কাঁটাতার আর রাজনীতি সীমানা আলাদা করে দিয়েছে তবুও দুই বাংলার সংস্কৃতি, রুচি, কৃষ্টিকে ভাগ করা যায়নি। আমরা যারা গান ভালোবাসি দুই মানচিত্রের মানুষের আবেগ আর স্বপ্নতো অভিন্ন হয়ে যায়নি এখনো। কথাগুলো আরাত্রিকা সিন্হার। বাড়ি ভারতের পশ্চিম বাংলার বাকুরায়। পশ্চিম বাংলায় মেয়েটি বেশ আলোচিত হয়েছে গান গেয়ে। বর্তমান সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি গান ভেসে বেড়াচ্ছে খুব। ‘এসো হে বন্ধু গানে গানে বলা যাক না’ শিরোনামে। গানের কথা লিখেছেন পশ্চিম বাংলার ছাত্রনেতা সৃজন ভট্টাচার্য। কোলকাতার যাদবপুরে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো একটি উন্মুক্ত সভা। সেখানে দুরন্ত মেজাজে গিটার হাতে নিয়ে আরাত্রিকা গেয়েছিলো–
এসো হে বন্ধু গানে গানে বলা যাক না
ছড়িয়ে দেব সে শিকল ভাঙার মন্ত্র
আমার চেতনা এখনও ভোলেনা বলতে
রাষ্ট্র? সেতো এখনও শোষণ যন্ত্র।
এ–যেনো পল রবসনের ছায়া ছোট্ট মেয়েটির চোখেমুখে। আবার মনে হয় পিট সিগার ভর করেছে ওর ওপরে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে ছড়িয়ে পড়া গানটি বাংলাদেশের মানুষেরও চোখ এড়িয়ে যায়নি। পূবের আকাশ বাতাস কাঁপিয়েছে গানটির সুর আর কথা।
আরাত্রিকার গায়কিতে দেখেছি অদম্য বিশ্বাসের উপস্থাপন। নতুন ভোরকে ডাকছে হাতছানি দিয়ে। অনাহার আর দারিদ্রপীড়িত মানুষের দু’মুঠো ভাতের অধিকার জানান দিচ্ছে মেয়েটি। হ্যাঁ, সত্যি এ–বধির সময়ে এটি একটি সত্যিকারের গণসংগীত। যেখানে আমরা সবল উচ্চারণে শুনতে পাই–
আমার দেশেও সক্কলে খেতে পায় কি?
বন্ধু এদেশ তোমারো তুমি কি ভাবছ?
সময় চলছে সামনের দিকে, চলবেই
জানালার কাছে বৃথাই করছ মাপযোক।
এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি হয়তো
এখানেই সব শেষ নয় জেনো বন্ধু
আমাদের চোখে নতুন ভোরের স্বপ্ন
রাত্রির পথ হোকনা যত বন্ধুর।
সত্যিই পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এখনো এই তরুণদের হাঁটতে হবে অনেকটা পথ। লড়াইটা একদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা আর অন্যদিকে ছদ্ধবেশি লুটেরা শোষকের ক্ষমতাতন্ত্রের সাথে। গানের কথা ও সুর সৃজনের। গানে গানে আরো কিছু কথা বলতে চেয়েছে সৃজন। ওরা কথা ও গানে বলেছে–
দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে
সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন
তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে
আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।
আমাদের গান ব্যারিকেড ভাঙা উদ্বেল
শত সহস্র ভাঙাচোরা মুখে ফিরবে।
পূব দিগন্ত লাল হয়ে গেলে ওই সেই
সোনালি ডানার চিল বন্দরে ভিড়বে।
সবার জন্য এই পৃথিবীর গান গাই,
শোণিত কনায় শিকল ভাঙার মন্ত্র।
ঝড় তুলে দিন বদল হবেই বন্ধু,
আসবে তোমার আমার সমাজতন্ত্র।
