সব ধরনের ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি রোধকল্পে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের এ আদেশ বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ আদেশ দেন। একইসঙ্গে অব্যাহতভাবে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধকল্পে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না–তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করেছেন উচ্চ আদালত। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানিকৃত অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোর্তিময় বড়ুয়া। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। ‘দুই সপ্তাহে ওষুধের দাম বেড়েছে ৭ থেকে ১৪০ শতাংশ’ শিরোনামে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে হাইকোর্টে এ রিট আবেদন করা হয়। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এ রিট দায়ের করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, দুই মাসে দেশের বিভিন্ন কোম্পানি তাদের উৎপাদিত ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে। অন্তত ৫০ ধরনের ওষুধের দাম ২০ থেকে সর্বোচ্চ ১৪০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। চলতি মার্চের প্রথম সপ্তাহেও দাম বাড়ানো হয়েছে বেশ কয়েকটি ওষুধের। সবচেয়ে বেশি বাড়ানো হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট, ডায়াবেটিসের রোগীদের ইনসুলিন ও ইনজেকশনের দাম। এছাড়া হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, হাঁপানিসহ বিভিন্ন ওষুধ এবং ভিটামিনের দামও বেড়েছে। বাদ যায়নি জ্বর–সর্দির ট্যাবলেট–ক্যাপসুল, বিভিন্ন অসুখের সিরাপও।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং বিক্রি থেকে আয়ের হিসেব পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দাম বাড়ানোর হার অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত হিসেবে কোম্পানিগুলো ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করছে। তাঁরা বলেন, বছরে দু’বার আন্তর্জাতিক মূল্যগুলো নিয়ে রিভিউ করলে জানা যায় আমাদের দেশে কোন ওষুধের দাম কমাতে হবে। সকল ওষুধের খুচরামূল্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলে সবাই অবগত হওয়ার সুযোগ পাবে। অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা নবায়ন করা জরুরি। কেননা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা দুই বছর পর পর নবায়ন করতে হয়। তবে স্বাধীনতার পর মাত্র তিন বার নবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ করা হযেছে আট বছর আগে ২০১৬ সালে।
সাম্প্রতিক সময়ে শুধু ওষুধের দাম লাগামহীনভাবে বাড়িয়েছে, তা নয়; বাজারে ভেজাল, মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভেজাল ওষুধ বলতে বোঝায়, ওষুধে যা যা উপাদান থাকার কথা তা না থেকে অন্য কোনো উপাদান থাকা বা কার্যকরী কোনো উপাদান না থাকা। পাশাপাশি নিম্নমানের ওষুধ বলতে বোঝায় নির্দিষ্ট ওষুধে যে পরিমাণ ওষুধ থাকার কথা তার চাইতে কম পরিমাণ ওষুধ থাকা বা মান নিয়ন্ত্রণের যে শর্ত তা পূরণ না করা। বিশ্বে কী পরিমাণ ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ বিক্রি হয় তার সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও ধারণা করা হয় এর বাৎসরিক পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা) যা অবৈধ বাণিজ্যের বিবেচনায় দ্বিতীয় (১ম মাদক)। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যা প্রকট আকারে ছড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি তা বিস্তৃত হচ্ছে উন্নত দেশগুলোতেও। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে আমদানিকৃত ওষুধের শতকরা ৫ ভাগ ভেজাল বা নিম্নমানের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে যত ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধ তৈরি হয় তার শতকরা ৩৫ ভাগ তৈরি হয় ভারতে যার বাৎসরিক বাজার মূল্য ৪০০০ কোটি রুপি (৬০০০ কোটি টাকা) এবং ভারতের মোট ওষুধের বাজারের যা শতকরা ২০ ভাগ।
একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য মতে বাংলাদেশে ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের বাৎসরিক বিক্রি প্রায় ১০০০ কোটি টাকা যা মোট বিক্রির প্রায় শতকরা ১০ ভাগ। নকল, ভেজাল ও ক্ষতিকর ওষুধ প্রতিরোধ এত সহজ হবে না বলে আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা, বিশেষ করে অনুন্নত ও দরিদ্র দেশগুলোতে। কারণ এসব দেশে মাথাপিছু আয় নগণ্য হওয়ার কারণে দামি ওষুধ কেনার সামর্থ না থাকায় মানুষ সস্তায় ওষুধ পেতে চাইবে। ওষুধের দাম বেশি হলে অসাধু ব্যবসায়ীরা নকল ওষুধ উৎপাদনে ও বিক্রয়ে বেশি উৎসাহী হয়। এ ফর্মূলা ওষুধ কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বাড়ায়।
দেশের ওষুধের দোকানগুলোতে নকল ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের সংখ্যাও কম নয়। মুনাফা বেশি হওয়ায় অসৎ ব্যবসায়ীরা মানহীন ওষুধ বিপণনেই বেশি আগ্রহী। অভিযোগ রয়েছে নকল, মানহীন ও অনিবন্ধিত ওষুধ বিপণন সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক ব্যবসায়ী। তাদের খুঁটির জোর এতই বেশি যে, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনাও কঠিন হয়ে পড়ে। নকল ভেজাল ওষুধ তৈরি কিংবা বিক্রির দায়ে যাদের গ্রেফতার করা হয়, তারা আইনের ফাঁক গলিয়ে ছাড়া পেয়েই আবারও জড়িয়ে পড়ে এ ঘৃণ্য ব্যবসায়। ভেজাল বা নিম্নমানের ওষুধের সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্ববহ কারণ এটি মানব স্বাস্থ্য ঝুঁকির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একদিকে নকল ভেজাল, অন্যদিকে উচ্চমূল্যের দাপটে অসহায় হয়ে পড়ছে দেশের মানুষ। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত।