চট্টগ্রাম শুধু নয়, উপমহাদেশের খ্যাতি অর্জনকারী অনন্য সঙ্গীত প্রতিষ্ঠান সঙ্গীত পরিষদ। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের সঙ্গীতানুরাগী গঙ্গাপদ আচার্য, শ্রীপদ আচার্য, পটিয়ার গোপাল দাশগুপ্তের নিরলস প্রচেষ্টায় সঙ্গীত পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম দিকে নন্দনকাননে পরিষদের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে এনায়েতবাজারস্থ ধীরেন্দ্র নাথ সেনগুপ্তের বাসভবন ভাড়া নিয়ে পরিষদ স্থানান্তরিত হয় (বর্তমানে অবস্থিত)। দেশ বিভগের পর গঙ্গাপদ আচার্য এবং তাঁর ভাই শ্রীপদ আচার্য দেশত্যাগ করলে পখোয়াজ শিল্পী শিবশঙ্কর মিত্র পরিষদের হাল ধরেন। সাথে ছিলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত প্রশিক্ষক সৌরন্দ্র রাল দাশগুপ্ত (চুলু বাবু)। সে সময় চট্টগ্রামের বিশিষ্টজন জয়নাল আবেদিন চৌধুরীকে (জুনু মিয়া) সভাপতি এবং বিনোদ বিহারী চৌধুরীকে সম্পাদক করা হয়। আই এইচ খান, সি আর দাশ, বদিউজ্জামান বড় লস্কর, সমীরণ সেন পরিচালনা পরিষদের সাথে যুক্ত হন।
ষাটের দশকের প্রথম দিকে চুলু বাবু অধ্যক্ষ এবং নৃত্য প্রশিক্ষক চুনী সেন উপাধ্যক্ষ হন। তাঁদের মেধায়, প্রজ্ঞায়, আন্তরিকতায় পরিচালিত সঙ্গীত পরিষদ চট্টগ্রামের সংস্কৃতিপ্রেমীদের যথেষ্ট উৎসাহিত করেন। ক্রমেই ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে লাগলো। তাঁদের প্রচেষ্টায় তখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্যসূচিতে সঙ্গীত বিষয় অর্ন্তভুক্ত হয়। বহু ছাত্র-ছাত্রী সঙ্গীত নিয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাস করে।
এসময় সঙ্গীত পরিষদে যাঁরা শিক্ষকতা করেছেন তাঁদের মধ্যে নির্মল মিত্র (রবীন্দ্র সঙ্গীত এবং বাঁশি), শিবশঙ্কর মিত্র (তবলা ও পাখোয়াজ), অমল মিত্র (গিটার), হারিশ উদ্দীন আহমেদ, শরদিন্দু দত্ত, অমূল্য গোপাল দত্ত, কৃষ্ণা দাশগুপ্তা (কণ্ঠ সঙ্গীত), নরেন্দ্র লাল দত্ত (বেহেলা), ওস্তাদ বেলায়েত হোসেন খান (উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে প্রশিক্ষণ দিতেন। উল্লেখ্য, তাঁরা সকলেই বিনা পারিশ্রমিকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়লে যৎসামান্য সম্মানী দেওয়া হতো। এসময় সঙ্গীত পরিষদ তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিভিন্ন মনোজ্ঞ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতো। রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন, রবীন্দ্র ঠাকুরের নৃত্যনাট্য এবং ব্যক্তিক্রমী আয়োজন ‘টোরী’ এ রাগের উপর নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়েছে যা সুধি মহলে বেশ প্রশংসিত হয়েছে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পরিচালক জওশন আরা মাহবুব সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৯১ পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে জওশন আরা মাহাবুব, বদিউজ্জামান বড় লস্কর এবং ডা. ছৈয়দুর রহমান চৌধুরী, সহ-সভাপতি পদে অ্যাড. স্বভুপ্রসাদ বিশ্বাস, অ্যাড. রানা দাশগুপ্ত, সম্পাদক পদে মনোবিজ্ঞানী এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ডা. এস পি তালুকদার।
১৯৯৪ সালে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সংগঠক তাপস হোড়। তিনি অদ্যাবধি ঐ পদে আছেন। তাঁর গতিময়তা সঙ্গীত পরিষদকে সার্বক্ষণিক সঙ্গীত চর্চায় রত রাখেন। বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মতিন এবং অধ্যক্ষের দায়িত্বে আছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে প্রথিতযশা শিল্পী পণ্ডিত স্বর্ণময় চক্রবর্ত্তী। অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকামণ্ডলী পরিচালিত সঙ্গীত পরিষদের বহু ছাত্র-ছাত্রী সঙ্গীতের বিভিন্ন শাখা গান, নৃত্য, বাদন এবং চিত্রাংকন বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ নিয়ে চলেছে।
বর্তমান সময়ে সংগীত পরিষদ জাতীয় অনুষ্ঠানসমূহ রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদযাপন, ২০১১ সালে রবীন্দ্রনাথের অর্ধশত জন্মবার্ষিকী পালন, ’৭৫ বছর পূর্তিতে ২০১৪ সালে ৩ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হীরক জয়ন্তী পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির ১০০ বছর পূর্তিতে পরিষদের ১০০ জন শিশু ছাত্র-ছাত্রীদের পরিবেশনায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ৮০ বছর পূর্তিতে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুলাই এবং একই বছর ২০ সেপ্টেম্বর ব্যতিক্রমী ২টি সেমিনার আয়োজন করেন। ‘চট্টগ্রাম ও রবীন্দ্রনাথ’ প্রবন্ধকার (অধ্যক্ষ শিমুল বড়ুয়া) এবং ‘চট্টগ্রাম ও নজরুল’ প্রবন্ধকার আলোকচিত্র শিল্পী মউদুদুল আলম, চট্টগ্রামের বিশিষ্টজনেরা এই সেমিনারে বক্তব্য দেন। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ঝুমুর গাঙ্গুলী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য রাখেন এবং নজরুল সংগীতের উপর কর্মশালা পরিচালনা করেন।
সংগীত পরিষদ বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বাইরে সঙ্গীত অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য গুণীজনদের সম্মাননা প্রদান করে থাকেন। শিল্পী সাদী মোহাম্মমদ, অভিনেতা খাইরুল আলম সবুজ, হাসান ইমাম, নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান, চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত, শিল্পী ইন্দ্রমোহন দাশ বংশী, উস্তাদ মিহির লালা, রবীন্দ্র সংগীত প্রশিক্ষক মিহির নন্দী, সুরকার সত্য সাহা, অমলা সাহা, প্রফেসর হাসিনা জাকারিয়া, শিল্পী আয়শা খাতুন প্রমুখ শিল্পীদের সঙ্গীত পরিষদ বিভিন্ন সময়ে সম্মাননা জানিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত আছে।