হতাশার এই কালে যখন একদল তরুণেরা সবার জন্য এই পৃথিবীর গান গায় তখন সত্যিই গণসংগীতের নতুন উপস্থাপন আমাদের সামনে এসে ধরা দেয়। বর্তমান সময়ে গণসংগীতের রচনা ও উপস্থাপন গেছে কমে। এর মূল কারণ হলো জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি। তবুও পশ্চিম বাংলায় ওরা ভাবছে নতুন করে, ভাবছে মানুষকে নিয়ে। তাই আবারো চল্লিশের দশকের মতো এই সময়ে আশা জাগানিয়া গান আমরা পেতে শুরু করেছি। এই গানটি সম্পর্কে কথা হচ্ছিলো সৃজন ভট্টচার্যের সাথে। সে জানালো যে, স্কুল জীবন থেকেই গান লেখার অভ্যাস ছিলো। দশম একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকে সে একটি ব্যান্ডের সদস্য হয়েছিলো ‘এবং কয়েকজন’ নামে। স্কুলে দুরন্ত ছাত্র ছিল। একদিন শিক্ষক দুষ্টুমির কারণে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছিলো। স্কুলের করিডোরে শাস্তি ভোগ করতে করতে গানটির কথা মাথায় আসে। তখন পশ্চিমবঙ্গে একটা পট পরির্তনের সময় ২০১১ এর আশপাশ। স্কুল লাইফের শেষের দিক। বামপন্থি পরিবারের ছেলে সৃজন। রাজনৈতিক বিভিন্ন তর্ক বির্তকে জড়িয়ে পড়েছে তারা।
শাস্তি ভোগ আর ক্লাস শেষ হলে ঝট করে কাগজ কলম নিয়ে লিখে ফেলেছিলো গানটি। সুরারোপ হয়েছে কিছুটা ধীরে। গানটিতে চার লাইনের কবিতাও রয়েছে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের।
দিগন্তে কারা আমাদের সাড়া পেয়ে
সাতটি রঙের ঘোড়ায় চাপায় জিন
তুমি আলো, আমি আঁধারের আল বেয়ে
আনতে চলেছি লাল টুকটুকে দিন।
বামপন্থিদের মনের, স্বপ্নের জানালাটা অনেক বড়। তারা সমাজ পরিবর্তন করতে চায়। দিন বদল করতে চায়। কিন্তু সেই সময়টিতে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারের উপর নয় বরং বামপন্থার উপর আক্রমণ হয়েছিল । সৃজনের ভাষ্যমতে ঐ টালমাটাল পরিবেশ খানিকটা লিখিয়ে নিয়েছিল এই গানটি তার হাত দিয়ে। তৃণমূল এবং বিজেপি একসাথে দুটো শত্রুর সাথে লড়াই করেত হচ্ছে পশ্চিম বাংলার বামেদের। বামপন্থার বিকাশ ঘটানোর কাজটা ধৈর্য নিয়ে দিনের পর দিন মাসের পর মাস একটু একটু করে করতে হচ্ছে তাদের। এ–সময়ে এই ধরণের কবিতা গান বা নাটক যদি উঠে আসে তাহলে নিশ্চিতভাবে মানুষকে অনুপ্রাণিত করবে। মানুষের মধ্যে প্রেরণার সঞ্চার করবে। সৃজনের সাথে আলাপ করতে করতে জানলাম যে, এই গানটা সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকেই এখন গাইছে।
আমরা যারা বাংলাদেশের মানুষ এবং একই স্বপ্ন দেখি তাদের কাছে এই গানের গুরুত্ব অনেক। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ৫৪ বছর ধরে গণমানুষের মুক্তির জন্য স্বাধীনভাবে সংস্কৃতির নানা আয়োজন নিয়ে লড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামে। এই লড়াই মানবমুক্তির। লড়াইয়ের একজন হিসেবে আমার সবসময় মনে হয়েছে পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, যে মানচিত্রেই হোক, মানুষকে জাগিয়ে দেবার যে কোন সাংস্কৃতিক উপাদান আমাদের লড়াইয়ের বড় ভিত্তি। গল্পের ছলে সৃজন আমাকে বলছিলো, যখনই সমাজে আলোড়ন ঘটার মতো কিছু হয়, যখনই কোন ঢেউ তোলার মতো রাজনৈতিক সামাজিক ঘটনা ঘটে তখন তরুণ প্রজন্ম জড়িয়ে পড়ে এবং স্বাভাবিকভাবেই নতুন গান, নাটক, কবিতা, ছবি ইত্যাদি বেরিয়ে আসে। আসতে বাধ্য, কারণ তরুণ প্রজন্ম সেই সময় এই মিডিয়াম গুলোকে বেছে নেয়। আপনাদের দেশে শাহবাগ আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কথাটা ভীষণভাবে সত্যি ।
গণসংগীতের জন্মই হয় সামাজিক সংকট থেকে। আজও সমাজে নানান অসংগতি, বেকারত্ব, দারিদ্রতা বিদ্যমান আছে। বর্তমান সময়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কথা বলা হচ্ছে। যেখানে উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষের বদলে রোবট করবে কাজ। কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার পৃথিবীর দিকে এগুচ্ছে পৃথিবী। তবে তো মানুষের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে উৎপাদন ব্যবস্থায়। তাহলে রোবট কি হয়ে উঠবে শ্রমিকশ্রেণি? না তা হবে না। বেকারত্বের অন্ধকার নেমে আসবে সমাজে। ফলে গণসংগীত বা গণআন্দোলন হতে বাধ্য। সাংস্কৃতিক সংগ্রামের গতানুগতিক প্রথাগত উপস্থাপনের বদল ঘটবে এবং ঘটছে। আরাত্রিকা সিনহারা সেই দিকই নির্দেশ করছে। আগামীর গণসংগীত নিয়ে বিস্তর আলোচনা আজ ভীষণ প্রয়োজন। গণসঙ্গীত নিয়ে নানা সঙ্গীত রচয়িতা ও সুরকারদের রয়েছে নানা ব্যাখ্যা। কেউ কেউ দেশাত্ববোধক গানকে গণসঙ্গীতের কাতারে ফেলতে চেয়েছেন আবার কেউবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে গান তাকেই গণসঙ্গীত হিসেবে অবিহিত করেছেন। আসলে গণসঙ্গীত আধুনিক কালের শ্রমজীবী মানুষের গান যা ধারণ করে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতাকে এবং তা হলো লোকসঙ্গীতের উচ্চতর বিকাশমান রূপ। গণসঙ্গীতের স্বরূপ নির্ধারণ করতে গিয়ে যথার্থ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় গণসঙ্গীতের সার্থক স্রষ্টা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের কাছে। তিনি বলেছেন ‘ স্বদেশ চেতনা যেখানে গণচেতনায় মিলিত হয়ে শ্রমিক শ্রেণির আন্তর্জাতিকতার ভাবাদর্শের সাগরে মিশেল সেই মেহনাতেই গণসঙ্গীতের জন্ম।’
মুক্ত জার্মানীর জাতীয় সঙ্গীতের স্রষ্টা এবং নাট্যকার ব্রেখটের প্রধান মিউজিক কম্পোজার হ্যানস আইসলার বলেছেন, ‘গণসঙ্গীত আধুনিক কালের শ্রমজীবী মানুষের গান। যা ধারণ করে শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকতাকে এবং তা হলো লোকসঙ্গীতের উচ্চতর বিকাশমান রূপ’। সে বিবেচনায় বিশ্বের কর্মহীনমানুষের একসাথে পথচলা ও গলা তুলে বিস্ফোরিত হবার অপেক্ষায় পৃথিবী।
তাহলে স্পষ্টতই বলা যায় যে লোকসঙ্গীত হলো শেকড় এবং আঞ্চলিকতার বতাবরণে প্রবাহমান। দেশবন্দনার বা দেশাত্ববোধক গান ধারণ করে আছে জাতীয়তাবোধকে আর গণসঙ্গীত অঞ্চল–দেশকে ধারণ করে ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীর মানুষের মুক্তির লড়াইয়ে অর্থাৎ আন্তর্জাতিকতার চেতনায়। সেই চেতনার বিকাশে নিঃসন্দেহে সৃজন আরাত্রিকাদের অগ্রযাত্রা বিশ্বমানবের মুক্তির দিক দিগন্ত নির্দেশ করবে।