চট্টগ্রামের মানুষ বেশ অতিথিপরায়ণ। নানা প্রকার মুখোরোচক খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। চা বা মহেশখালীর পান দিয়ে সাধারণ আপ্যায়নের পাশাপাশি নানা মুখোরোচক সুস্বাদু খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করা চট্টগ্রামের মানুষের বেশ সুখ্যাতি আছে। এখানে চট্টগ্রামের মাত্র কয়েকটি উল্লেখযোগ্য খাবার নিয়ে আলোচনা করা হলো। যেগুলো শুধূ চট্টগ্রামই নয়, এই খাবারের খ্যাতি দেশজুড়ে এবং বিদেশেও রয়েছে এর সুখ্যাতি।
মেজবানি গোশ্ত বা মাংস: আমাদের দেশের প্রত্যেকটি জেলায় নিজস্ব কিছু খাবার রয়েছে যেগুলোর সুনাম ও খ্যাতি সে এলাকা ছাড়িয়ে বর্হিবিশ্বেও এর সুনাম ছড়িয়ে আছে। যেমন, চট্টগ্রামের মেজবানি মাংস। চট্টগ্রামের মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে মেজবান। ফারসি শব্দ মেজবান এর অর্থ ‘অতিথি আপ্যায়নকারী‘ বা ‘নিমন্ত্রণকর্তা’ এবং মেজবানি শব্দের অর্থ– ‘আতিথেয়তা’ বা ‘মেহমানদারি’। চট্টগ্রামের ভাষায় একে ‘মেজ্জান’ বলা হয়ে থাকে। এই মেহমানদারিতে চট্টগ্রামের মানুষের বেশ সুখ্যাতি রয়েছে। গরুর মাংস সবখানে রান্না হলেও চট্টগ্রােেম মেজবানি মাংসের ভিন্ন এক ধরনের আবেদন রয়েছে। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দেওয়া চট্টগ্রামের মেজবানে বিশেষ পদ্ধতিতে বাবুর্চিরা এই মাংস রান্না করেন বলে এর নাম হয়েছে মেজবানি মাংস। এর পরিচিতি এখন বিশ্বজুড়ে। এখন মেজবানি মাংস শুধু বিয়ে, আকিকা, মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা রাজনৈতিক আয়োজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। মেজবানি মাংস চলে এসেছে পাঁচ তারকা হোটেল থেকে শুরু করে নামী–দামি সব রেস্টুরেন্টে।
কালাভুনা: গরু বা খাসির মাংস দিয়ে চট্টগ্রামের এটি একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। চট্টগ্রামের মানুষের বাহারি রন্ধনশৈলীর একটি সুনাম আছে। অনবদ্য রন্ধনশৈলীর এই মাংসের তরকারি যা বর্তমানে সমগ্র বাংলাদেশেই বিখ্যাত। জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের নাম কালাভুনা। কালাভুনা রান্না করতে অনেক রকমের মসলা ব্যবহার হয়। নানা রকম মসলার মিশ্রণে রান্না করার ফলে মাংস ভুনায় এক ধরনের কালো রং আসে বলেই একে ‘কালাভুনা ’ বলে। গরু বা খাসি দুটোরই মাংস দিয়ে কালাভুনা তৈরি করা হয়। মসলা ব্যবহারের কৌশলই এখানে প্রধান বিষয়। মাংস ভাজলেই শুধু কালো হয় না, মসলার সংমিশ্রণে সঠিক উপায়ে রান্না করেই আনতে হয় কালাভুনার কালো রং।
শুঁটকি: চট্টগ্রামের শুঁটকি দিয়ে তৈরি নানা মুখোরোচক খাবার আমাদের চট্টগ্রামের খাবারের ঐতিহ্যের এক অংশ। বিশেষ করে শীতকালীন সবজির সঙ্গে ছুরি শুঁটকি, তেল–পেঁয়াজ–মশলা দিয়ে লইট্টা শুঁটকি এবং মরিচ–পেঁয়াজ–সরিষা মেখে ঝাল ঝাল চিংড়ি শুঁটকির ভর্তার কথা বলতেই জিভে জল আসে না এমন ‘চাঁটগাইয়া’ খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। এক সময় শুঁটকিকে বলা হতো চট্টগ্রামের গরিবের খাবার। সে শুঁটকির দাম শুনলেই অনেকে আজ বিচলিত হয়ে পড়েন। সেই ‘গরিবের খাবার’ শুঁটকি এখন জায়গা করে নিয়েছে বিত্তশালীদের ডাইনিং টেবিলে কিংবা বিয়ের খাবারের মেন্যুতেও । অনন্য স্বাদের কারণে চট্টগ্রামের শুঁটকির তরকারির জনপ্রিয়তা দেশে–বিদেশে ছড়িয়ে গেছে। ভিন্ন জেলা থেকে চট্টগ্রামে আত্মীয়স্বজনরা বেড়াতে আসলে খাবারের মেন্যুতে শুঁটকির তরকারি অনেকেই পছন্দের তালিকায় রাখেন। চট্টগ্রামের হোটেলে খাবারের মেন্যুতে হোটেল বয়দের মুখে সীম বেগুন দিয়ে ছুরি শুঁটকির তরকারির নাম শুনতে পাওয়া যায়।
