এলার্জি শব্দটির সাথে দেশের কমবেশি আমরা সবাই পরিচিত, যেটি শুনলে সবারই এলার্জি শুরু হয়ে যায়। এই সোনার বাংলা এলার্জি প্রধান দেশ। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা বাস করছি এলার্জির সাথে। সবদিকে এলার্জির সমাহার, যেন এলার্জি থেকে বাঁচার কোন উপায় নেই। খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে হাটে-বাজারে, শিল্প-কারখানায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত সবখানেই এলার্জির ছড়াছড়ি। এই এলার্জি থেকে সৃষ্টি হয় শ্বাসকষ্ট, এক্জিমা, নাকের দীর্ঘমেয়াদী রোগের উপসর্গ, চর্মরোগের বিভিন্ন প্রদাহ ইত্যাদি। ধূলাবালি, ফুলের রেণু, নির্দিষ্ট কিছু খাবার ও অনেক ঔষধ মানবদেহের শরীরে প্রদাহজনিত যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে, সাধারণভাবে তাকে আমরা এলার্জি বলে জানি। এলার্জি শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ থেকে। গ্রীক শব্দটিকে অনুবাদ করলে হয় পরিবর্তিত প্রতিক্রিয়া। কিছু ধষষবৎমবহং (যা এলার্জি তৈরি করে) এর নাম ১। মাইট (এমন কিছু যা পুরানো কাপড়ে জন্মায়) ২। কুকুর, বিড়ালের পশম, প্রস্রাব ও লালা ৩। ফুলের রেণু ৪। ঘরের ধূলাবালি ৫। তুলা বা পাটের আঁশ ৬। পোকা মাকড়ের হুল ৭। স্যাঁতস্যাঁতে কার্পেট ৮। সিগারেটের ধোঁয়া ৯। ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া ১০। বিশেষ কোন খাবার ১১। হরমোন ইনজেকশন ১২। চুলের কলপ ১৩। রঙ ১৪। স্বভাব ইত্যাদি। তবে এসবে সকলেরই যে এলার্জি হয় তা কিন্তু নয়। কিছু কিছু জিনিসে কারো কারো এলার্জি হতে পারে।
এলার্জির ঝুঁকি ও কারণঃ- এলার্জির প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হওয়ার যে অস্বাভাবিক প্রবণতা তার প্রকৃত কারণ হচ্ছে বংশগত কারণ, যেমনঃ এলার্জি আক্রান্ত বাবা-মার সন্তানেরাও এলার্জিতে আক্রান্ত হয় এবং তাদের এলার্জিতে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা নন এলার্জিক বাবা-মার এলার্জিক সন্তান অপেক্ষা অনেক বেশি প্রকট। বাবা-মা কেউ এলার্জিতে আক্রান্ত না থাকলেও সন্তানের মাঝে ১৫% আশংকা থেকে যায়। বাবা-মা কেউ যদি এলর্জিতে আক্রান্ত থাকে তবে সন্তানের ৩০% আশংকা থাকে কিন্তু উভয়ে আক্রান্ত থাকলে তা বেড়ে ৬০% অধিক দাঁড়ায়। পরিবেশগত কারণ, ঋতুজনিত কারণে (বিশেষ করে শীতকালে), বাতাসে যখন ফুলের রেণু বেশি থাকে তখন এলার্জির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। শিল্প উন্নত দেশগুলোতে বাতাসে দূষণের পরিমাণ বেশি হওয়াতে এলার্জির প্রকোপও বেশি।
এলার্জি জনিত সমস্যা ও তার উপসর্গঃ- ধষষবৎমরপ ৎযরহরঃরং- সাধারণভাবে এটি হে ফিভার নামে পরিচিত। এ ধরনের এলার্জি রোগীর অসম্ভব রকম হাঁচি হয়। বাতাসে অত্যধিক মাত্রায় ফুলের রেণু থাকার কারণে এটির সৃষ্টি। এছাড়াও ধূলিকণা, কুকুর ও বিড়ালের লোম, ছত্রাকের কারণেও এটি হতে পারে। নিশ্বাসের সাথে এই জাতীয় জীবাণু যখন নাকের ভিতরে প্রবেশ করে, প্রদাহজনিত কারণে অভ্যন্তরীণ টিস্যুগুলো নানা ধরনের উপসর্গ প্রকাশ করে। নাক সংলগ্ন কান, সাইনাস এবং গলাও একারণে আক্রান্ত হয়। উপসর্গসমূহঃ ক) নাক দিয়ে অনবরত পানি ঝরা। খ) নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া। গ) নাক চুলকানো। ঘ) অসম্ভব রকম হাঁচি। ঙ) কান ও গলা চুলকানো, খুসখুস করা ইত্যাদি।
এলার্জিক এজমা বা হাঁপানীঃ কষ্টদায়ক এই এজমার বিভিন্ন কারণের মধ্যে এলার্জি অন্যতম। শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত এই সমস্যায় ফুসফুস ও এর অভ্যন্তরীণভাগে প্রদাহের সৃষ্টি হয়। এই প্রদাহ ফুসফুসে বাতাস প্রবেশের পথকে সংকীর্ণ করে তুলে, ফলে বাতাস ঢুকতে ও বেরুতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। উপসর্গসমূহঃ ক) প্রথম দিকে সর্দি কাশি বা সূক্ষ কাশি শুরু হয়, খ) ক্রমশঃ শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। গ) নিশ্বাসে শোঁ শোঁ শব্দ হয়, ঘ) দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়।
