আমাদের দেশের একটা নিয়ম হলো, যে কোনো বড় প্রকল্পের কাজ শুরু হলে আর শেষ হতে চায় না। শুরুতে প্রকল্পের মেয়াদকাল ও ব্যয়-বরাদ্দ একরকম করা হলেও, শেষ পর্যন্ত তাতে স্থির থাকা যায় না। মেয়াদকাল বর্ধিত করা হয় আর অর্থের হয় না সংকুলান। যতই দিন যেতে থাকে, ততই এর সময় ও ব্যয় বাড়তে থাকে। কোনো প্রকল্প সময়মতো শেষ হওয়া একটি বিরল ঘটনা। নগরীর যাতায়াত ব্যবস্থা সহজ করার ক্ষেত্রে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেগুলো বছরের পর বছর ধরে চলছে। এসব প্রকল্প সময়মত শেষ না হওয়ায় কী পরিমাণ ভোগান্তি সৃষ্টি করে চলেছে, তা নগরবাসী জানে। গত ১৯ অক্টোবর দৈনিক আজাদীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকালীন ভোগান্তি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। ‘কথা দিয়েও রাখেনি ম্যাক্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বন্দরনগরীর যান চলাচলের বন্ধ্যাত্ব ঘুচানো, প্রত্যাশিত গতিশীলতা সৃষ্টিসহ বিভিন্নমুখী লক্ষ্য সামনে রেখে গ্রহণ করা হয় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ। লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সন্নিকটস্থ টানেল রোড পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হলে শহরের যান চলাচলের ক্ষেত্রে ব্যাপক গতিশীলতা আসবে। মাত্র ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময়ে যাতায়াত করা যাবে এয়ারপোর্ট কিংবা পতেঙ্গার শিল্পাঞ্চলে। শহরের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের লক্ষ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বহুল প্রত্যাশার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পাঁচটি পৃথক ভাগে বিভক্ত করে ১৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়াল সেতু নির্মাণের কার্যক্রম চলছে। এরমধ্যে লালখান বাজার-বারেক বিল্ডিং পর্যন্ত প্রথম ধাপ, বারেক বিল্ডিং-সল্টগোলা ক্রসিং দ্বিতীয় ধাপ, সল্টগোলা ক্রসিং থেকে সিমেন্ট ক্রসিং তৃতীয় ধাপ, সিমেন্ট ক্রসিং থেকে কাঠগড় চতুর্থ ধাপ এবং কাঠগড় থেকে পতেঙ্গার ল্যান্ডিং পয়েন্ট পর্যন্ত পঞ্চম ধাপ চিহ্নিত করা হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল শেষ ধাপ থেকে। বর্তমানে ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে সিমেন্ট ক্রসিং পর্যন্ত দুইটি ধাপের (৪র্থ ও ৫ম) কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এই দুই ধাপে গার্ডার স্থাপনের কাজ চলছে। আবার বারিক বিল্ডিং থেকে দেওয়ানহাট পর্যন্ত এলাকায় বর্তমানে কোথাও পিলার নির্মাণ করা হচ্ছে। কোথাও বা করা হচ্ছে পাইলিং। শহরের ব্যস্ততম এই অংশটিতে কাজ করার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু শর্ত দেয়া হয়েছিল। এর মধ্যে অন্যতম শর্ত হচ্ছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের জন্য সড়কের মাঝখানে যে পরিমাণ এলাকা ঘেরা হবে তার দুইপাশে বিশ ফুট করে দুই লেনে গাড়ি চলাচলের রাস্তা নিশ্চিত করতে হবে।
পুলিশের এই শর্ত মেনেই নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স রেনকিং জেবি লিমিটেড ঘেরা দেয়া অংশের দুই পাশে চার লেনের গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করার কথা। এলাকায় কাজ শুরু করার পর রাস্তাটি সমপ্রসারিত করা হয়। ঘেরা দেয়া অংশের দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনে গাড়ি চলাচলের জায়গা করা হয়। কিন্তু বেশ কিছু বৈদ্যুতিক পিলারের কাছে বিভিন্ন অংশে রাস্তার যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। তবে সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দেখা দিয়েছে রাস্তার কার্পেটিং নিয়ে। পুরো রাস্তার পিচ নষ্ট হয়ে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। হাজার হাজার খানাখন্দক এবং গর্তে ভরে উঠেছে পুরো রাস্তা। বৃষ্টির পানি জমে অবস্থা আরো নাজুক হয়ে ওঠে। রাস্তাটি ঠিকঠাক রাখার দায়িত্ব ম্যাক্স রেনকিং-এর হলেও তারা এই ব্যাপারে চরমভাবে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। মাসের পর মাস শহরের প্রধান এই রাস্তাটি নষ্ট হয়ে থাকলেও কারো যেন কিছু যায় আসে না।
নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেছেন, পৃথিবীর কোনো দেশে উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে এমন সমন্বয়হীনতা দেখা যায় না। উন্নত বিশ্বে একটি প্রকল্পের মেয়াদ যে সময় ধরা হয়, তার আগেই কাজ শেষ করা হয়। আর আমাদের দেশে সম্পূর্ণ উল্টো।
সংশ্লিষ্ট লোকদের মনোভাব এমন, উন্নয়ন পেতে হলে ভোগান্তি সইতে হবে। একথা অস্বীকার করা যায় না, জনগণ উন্নয়ন চায়। তবে এই উন্নয়ন করতে গিয়ে কত সময় পর্যন্ত তাদের ভোগান্তি পোহাতে হবে তার হিসাবটি তো তাদের জানা থাকতে হবে। অনির্দিষ্ট কাল ধরে যদি উন্নয়ন কাজ চলতে থাকে, তাহলে ভোগান্তিরও শেষ হবে না। এভাবে দিনের পর দিন চলে যাবে, উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল মানুষ পাবে না, উল্টো শারীরিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
জনগণের সুবিধার জন্যই সরকার উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গ্রহণ করে। তার জন্য কিছুটা কষ্ট হলেও মানুষ তা মেনে নেয়। কিন্তু সুষ্ঠু ও সময়োপযোগী পরিকল্পনার অভাবেই উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ হয় না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হয়। তাই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সকে পুলিশের পক্ষ থেকে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছিলো, সেসব শর্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নের জন্য আহ্বান জানাই। আমরা চাই নগরবাসীর ভোগান্তির অবসান ঘটুক।