলা, গ্রাফিটি উন্মোচন ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বৃক্ষ রোপন ও শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন শহীদ ওয়াসিম আকরামের মা জোসনা বেগম ও বোন সাবরিনা ইয়াসমিন।
সকালে উপজেলা সম্মেলন কক্ষে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মঈনুল হোসেনের সভাপতিত্বে শহীদদের স্মরণ সভায় বক্তব্য রাখেন উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি নুর পেয়ারা বেগম, পেকুয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সিরাজুল মোস্তফা প্রমুখ।