দুরুস কুরা: ‘দুরুস কুরা’ চট্টগ্রামের অসংখ্য ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে একটি। এই ‘দুরুস কুরা’ চট্টগ্রামের বিয়ে বা অন্য কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে অপরিহার্য একটি খাবার। চট্টগ্রামের খাবারের অনুষ্ঠানে যতই মুখরোচক খাবার পরিবেশন করা হোক না কেন জামাই বা বেয়াই এর সামনে এই ‘দুরুস কুরা’ না থাকলে আয়োজনে যেন কোথাও ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। চট্টগ্রামের নতুন জামাই, নতুন বউ বা নুতন বেয়াই–বেয়াইন, বাড়িতে আগত নতুন মেহমান বা কোনো সম্মানীত মানুষকে আপ্যায়ন করতে এই ‘দুরুস কুরা’র যেন অনেকের কাছে যেন সম্মানের বিষয়। একটি আস্ত মুরগিকে ভেতরের সব নাড়িভুঁড়ি বের করে ভালো ওয়াশ করে মসলা, হলুদ ভালো করে মিশিয়ে গরম গরম তেলে ভেজে একদম লাল করে আকর্ষণীয় লোভনীয় খাবারে পরিণত করা হয়। চট্টগ্রামের ভাষায় এটিই ‘দুরুস কুরা‘।
নোনা ইলিশ: চট্টগ্রামের নোনা ইলিশ জনপ্রিয় এক খাবারের নাম। পুরো একটি আস্ত ইলিশের পেট কেটে তাতে লবণ ঢুকিয়ে শুকিয়ে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইলিশকে নোনা ইলিশে রূপান্তর করা হয়। চট্টগ্রামে এলে অনেকেই চট্টগ্রামের শুঁটকির বাজার থেকে নোনা ইলিশ সংগ্রহ করে নিয়ে যান। নোনা ইলিশ দিয়ে নানা ধরনের তরকারি রান্না করা হয়। চটগ্রামের বাসাবাড়িতে ও হোটেল মোটেলে এই নোনা ইলিশের বাহারি সুস্বাদু রেসিপির দেখা মেলে। চট্টগ্রাম এমনিতেই শুঁটকির জন্য বিখ্যাত। এখানে রয়েছে নানা ধরনের শুঁটকির বিশাল বাজার। নোনা ইলিশ একটি জনপ্রিয় খাবার। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লাউ পাতা দিয়ে নোনা ইলিশ ভাজা ভীষণ মুখোরোচক।
বেলা বিস্কুট: চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবারের তালিকায় ‘চাঁটগার বেলা’ ঐতিহ্যের এক নাম। এক সময় চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোকদের আগে সকাল বেলাটা শুরু হতো চায়ের মধ্যে বেলা বিস্কুট চুবিয়ে খাওয়ার মধ্য দিয়ে। চট্টগ্রামে মাঠে খেটে খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে কোনো অতিথি গেলে আপ্যায়ন করা হতো বেলা বিস্কুট দিয়ে। বেলা বিস্কুট যে কোনো অসাধারণ বিস্কুট তা নয় বা বর্তমান সময়ের নানা ডিজাইনে তৈরি বিস্কুটের কাছাকাছিও নেই এর নান্দনিক রূপ। খুব সাদামাটাভাবে তৈরি হয় এটি। কিন্তু এখনো টিকে আছে বেলা বিস্কুটের ঐতিহ্য। উপমহাদেশের প্রাচীন বিস্কুট ‘চাটগাঁর বেলা’ ঐতিহ্যের এক নাম। যুগ যুগ ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে বহন করা এ ঐতিহ্য প্রসার লাভ করেছে দেশের অন্যান্য স্থানেও। বড় মাঝারি ছোট সাইজের নানা স্বাদের বেলা বিস্কুট বাজারে আছে। সাধারণ থেকে অভিজাত ঘরেও এর কদর আছে। প্রচলিত রয়েছে পর্তুগিজদের কাছ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই আবদুল গণি সওদাগর প্রথম বেলা বিস্কুটের প্রচলন ঘটিয়েছিলেন। এর নামকরণ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক অধ্যাপক আবুল ফজল ১৯৬৬ সালে তাঁর লেখা এক গ্রন্থে লিখেছেন, ‘চন্দনপুরার বেলায়েত আলী বিস্কুটওয়ালার নাম অনুসারে বেলা বিস্কুটের নামকরণ হয়েছে।’ এছাড়া বিভিন্ন গবেষকদের লেখায় ২০০ বছর আগে চট্টগ্রামের বেকারিতে সর্বপ্রথম বেলা বিস্কুট তৈরি হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী ‘বেলা বিস্কুট হলো চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এবং উপমহাদেশের প্রথম বিস্কুট, যা সারা বাংলাদেশ জুড়ে জনপ্রিয়। বেলা বিস্কুটের বিশেষত্ব হল এটি মাটির তৈরি তন্দুর বা চুলায় বানানো হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় রপ্তানি করা হয়।’
মধুভাত: মধুভাত একধরনের শীতকালীন মিষ্টান্ন খাবার যা চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবারের একটি। এটি সাধারণত আশ্বিন ও কার্তিক মাসে খাওয়া হয়। মূলত চাল, নারকেল, দুধ এবং চিনির সমন্বয়ে এটি তৈরি করা হয়। মধুভাতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এই ভাত রাতে রান্না করে, পরদিন সকালে পরিবেশন করা হয় এবং খেতে হয় খালি পেটে। আরেকটি বিশেষত্ব হল এই শর্করা জাতীয় খাবার দীর্ঘক্ষণ ঢেকে রাখার ফলে এতে কিছুটা অ্যালকোহল উৎপাদিত হয়, ফলে মধুভাত খাবার পর এক ধরনের ঝিমুনি আসে। চট্টগ্রামের এই খাবারের ভীষণ জনপ্রিয়তা রয়েছে। সাধারণত জালা চাউল, বিনি চাউল, নারকেল,পানি দিয়ে এটি তৈরি হয়।
বাকরখানি: বাকরখানি ময়দা দিয়ে তৈরি রুটি জাতীয় একটি খাবার বিশেষ। এটি একসময় বাংলাদেশের পুরান ঢাকাবাসীদের সকালের নাস্তা হিসাবে একটি অতি প্রিয় খাবার হলেও চট্টগ্রামের এ খাবারেরও বিশেষ ঐতিহ্য রয়েছে। ময়দার খামি থেকে রুটি বানিয়ে তা মচমচে বা খাস্তা করে ভেজে বাকরখানি তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাকরখানি বেশ রসালো ও সুমিষ্ট।
কচুশাক বা লক্ষ্মীশাক: চট্টগ্রামে কচুশাককে অনেকে লক্ষ্মী শাকও বলে থাকেন। পুষ্টিকর এ খাবারটি চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয়। কচুশাকের পাতা দিয়ে এ খাবারটি তৈরি করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিয়ের অনুষ্ঠান পরবর্তী প্রচলিত জামাইভাতে খাবারের পর্বে সর্বপ্রথম কচুশাক বা লক্ষ্মীশাক দেবার প্রথা প্রচলিত আছে। এছাড়াও প্রায় সকলেই পুষ্টিকর খাবার হিসাবে কচুশাককে খাবারের তালিকায় রাখেন।
ইতিহাস ঐতিহ্যে ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ চটগ্রাম খাবারের জন্যও বিখ্যাত। এখানে মাত্র কয়েকটি খাবারের কথা উল্লেখ কথা হলো। চট্টগ্রামের ভেতরে অঞ্চল ভিত্তিকও নানা ধরনের বিশেষ বিশেষ খাবারের সুনাম আছে। চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক আরো অনেক নানা সমৃদ্ধ খাবারের তালিকায় দিয়ে এটাকে বর্ধিত করা যায়। চট্টগ্রামের গ্রাম বাংলার অনেক সুস্বাদু খাবার ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে অভিজাত ঘরে ঠাঁই নিয়েছে এবং এর সুুনাম চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে দেশ বিদেশেও ছড়িয়ে গেছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক;
সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ।