জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদির জানাজায় অংশ নিয়েছেন লাখো মানুষ। তাদের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা, জুলাই যোদ্ধাসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। গতকাল শনিবার দুপুর আড়াইটায় জানাজা পড়ান ওসমান হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। জানাজা শেষে লাশবাহী গাড়ির সঙ্গে মিছিল করে জনতা রওনা হয় শাহবাগের দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধি প্রাঙ্গণে দাফন করা হয় জুলাই আন্দোলনের সৈনিক ওসমান হাদিকে। খবর বিডিনিউজ ও বাসসের।
জানাজার আগে ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন এবং হাদির জীবনী পড়ে শোনান। পরে হাদির পরিবারের পক্ষে ইনকিলাব মঞ্চের সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল জাবের বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, আমরা এখানে কি কান্নার জন্য এসেছি? আমরা এখানে কিসের জন্য এসেছি? আমার ভাইয়ের রক্তের বদলা নেওয়ার জন্য আজকে আমরা এই জানাজায় দাঁড়িয়েছি। এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও হাদির হত্যাকারী গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ওসমান হাদিকে ১৬৮ ঘণ্টা আগে গুলি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত খুনিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে? সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে? আমরা মনে করছি, খুনি একজন নয়, পুরো একটা খুনি চক্র কাজ করেছে। খুনি, খুনের পরিকল্পনাকারী, সহায়তাকারী, পুরো খুনি চক্রকে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
জাবের বলেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা (জাহাঙ্গীর আলম) ও সহকারী উপদেষ্টাকে (প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদাবঙ চৌধুরী) জনসম্মুখে এসে জানাতে হবে তারা কী পদক্ষেপ নিয়েছে। যদি না পারে, তাদের পদত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা ওসমান হাদির রক্তকে বৃথা যেতে দেব না। ওসমান হাদির রক্তের মাধ্যমে এ দেশে ইনসাফ কায়েম হবে।
তবে কোনো ধরনের সহিংসতার উসকানিতে সাড়া না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ইনকিলাব মঞ্চ থেকে সব ধরনের সিদ্ধান্ত জানানো হবে। ওসমান হাদি লক্ষ কোটি তরুণের মধ্যে জীবিত থেকে যাবেন ইনশাআল্লাহ। জানাজা শেষে মিছিল নিয়ে শাহবাগে চলে যাবেন। দাফনের পর ওখানে আপনাদের সাথে কথা বলব।
জাবেরের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, প্রিয় ওসমান হাদি, তোমাকে আমরা বিদায় দিতে আসি নাই এখানে। তুমি আমাদের বুকের ভেতরে আছো এবং চিরদিন, বাংলাদেশ যতদিন আছে, তুমি সকল বাংলাদেশির বুকের মধ্যে থাকবে। এটা কেউ সরাতে পারবে না।
এরপর বক্তব্য দেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। তিনিই হাদির জানাজার নামাজে ইমামতি করেন। ওসমান হাদির রেখে যাওয়া আট মাসের শিশু সন্তানের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, এই আট মাসের সন্তানকে তিনি রেখে গেছেন। সন্তানের নামকরণের আগে ওসমান হাদি আমাকে যা বলেছিলেন, সেই স্মৃতি আজ বারবার মনে পড়ছে। হাদি ছিলেন ভাইবোনদের মধ্যে সবার ছোট, সে কথা তুলে ধরে আবু বকর বলেন, একটাই দাবি। সাত থেকে আট দিন হয়ে গেল, খুনি যদি পার পেয়ে যায়, এর চেয়ে লজ্জার আর কিছু নেই। তারা কেমন করে গেল, এই প্রশ্ন জাতির কাছে রেখে গেলাম।

সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পর হাদির জানাজায় অংশ নেন সবাই। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস, জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা জানাজায় অংশ নেন।
সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বেলা সোয়া ১টার দিকে হাদির মরদেহ বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স আসাদ গেট সংলগ্ন সংসদ ভবনে গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। জানাজায় অংশ নিতে সকাল থেকেই দলে দলে মানুষ আসছিল মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। দুপুর ১টার দিকেই প্রশস্ত ওই সড়ক কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। তাদের কারো মাথায় ছিল জাতীয় পতাকা বাঁধা, কেউ আবার গায়ে জড়িয়েছিলেন পতাকা। অনেকে স্লোগান দিচ্ছিলেন ‘আমরা সবাই হাদি হব যুগে যুগে লড়ে যাব’, ‘হাদি ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’।
খামারবাড়ি গোল চত্বরের সামনে দিয়ে তাদের মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে ঢোকানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কাউকে সন্দেহ হলে সেখানে তল্লাশি করা হচ্ছিল। তবে এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে তল্লাশি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। হাদির মৃত্যুর ঘটনায় এদিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখাসহ নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়।
কাজী নজরুলের পাশে শায়িত : কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবরের পাশে সমাহিত করা হয়েছে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান হাদিকে। গতকাল বিকাল ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে জাতীয় কবির সমাধিসৌধে তাকে দাফন করা হয়। সেখানে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেন, আজকে আমি সাধারণ মানুষের সাথে হাদির জানাজা পড়েছি। আজকে প্রধান উপদেষ্টা ডেকেছেন, আমি যাইনি। আল্লাহ হাদিকে শাহাদাতের জজবা হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে এ পর্যন্ত তৃতীয় শহীদ হিসেবে আল্লাহ কবুল করেছেন। আমি হাদিকে নিয়ে আমার মাকে শুইয়ে দিয়েছি, আজ আমি হাদিকে কবরে শুইয়ে দিতে এসেছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শহীদ শরীফ ওসমান হাদি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। দেশের জন্য তার যে ত্যাগ আল্লাহ তাআলা কবুল করুক। তার পরিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারিত পরিবারের অংশ। আমরা চূড়ান্তভাবে সম্মান জানাতে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের পাশে তাকে কবরস্থ করা হয়েছে। আমরা মনে করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার সন্তানকে বুকে নিয়েছে। মা তার ছেলেকে বা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে গ্রহণ করেছে।
বক্তব্য শেষে দোয়া পরিচালনা করেন হাদির বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক।
দাফনের সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সহযোগী অধ্যাপক সাইফুদ্দিন আহমদ, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, জাতীয় নাগরিক পার্টির আখতার হোসেন, হাসনাত আবদুল্লাহ, নাসির উদ্দিন পাটওয়ারী এবং হাদির পরিবারের সদস্যরা।
গত ১২ ডিসেম্বর দুপুর সোয়া ২টার দিকে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকির সামনে রিকশায় করে যাওয়ার সময় ওসমান হাদির উপর আক্রমণ হয়। ওই সময় মোটরসাইকেলে করে এসে দুজন তাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় দ্রুত তাকে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। একপর্যায়ে পরিবারের ইচ্ছায় তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এরপর সেখানে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) তার চিকিৎসা চলে। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সোমবার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল; সেখানেই বৃহস্পতিবার তার মৃত্যু হয়।












