১৯৬০ এর দশকে নিউ ইয়র্ক সিটিতে বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার কমপ্লেক্সের ধারণা করা হয়। মিনোরু ইয়ামাসাকি নামে একজন জাপানি–আমেরিকান স্থপতি এই প্রকল্পের নকশা করেন। নির্মাণ শেষে এটি বিশ্ব বাণিজ্যের একটি প্রতীক হিসেবে পরিচিতি পায়। দুটি টুইন টাওয়ার বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে রেকর্ড ধরে রাখে। এই দুই বিশাল কমপ্লেক্সে ছিল ফিন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন, কর্পোরেট অফিস, ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড কনভেনশন হল, কনফারেন্স রুম, টেম্পোরারি এবং পারমানেন্ট এক্সিবিশন হল, ফাইভ স্টার হোটেল, রেস্টুরেন্টে, হ্যালিপ্যাড, মিডিয়া সেন্টার, শপিংমল, রুব টব, ত্রি বেইজমেন্ট কার পারকিং, আইটি জোন ইত্যাদি।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার হচ্ছে একটি দেশের প্রেস্টিজিয়াস ল্যান্ডমার্ক। চট্টগ্রাম চেম্বারে আমার চাকরির সময়কালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর সদস্যপদ গ্রহণ করি। আমি যখন আমেরিকা যাই নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনের ফাইন্যান্সিয়াল ডিস্ট্রিক্ট এর সাতটি ভবনের একটি বড় কমপ্লেক্স তৎকালীন ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবন এর ৭৬ তলায় ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এসোসিয়েশন এর প্রেসিডেন্ট এুঁ ঞড়ুড়ষষর এর সাথে মিটিং করেছিলাম।
শ্রদ্ধেয় মরহুম মীর্জা আবু মনসুর, শ্রদ্ধেয় আখতারুজ্জামান চৌধুরী, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার আলী আহমদ, এসএম আবুল কালাম, সারোয়ার জামাল নিজাম, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে তাদের নেতৃত্ব আর অসম্ভব পরিশ্রম করে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর জমি নেওয়ার জন্য চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তার সময়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারকে প্রায়োরিটি দিয়ে বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি, আমার বস মাহমুদুক হক চৌধুরী, আলহাজ্ব জাহাঙ্গীর উদ্দিন চৌধুরীও চেষ্টা করেছিলেন।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪ লালদিঘি ময়দানে বিশাল জনসভায় চট্টগ্রামে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্থাপনের ভূমি বরাদ্দের ঘোষণা প্রদান করেন। সারোয়ার জামাল নিজাম চেম্বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তীতে ১৫ এপ্রিল, ১৯৯৫ চেম্বারের বোর্ড অব ডাইরেক্টর্সের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব অলি আহমদ বীর বিক্রম–এর সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাত করেন। এই সাক্ষাতকালে তিনি বিনামূল্যে ভূমি প্রদানের আশ্বাস প্রদান করেছিলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী’র অবদান কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করতেই হয়। তার সহায়তায় এবং প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিক নির্দেশে ২৪ মে, ১৯৯৫ ইং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় প্লট নং ১০২ ও ১০৩ এর মধ্যবর্তী প্রায় ২ বিঘা জমি বিনা মূল্যে চেম্বারকে প্রদান করা হয়। তার এই সিদ্ধান্ত এতদঞ্চলের ব্যবসায়ী, শিল্পপতি তথা সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃক অভিনন্দিত হয়। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের এই অংশটুকু রেজিস্ট্রেশন করার জন্য সারোয়ার জামাল নিজাম, জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এবং আমি কোর্ট বিল্ডিং এ সন্ধ্যায় রেজিস্ট্রি করতে যাই। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমরা রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করি। একটা নামফলকে তৎকালীন বোর্ড অব ডাইরেক্টরস এর নিচে সচিব মাহমুদুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিবদ্বয় জাহাঙ্গীর উদ্দিন চৌধুরী ও ওসমান গণি চৌধুরীর নাম খোদিত হয় এবং বর্তমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর খোলা মাঠে তা স্থাপন করা হয়। কিন্তু, ২০১৩ সালে বাদামতলীস্থ চেম্বার হাউজ থেকে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এ চেম্বার অফিস শিফট করার জন্য যে নামফলক তৈরি করা হয় তাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোরশেদ মুরাদ ইব্রাহিমকে অনুরোধ করা সত্ত্বেও সচিব ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে আমার নামটি সংযুক্ত করেন নি। ১৯৯৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রথমবারের মতো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এসময় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী কর্ণেল অলী আহমদ বীর বিক্রম উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানটি আমি সঞ্চালনা করি।
বাংলাদেশে কোরিয়ার সিংগেল ইনভেস্টর ইয়াং ওয়ান গ্রুপের প্রেসিডেন্ট মি. কাইহাক সুং–এর তত্ত্বাবধানে কোরিয়ার ঊজঅ আর্কিটেক্টস এন্ড প্ল্যানার্স– এর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন স্থপতি মি. সিউং এইচ, সেং সহ নেতৃস্থানীয় স্থপতি ও বিশেষজ্ঞগণ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সাইট পরিদর্শন করেছেন এবং একটি অত্যাধুনিক মডেল ও স্ট্রাকচারাল ডিজাইন তৈরী করেছেন। অনুমান করা যায় এই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার আনুমানিক ২০ তলা, যার আনুমানিক ব্যয় ৪০ কোটি টাকা। এই সেন্টার নির্মাণের লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়া স্থাপত্য, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি, পরিকল্পনা, বাণিজ্যিক সহায়তা প্রদান করেছিল। তাছাড়া জাপান, হংকং এসব দেশের সাথেও যোগাযোগ করা হয়েছে। ৪ বছরের মধ্যেই এই সেন্টারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হবে। এই সেন্টারে একটি ট্রেড প্রমোশন, অন্য একটি ইন্টারন্যাশনাল হোটেলসহ মূলবিল্ডিং দুটো টাওয়ার সমৃদ্ধ হবে। সেন্টারে কার পার্কিং সুবিধাসহ দুটো বেসমেন্ট ফ্লোর, স্থায়ী অস্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র, শপিং সেন্টার, ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, পোস্ট অফিস, দেশী–বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মতামত বিনিময়ের জন্য আন্তর্জাতিক মানের কনফারেন্স রুম, অডিওভিজুয়েল স্টুডিও, টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টার, ট্রান্সলেশন ফেসিলিটি, গ্যালারি এন্ড পোর্ট সিটি কর্মার্শিয়াল মিউজিয়াম, ট্রেড এসোসিয়েশন অফিস, শুল্ক বিভাগ, আমদানী ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের অফিস, ট্রেড ফেসিলিটি অফিস, শিপিং অফিস, বিদেশি বাইয়িং হাউস অফিস করা হয়।
আমার প্রীত হওয়ার বিষয় যে, নিউইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার স্মেসড হওয়ার আগেই আমি মার্কিন মুলুকে দেখেছি এবং সেটার আদলে গড়ে তুলবার জন্য চেষ্টা করেছি।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর সময়কালীন কমিটি ও দায়িত্বে যারা ছিলেন, প্রেসিডেন্ট জনাব সারওয়ার জামাল নিজাম, সিনিয়র ভাইস–প্রেসিডেন্ট জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এবং ভাইস–প্রেসিডেন্ট নুরুল কাইয়ুম খান।
পরিচালকগণ : আলহাজ্ব নাজমুল ইসলাম (বাবুল), আবদুস সালাম, মো. জাহাঙ্গীর আলম খান, মোহাম্মদ কবির, মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম, সেলিম আহমেদ, আবদুল্লাহ আল আহসান, প্রকৌশলী আলী আহমেদ, জনাব আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী, নাদের খান সাহেব, আলী আহমেদ, কামালউদ্দিন আহমেদ, এস.এম. জামাল উদ্দিন, চৌধুরী মোঃ শাহাবুদ্দিন, কালী পদ দাস, মোরশেদুল আনোয়ার চৌধুরী, মোহাম্মদ নুরুল আমিন, ইয়াকুব আলী মান্টো, মির্জা মোঃ বাবর, এ.কে.এম. আক্তার হোসেন।
২.
আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন ৬ জানুয়ারি ২০০৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর জন্য ২.৮৩ বিঘা জমি তৃতীয় বারের মতো তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মাধ্যমে রেলওয়ের কাছ থেকে বুঝে নেন। ১৫ জানুয়ারি এই উপলক্ষে বিশাল র্যালি হয়।
২২শে জুলাই ২০০৩ সালে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার সভাপতিত্বে রেলওেয়ের জায়গাটার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চেম্বারের পক্ষ থেকে তিনি স্বাক্ষর করেন এবং রেলওয়ের পক্ষ থেকে স্বাক্ষর করেন চিফ এসোসিয়েট অফিসার ইব্রাহিম খলিল। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করি আমি। এই চুক্তির একটা শর্ত ছিল যে রেলওয়েকে পাঁচ হাজার ফিট স্কয়ারের একটা ফ্ল্যাট দিতে হবে।
সেই সময়েই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার নির্মাণের জন্য একটা টেন্ডার এর আহবান করা হয়। কনকর্ড, মীর নাছির এন্ড ব্রাদার্স এবং প্রাসাদ এই তিনটি কনস্ট্রাকশন ফার্ম কাজের জন্য আবেদন জানায়। পরে কনকর্ড কাজ পায়। এই পিরিয়ডের আরেকটা সফল কাজ হচ্ছে, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করার জন্য চেম্বার ১৫ জানুয়ারি ২০০৩ সালে বর্ণাঢ্য র্যালি বের করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণা করে এই প্রথমবারের মতো ১৫টি পয়েন্ট দিয়েছিলেন। ১১ মার্চ ২০০৩ সালে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেন এটিতে স্বাক্ষর করেছেন।
চট্টগ্রামের আগ্রাবাদের বিখ্যাত লেকের উত্তর তীরে ৭৪.৮৮ কাঠা জমিতে অবস্থিত, ৩০০ ফুট উঁচু ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবন। ফরমেশন গ্রাউন্ড লেভেল (ঋএখ) এবং এর ৩৬ ফুট নিচে এর বিলাসবহুল ৬,৭৩,০০০বর্গফুট ফ্লোর স্পেস এর বিশাল আকর্ষণ করেছে। যা বাংলাদেশের বৃহত্তম বন্দর নগরীর দূরবর্তী এলাকা থেকে এর বিশাল অস্তিত্ব সংযুক্ত করেছে।
২০০২ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত দুই মেয়াদে প্রেসিডেন্ট ছিলেন আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। তার সময়ে কমিটিতে বিভিন্ন দায়িত্বে যারা ছিলেন, সিনিয়র ভাইস–প্রেসিডেন্ট আলহাজ্ব এরশাদ উল্লাহ, ভাইস–প্রেসিডেন্ট মঞ্জুর–উল–আমিন চৌধুরী।
পরিচালকবৃন্দ : জনাব ডা. মইনুল ইসলাম মাহমুদ, শাহজাহান, মো: মাহবুব আলি, সৈয়দ জামাল আহমেদ, আফসার আমিন চৌধুরী, এম এ বাকের, মো: নুরুন নেওয়াজ সেলিম, হাসানুজ্জামান চৌধুরী, কামাল মোস্তফা চৌধুরী, আনিসুজ্জামান চৌধুরী, শাহেদুল আলম কাদেরী, আশেক ভূঁইয়া, আনোয়ার শওকত আফসার, পানাউল্লাহ আহমেদ, নাসির উদ্দিন চৌধুরী, মাহফুজুল হক শাহ, মাহবুব আলম, রাশেদ মুরাদ ইব্রাহিম, রফিকুর রহমান, জহিরুল ইসলাম চৌধুরী, মোহাম্মদ জহুরুল হক। আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীর মেয়াদকালের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের সময় বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয়বার ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানটিও আমি সঞ্চালনা করেছি। মূলত বর্তমান ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারটি পৃথিবীর অন্যান্য ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এর মতো হয়নি।
লেখক : সাবেক সচিব ও প্রধান নির্বাহী
দি চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি