এসডিজি অর্জনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভূমিকা

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ২০২৩ :

ডা: মাহমুদ এ. চৌধুরী আরজু | রবিবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২৩ at ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ

প্রতিবছর ৩রা ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ৪৭/৩ এর সিদ্ধান্ত মোতাবেক এই দিবসটি পালিত হয়। এ দিবসের উদ্দেশ্য হচ্ছেপ্রতিবন্ধীর বিষয়ে সবাইকে অনুধাবণ করতে হবে এবং তা হবে মর্যাদার সাথে। এদের অধিকার সমুন্নত রাখতে হবে। কোন ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন করা যাবে না। প্রতিটি রাষ্ট্রের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বলয়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবছর ৩রা ডিসেম্বর নিউইউর্কের জাতিসংঘ সদর দপ্তরে উদ্ভোধনী অনুষ্ঠান ও প্যানেল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘের সকল সদস্য এবং দেশের সকল সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা এই দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ অনুষ্ঠান করে থাকে।

প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন২০১৩” তে সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে কোন কারণে ঘটিত দীর্ঘমেয়াদি বা স্থায়ীভাবে কোন ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত বা ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্ততা বা প্রতিকূলতা এবং উক্ত ব্যক্তির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিগত ও পরিবেশগত বাধার পারস্পরিক প্রভাব, যাহার কারণে উক্ত ব্যক্তি সমতার ভিত্তিতে সমাজে পূর্ণ ও কার্যকর অংশগ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই সংজ্ঞা প্রতিবন্ধী শিশুর বেলায়ও প্রযোজ্য। প্রতিবন্ধীর ধরণঃ শারীরিক, মানসিক, বুদ্ধিগত, বিকাশগত, ইন্দ্রিয়গত ক্ষতিগ্রস্থতা এবং প্রতিকূলতার ভিন্নতায় হতে পারে। মানসিক আঘাতও প্রতিবন্ধিকতার বড় কারণ। বাংলাদেশ সরকার চারটি নিউরোডেপলাপমেন্টাল ডিসঅর্ডারকে প্রতিবন্ধিকতার হিসাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। এগুলো হচ্ছে অটিজম, সেরিব্রাল পালসি, ডাউন সিনড্রম ও মেন্টাল ডিসঅর্ডার। এজন্য সরকার নানা কর্মসূচীও গ্রহন করছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা ও অটিজম সংক্রান্ত জাতীয় পরামর্শক কমিটির চেয়ারপার্সন সাইমা ওয়াজেদ হোসেনের নেতৃত্বে এ ব্যাপারে দেশে ব্যাপক কাজ হচ্ছে এবং অচিরে বাংলাদেশ বিশ্বে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।

প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সরকার ৩২তম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে। দিবসটি যথাযথ মর্যাদাপূর্ণভাবে উদযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয় সরকারি ও বেসরকারী পর্যায়ে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান প্রতিবন্ধী নিয়ে বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করে তাদেরকে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করার জন্য কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় “United in action to rescue and achieve the SDGs for, with and by person with disabilities বাংলায় হচ্ছে– “প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাথে সম্মিলিত অংশগ্রহণ, নিশ্চিত করবে এসডিজি অর্জন”। প্রতিবন্ধীবান্ধব বর্তমান সরকার দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তিসহ সমাজের প্রতিটি মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রোতে সম্পৃক্ত করতে বদ্ধপরিকর। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস অত্যন্ত জরুরি। তাদের বাদ দিয়ে মূলস্রোত ধারা উন্নয়ন অসম্ভব। সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্প্রসারণের পাশাপাশি তাদের শারিরিক, মানসিক উন্নয়ন প্রয়োজন। একটি সমৃদ্ধ জীবন গঠনের পথকে প্রসারিত করতে দেশের সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবী।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বিশ্বের জনসংখ্যার ১৫% শতাংশ লোক অর্থাৎ ১ বিলিয়ন লোক কোন না কোন ভাবে প্রতিবন্ধীতা নিয়ে বসবাস করছে। এর মধ্যে ৪৫০ মিলিয়ন লোক মানসিক বা স্নায়ু রোগে ভুগছে এবং এদের দুইতৃতীয়াংশ লোক তাদের এ সমস্যার জন্য ডাক্তার বা স্বাস্থ্য কর্মীর কাছে আসে না। কারণ এতে সামাজিক বা লোকের কাছে হেয় হবার সম্ভবনা আছে বলে মনে করে। তাছাড়া প্রতিবন্ধী লোকেরা নানা কুসংস্কার বা বন্ধনার স্বীকারও হয়ে থাকে। এ সমস্ত প্রতিবন্ধী লোকেরা বেশীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার পরিবর্তে অপচিকিৎসা করে থাকে। যা তার সমস্যাকে আরো ভয়াবহ বা মারাত্মক করে ফেলে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ৬৬ মিলিয়ন লোক মস্তিস্কের আঘাত জনিত কারণে নানা ধরনের পঙ্গুত্ব বরণ করছে। প্রতি ১৬ জন শিশুর মধ্যে ১ জন শিশু অটিজম আক্রান্ত। কিছু কিছু প্রতিবন্ধীকতা আছে যা স্বাভাবিকভাবে চোখে পড়েনা। কেউ বা কিছু অনুমান করতে পারে না যে তার মধ্যে কোন কোন ভাবে স্বীমাবদ্ধতা আছে। এর মধ্যে সাধারণত আচরনগত সমস্যা অন্যতম। যেমন কিছু শিশু অতিমাত্রায় চঞ্চল, কথা বলার সমস্যা, লেখার সমস্যা। এগুলোর কারণ সাধারনত নির্ণয় করা যায় না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এ ধরনের সমস্যার জন্য জীন গঠিত সমস্যাকে দায়ী করা হয়। অনেক সময় মস্তিস্কের জন্মগত ক্রটির কারণে শিশুর শারিরীক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে সিটিস্ক্যান ও এমআরআই আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত করেছে। অনেক শিশু ডাউন সিনড্রম নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। অধিক বয়সে কোন নারী সন্তান জন্ম দিলে কিছু চেহারাগত, দৈহিকগত বা অঙ্গের সমস্যা নিয়ে শিশুটি জন্মগ্রহণ করে। এখানেও জীন সমস্যাকে দায়ী করা হয়।

কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা আছে যেমনমানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি, দুর্বলতা এমনকি দীর্ঘ মেয়াদী ব্যাথা একজন মানুষকে প্রতিবন্ধকতার মাঝে ফেলতে পারে। উদাহরণ স্বরূপএডিএইচডি -(অতি চঞ্চলতা), ডিসপ্র্যাক্সিয়া – (হাঁটা বা চলার ক্ষেত্রে অসামঞ্জ্যতা) , ডিসলেক্সিয়া– (পড়ার অসুবিধা), ডিসক্যালকুলিয়া– (গণিতে অক্ষমতা), ডিসগ্রাফিয়া– (লেখার ক্ষেত্রে সমস্যা), ট্যুরেটের সিনড্রোম– (হাত বা পা অস্বাভাবিকভাবে নড়াচড়া করে, মাঝে মাঝে মাথা নাড়ানো, অপ্রয়োজনে গলা পরিষ্কার করা) এ সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে neurodiversityবলা হয়। যা শিশুর বিকাশে বিশেষ করে বুদ্ধি বিকাশের অন্তরায় হয়। তবে অনেক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি আছে যারা নিজ গুণে বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছে। এমনকি অলম্পিক পদ প্রাপ্ত হয়েছে। আমাদের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা শিশু বান্ধব করা উচিত। এমনকি অভ্যর্থনা ডেস্কে কর্মরত ব্যক্তি একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা শিশু আসলে তাকে দেখে বুঝতে হবে যে এই ব্যক্তি বা শিশুর কোন না কোন প্রতিবন্ধকতা আছে তাকে সম্মানের সাথে তার কার্যাদি করার সুযোগ করে দিতে হবে।

এখানে উল্লেখ্য যে, এ বৎসর চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্রের ২৫ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। অর্থাৎ রজত জয়ন্তী উৎসব। ১৯৯৮ সালের ১লা ডিসেম্বর হাসপাতালের ছোট্ট একটি রুমে আমার তত্ত্বাবধানে “শিশু বিকাশ কেন্দ্র” নামে এই কেন্দ্রের সূচনা হয়। পরে একজন সাইকোলজিস্ট ও একজন থেরাপিস্টকে নিয়ে বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা ও থেরাপি বা ব্যায়ামের মাধ্যমে এই কেন্দ্রটি পরিচালিত হতে থাকে। পরবর্তীতে মা ও শিশু হাসপাতালের বর্তমান জেনারেল সেক্রেটারী জনাব রেজাউল করিম আজাদ সাহেবের ঐকান্তিক চেষ্টায় নতুন ভবনে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক সেবাসমূহ চালু হয়। তখন এই কেন্দ্রের নাম করণ করা হয় “অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র”। এই কেন্দ্রে প্রদত্ত সেবাসমূহ হচ্ছেরেপিড নিউরোডেভেলপমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট(RNDA), ডেভেলপমেন্টাল থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি, লোভিশন ক্লিনিক, চক্ষু পরীক্ষা, বুদ্ধিমত্তা পরীক্ষা, সাইকোথেরাপি, স্পীচ থেরাপি, শ্রবণশক্তি পরীক্ষা, পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ, ইইজি, এনসিভি, ইএমজি ইত্যাদি। এ পর্যন্ত কয়েক লক্ষের অধিক বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী শিশুকে আমরা সেবা দিয়েছি। এর ফলে অনেক শিশুর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে এবং তাদের পিতামাতারা উৎসাহিত হয়েছে। একটু আশা নিয়ে আসে যে হয়তো আমার শিশুটি ভাল হয়ে যাবে। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি।

পরিশেষে, আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে প্রতিবন্ধী সকল শিশুর জন্য বাসযোগ্য একটি পৃথিবী হউক। এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র,

চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রতিবন্ধীদের কল্যাণ ও উন্নয়ন
পরবর্তী নিবন্ধবরকল এস জেড উচ্চ বিদ্যালয় প্রাক্তন শিক্ষার্থী পরিষদ গঠন