ধষষবৎমরপ পড়হলঁহপঃরারঃরং বা চোখের এলার্জিঃ- শরীরের অন্যান্য অংশের মতো চোখেও এলার্জির সৃষ্টি হয়। অক্ষি গোলকের চারপাশের পর্দায় এবং চোখের পাতার নিচের ভাগে এলার্জির কারণে প্রদাহ দেখা দেয়। ঋতু পরিবর্তনের সময় এ ধরনের এলার্জি বেশি দেখা দেয়। কোন ফুলের রেণু (বাঁশফুল, আতাফুল, পেপেফুল, সজনেফুল, নারকেল ফুল ইত্যাদি) হাওয়ায় ভেসে ভেসে চোখে লাগলে এলার্জি হতে পারে। এছাড়া কাজল, আইলাইনার ইত্যাদি প্রসাধন সামগ্রীও অনেক সময় চোখের এলার্জির কারণ হতে পারে। উপসর্গসমূহঃ ক) সমস্ত চোখ বিশেষ করে চোখের পাতার নিচে লাল হয়ে যাওয়া। খ) চোখ চুলকে ফুলে উঠা। গ) চোখ ছলছল করা ও পানি পড়া।
ধষষবৎমরপ বপুবসধ ঃ- এলার্জিক কোন কিছুর সংস্পর্শে এলে ধঃড়ঢ়রপ ফবৎসধঃরঃরং বা একজিমায় আক্রান্ত হয়। উপসর্গসমূহঃ ক) সমস্ত শরীর চাকা চাকা হয়ে লাল হয়ে ফুলে উঠে ও ভীষণ চুলকায় । খ) শরীরের ত্বক শুকনো ও রুক্ষ হয়ে যায় এবং প্রচণ্ড চুলকায়। গ) বচ্চাদের মুখে ও ঠোঁটের কোণে ঘা হয়, বড় ছেলে-মেয়েদের বেলায় চোখের চারপাশে, কনুইয়ের ভাঁজে, হাঁটুর নীচে এবং বয়স্কদের শরীরের মধ্যভাগে ফুসকুড়ি বের হয় ও চুলকায়।
এলার্জিক শকঃ- হরমোনাল ইনজেকশন বা কোন পোকা মাকড়ের হুল দ্বারা এই ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। উপসর্গসমূহঃ দ্রুত শ্বাস নেওয়া, শোঁ শোঁ আওয়াজ হওয়া, গলা শুকিয়ে আসা, নাক বন্ধ হওয়া, ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়া, সমস্ত ত্বক লাল বর্ণে রূপ নেয়া।
ফুড এলার্জি বা খাবারের ফলে এলার্জিক প্রবণতার বেশ কিছু কারণঃ- জন্মের পরপর একাধিকবার ডায়রিয়াজনিত রোগে ভোগা । জীবনের শুরুতেই নানাবিধ এন্টিবায়োটিক ঔষধ গ্রহণসহ যাদের পরিপাকতন্ত্র একটু দেরিতে পরিণত অবস্থার দিকে এগোয় তাদেরও খাবারে এলার্জি দেখা দেয়। কোন কারণে পাকস্থলীতে প্রদাহ দেখা দিলে এলার্জি বৃদ্ধি পায় । এছাড়াও কোনো কারণে পরিপাকতন্ত্রের ব্যাক্টেরিয়াল ফ্লোরা বিপর্যস্ত হলে ফুড এলার্জি দেখা দেয়। একারণে ডায়রিয়া বা যে কোনো দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার সময় এবং তা থেকে অব্যাহতির পরে খাদ্য নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
খাবার থেকে এলার্জি দেখা দিলে তার ফল স্বরূপ সাধারণত আমবাত, একজিমা, শ্বাসকষ্ট, পেটের গোলমাল ও বমি দেখা দেয়।
বিরল এলার্জিঃ আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে মনের সাথে অসুস্থতার একটা অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক আছে, আর তাই মানসিক কারণেও অনেক সময় এলার্জি হতে পারে। টেনশন বা মানসিকচাপ বেড়ে গেলে গায়ে ৎধংয বেরোয়, হাঁচি বা কাশি হয় অথবা হাঁপানির টান ওঠে। ডাক্তারী ভাষায় এর নাম কোলিনার্জিক আর্টিকেরিয়া। কোনো মানুষ সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতা থাকলে তাকে দেখা মাত্রই কারও মাঝে এলার্জিক প্রবণতা তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। আর ঠিক এ কারণেই স্বামীর সাথে ঠিকমত বনিবনা না থাকলে কোনো মহিলার তার স্বামীকে দেখলেই গায়ে ৎধংয বেরোয় বা হাঁচি শুরু হয়। উত্তেজনা কমে গেলে বা বিরক্তিকর মানুষটি সামনে থেকে সরে গেলে এই সমস্ত উপসর্গও কমে যায়। অনেক সময় মানসিক কারণে বাড়াবাড়ি রকমের এলার্জি হতে পারে।
অনেকের রঙে এলার্জি দেখা দেয় অর্থাৎ বিশেষ কোন রঙ দেখলে শরীর চুলকে ফুলে ওঠে। এমন অনেক মানুষ আছে যাদের পানি থেকে এলার্জি হয়। এদের ক্ষেত্রে পানি খেলে গলার ভিতরে চুলকাতে থাকে এবং ফুলে ওঠে। গোসল করলে সমস্ত শরীরে ৎধংয বেরোয়। আরও মারাত্মক ব্যাপার হল এরা যদি পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করতে যান তবে শ্বাসনালীতে ড়বফবসধ ও এলার্জি হয়ে অজ্ঞান হয়ে যান।
লেখক: সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল।