এসো হে বৈশাখ

গোপা রাণী দে | শুক্রবার , ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:০৭ পূর্বাহ্ণ

পহেলা বৈশাখ বাঙালিৃর সমাজ জীবনে এক অন্যতম অসাম্প্রদায়িক অনুষ্ঠান। তারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই দিনটি একান্ত নিজস্ব আচার, রীতিনীতি ও দর্শন দ্বারা পালন করে। রীতি অনুযায়ী আবারও দ্বারপ্রান্তে সমাগত বাংলা পঞ্জিকার ১ম মাস, বৈশাখের ১ তারিখ, বাংলা সনের ১ম দিন তথা বাংলা নববর্ষ বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব। বিশ্বের সকল প্রান্তের বাঙালিরা এই সার্বজনীন উৎসবটি পালন করে অতীত বছরের সকল দুঃখ গ্লানি ভুলে যাওয়ার প্রচেষ্টায়।

এই দেশের কৃষকশ্রেণি তথা গ্রামের জনগোষ্ঠীর সাথে বাংলা নববর্ষ ও ঋতুসমূহের এক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। তাদের ফসল উৎপাদন, বিপণন, বকেয়া আদায়, খাজনা সবই নববর্ষকে ঘিরে। তাদের কাছে বাংলা দিনপঞ্জির গুরুত্ব অপরিসীম। সূর্য উদয়ের সাথে সাথেই শুরু হয় বাংলা সনের ১ম দিনপহেলা বৈশাখ। আকবরের সময়কাল থেকে ১লা বৈশাখ উদযাপন হয়ে আসছে আড়ম্বরের সাথে। খাজনা আদায়ের সুষ্ঠুতা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুঘল সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি আদেশ দেন প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার জন্য। জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং হিজরি সনের উপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম বিনির্মাণ করেন। সেইসময় চৈত্র মাসের শেষ দিনে প্রত্যেককে খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টান্ন দ্বারা আপ্যায়ন করে ১লা বৈশাখ পালন করা হতো। দোকানপাটের হিসাব হালনাগাদ করা হতো আনুষ্ঠানিকভাবে। পুরানো বছরের হিসাব বই বন্ধ করে খোলা হতো নতুন হালখাতা।

মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব। এটা শুধু উৎসব নয়, বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষার মিলনক্ষেত্রও। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট কতৃক আয়োজিত এই শোভাযাত্রাকে ‘মানবতার অমূল্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসাবে ঘোষণা দেয় এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে। ১৯৮৯ সালে ১ম এই শোভাযাত্রার সূচনা হয় যার উদ্যোক্তা ছিল চারুকলার ১৯৮৬৮৭ ব্যাচ। আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে, মানুষ যখন তার বাকস্বাধীনতাসহ সকল মৌলিক ও মানবিক অধিকার ফিরে পেতে সোচ্চার, ঠিক তখন বৈশাখী উৎসবে ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউটের কতিপয় শিক্ষক শিক্ষার্থীর সুদূর প্রচেষ্টায় ১ম মঙ্গল শোভাযাত্রার সূচনা হয় সকাল ৮ ঘটিকায়, উদ্বোধন করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রেসিডেন্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ। এদিন শহরে ও গ্রামেগঞ্জে দেশীয় হস্তশিল্পের এবং মৃতশিল্পের পসরা নিয়ে মেলা বসে যা আমাদের আত্মঅনুসন্ধানের পথ দেখায়।

বাঙালি সংস্কৃতির অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও হারায়নি বৈশাখী মেলা। নতুন উদ্যোগ ও নতুন প্রেরণায় টিকে আছে আজও। নববর্ষকে ঘিরে ১লা বৈশাখ থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত চলে এই মেলা দেশের বিভিন্ন জেলায়। বাঁশের বাঁশি, ঢাল, তালপাতার সেপাই, মাটির জিনিস, মুড়িমুড়কি, নাগরদোলা, পান্তাইলিশ, বেতের তৈরি জিনিস, কাঁচের চুড়ি, দাবটি ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রামীণ পণ্যের পশরা দিয়ে সজ্জিত হয় মেলা। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে উৎসবের মূলকেন্দ্র ডি.সি. হিল এর মুক্তমঞ্চে ভোর থেকে বৈশাখকে আহবান জানিয়ে আরম্ভ হয় দিনটি, পাহাড় জুড়ে বসে মেলা। নগরীর সিআরবিতে (শিরীষ গাছ তলা) জাঁকজমকপূর্ণ বৈশাখী মেলা উদযাপন হয়। রাজধানী ঢাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট এর গানের মধ্য দিয়ে নতুন সূর্যকে আহবান জানানো হয় রমনার বটমূলে। ১৯৬০ এর দশকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক সন্ত্রাসের প্রতিবাদে ১৯৬৭ সালে ছায়ানট ১লা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

বর্ষবরণ উৎসব বাঙালির জন্য নবচেতনায় জাগ্রত হওয়ার সঞ্জীবনী সুধা। বাঙালি তার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, ভাতৃত্ববোধ এসব উপলব্ধি করতে পারে বর্ষবরণ উৎসবের মাধ্যমে। শুভ হোক ১লা বৈশাখ ১৪৩০, বয়ে আনুক চিরশান্তি ও সমৃদ্ধি দেশজুড়ে।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ,

বোয়ালখালী হাজী নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঙালির ঐক্যের চেতনা পহেলা বৈশাখ
পরবর্তী নিবন্ধপহেলা বৈশাখ ও আমার ছোটবেলা