যে ধরনের তালা ব্যবহার করা হোক না কেন, প্রযুক্তি ও উপকরণ দিয়ে চোখের নিমেষেই তালা খুলে ফেলতে পারে চোর চক্রের সদস্যরা। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে তারা যেকোনো মোটরসাইকেল চুরি করে পালায়। চোরাই মোটরসাইকেল এক জেলা থেকে অন্য জেলায় স্থানান্তরেও তারা এক ঘণ্টারও কম সময় নেয়। চুরি করার আগে তারা সেই এলাকার অপ্রচলিত ও সংক্ষিপ্ত রাস্তার সন্ধান আগেই নিশ্চিত করে। আন্তঃজেলা মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশ এ ধরনের চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে। শুধু তাই নয় এমন কিছু চোরের সম্পর্কে তথ্য পেয়েছে, যাদের নেটওয়ার্ক গোটা দেশজুড়ে। অনেকে ভিআইপি চোর হিসেবে মোটরসাইকেল চুরি করতে যায় কোনো গ্রুপের হয়ে অন্য জেলায়। তাদের খাতির যত্নও করা হয় সেভাবেই।
সিএমপি উত্তর বিভাগের উপ–কমিশনার (ডিসি) মোখলেসুর রহমান মোটরসাইকেল চোরদের প্রসঙ্গে বলেন, নগরের বিভিন্ন এলাকা ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকায় মোটরসাইকেল চুরি করতে চক্রের দুইজন সদস্য স্পটে থাকে। একজনের কাজ হচ্ছে মোটরসাইকেল মালিকের গতিবিধি লক্ষ্য করা, অন্যজন মোটরসাইকেলটি কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করে। ৪৫ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মধ্যে মাস্টার চাবি দিয়ে লক ভেঙে মোটরসাইকেল চালু করে ফেলতে পারে তারা। সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে সরাসরি মেকানিকের কাছে গিয়ে তারা বিক্রি করে।
হারানো মোটরসাইকেল খুঁজে পাওয়া কঠিন : পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, হঠাৎ কোনও স্থান থেকে মোটরসাইকেল চুরি হয়ে গেলে তা শনাক্ত করতে ভিডিও ফুটেজ বা প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য সংগ্রহ করার জন্য নির্ভর করতে হয় ম্যানুয়েল পদ্ধতির ওপর। ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রত্যেক থানায় যাবতীয় তথ্য জানিয়ে দেওয়া হয় এবং সোর্সকে জানানো হয়। এসব সোর্স কখনও কাজে আসে, কখনও আসে না। আবার পেশাদার মোটরসাইকেল চোররা চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বর এবং নিবন্ধন নম্বর বদলে দেয়। ফলে হারানো মোটরসাইকেল খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
সিএমপির গোয়েন্দা (বন্দর ও পশ্চিম) বিভাগের উপ–কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, মোটরসাইকেল চোর চক্রের কয়েকটি গ্রুপ শনাক্ত করা হয়েছে। মোটরসাইকেল চুরি করে তারা দূরে বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যায়, যার কারণে মোটরসাইকেল উদ্ধার ও চোরকে গ্রেপ্তার করতে সময় লাগে। ইঞ্জিন–চেসিস নম্বর–রঙ পরিবর্তন : এক থেকে দুই মিনিটের মধ্যে একটি মোটরসাইকেল চুরি করে চোরেরা। এরপর দ্রুত মোটরসাইকেলটিকে গ্যারেজে এনে ইঞ্জিন ও চেচিস নম্বর পরিবর্তন করে সেটিতে রং করা হয়। পরে ক্রেতার কাছে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ বলে বিক্রি করে মোটরসাইকেল। শুধু তাই নয়, কখনো কখনো মোটরসাইকেলের যন্ত্রাংশও আলাদা করে বিক্রি করতো মোটরসাইকেল চোর চক্রের সদস্যরা। চক্রটি তিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে মোটরসাইকেল চুরি করে। একটি গ্রুপে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গাড়ি চুরি করে। আরেকটি গ্রুপ তাদের নিজস্ব ওয়ার্কশপে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ পরিবর্তন ও রং করে গাড়িকে নতুনের মতো চকচকে করে ফেলে। আরেকটি গ্রুপ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বাইকারদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে চোরাই মোটরসাইকেল বিক্রি করে।
ভুয়া নিলামের কাগজে ক্রেতাকে হস্তান্তর: ক্রেতারা যেরকম মডেল ও দামের মধ্যে পুরাতন মোটরসাইকেল কিনতে চায় সে অনুযায়ী চক্রটি সরবরাহ করে। ক্রেতার চাহিদা মাথায় রেখেই ডিলাররা চোরদের চুরি করতে মাঠে নামায়। চাহিদা মতো মোটরসাইকেল চুরি হয়ে গেলে ডিলার অরিজিন্যাল চেসিস ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর পাল্টে দেয়। পরে ভুয়া নিলামের কাগজ তৈরি করে ক্রেতার কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই ভুয়া কাগজ দিয়েই ক্রেতারা রাস্তায় মোটরসাইকেল চালায়।
বর্ডারক্রস বা টানা বাইক কেনাবেচা : ফেসবুকে চটকদার বিজ্ঞাপন, ‘বাইক কিনুন সাধ্যের মধ্যে, করুন স্বপ্নপূরণ’। এরপর ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার ও ইমোতে যোগাযোগ করে দরদাম। ঘরে বসেই ক্রেতা পেয়ে যাচ্ছেন বাজার দরের চেয়েও তিন থেকে চারগুণ কম দামে ব্র্যান্ডের নতুন মোটরসাইকেল। চোরাচালানের মাধ্যমে আসা এসব মোটরসাইকেল সীমান্ত এলাকার মানুষের কাছে ‘বর্ডারক্রস বা টানা বাইক’ নামে পরিচিত। সারা দেশে অন্তত ৮টি টানা বাইক চক্রের সদস্যরা রমরমা ব্যবসা করছে। তারা বিআরটিএর বৈধ নিবন্ধন সনদ, ডিজিটাল নাম্বার প্ল্লেটসহ সবকিছু করে দিচ্ছে।
হাজিরা দিতে এসে মোটরসাইকেল চুরি : পটিয়ার বাসিন্দা রিপন। মোটরসাইকেল চুরি তার ‘বাঁ হাতের খেল’। মোটরসাইকেল দেখলেই তার চুরির নেশা মাথায় জেঁকে বসে। মোটরসাইকেল চুরির মামলায় হাজিরা কিংবা উকিলের সঙ্গে দেখা করতে চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিংয়ে এলে, সেখান থেকেও চুরি করেন মোটরসাইকেল। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে যে, যতবার তিনি কোর্টবিল্ডিং আসেন অন্তত একটা মোটরসাইকেল পার্কিং স্ট্যান্ড থেকে হাওয়া হয়ে যাবেই! গ্রেপ্তার হওয়ার পর নিজেই জানিয়েছেন পুলিশকে যে, কোর্টবিল্ডিংয়ে আসেন তিনি বাস, রিঙা বা সিএনজি টেঙিতে চেপে। যাওয়ার সময় যান মোটরসাইকেল চালিয়ে। তার কাছে আছে বিশেষ কায়দায় তৈরি একটি ‘ম্যাজিক’ চাবি, যা দিয়ে মোটরসাইকেলের যে কোনো তালা খুলতে সময় লাগে ৪০ সেকেন্ড থেকে এক মিনিট। কোতোয়ালী থানা পুলিশ জানায়, কোর্ট বিল্ডিং এলাকা–ই শুধু নয়, নগরীর বাকলিয়া, পাঁচলাইশ, পটিয়া ছাড়াও এই চক্রটির বাইক চুরির নেটওয়ার্ক বিস্তৃত ফেনী ও কুমিল্লা পর্যন্ত।
চোরাই বাইক বিক্রিতে অনলাইনে বিজ্ঞাপন : সিএমপির মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর–দক্ষিণ) বিভাগ একটি গ্রুপকে গ্রেপ্তার করেছে যারা বাইক চুরি করে অনলাইনে বিক্রি করত বলে জানিয়েছে পুলিশ। সিএমপি মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর–দক্ষিণ) বিভাগের উপ–কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান জানান, চোর চক্রের সদস্যরা ভিন্ন পন্থায় মোটরসাইকেলগুলো চুরি করে নিজেদের হেফাজতে রাখে। পরবর্তী সময় অনলাইনে বিজ্ঞাপন দিয়ে অন্য চোর চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিক্রি করে থাকে।
তালিকাভুক্ত মোটরসাইকেল চোর: চট্টগ্রামে বিশের অধিক মোটরসাইকেল চোর চক্রের সর্দার রয়েছে। আর তারা পাঁচ থেকে ছয়টি চক্রে ভাগ হয়ে চুরি করে। এক চক্রের সঙ্গে আরেক চক্রের সমন্বয়ও রয়েছে। দেশের পাঁচ জেলায় আছে তাদের ডিলার। চট্টগ্রামে কোথাও মোটরসাইকেল চুরি হলে ঘুরে–ফিরে আসে তাদের নাম। দীর্ঘদিন ধরে গাড়ি চুরি সংক্রান্ত মামলার তদন্ত কাজের সঙ্গে জড়িত এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল চোরদের রয়েছে এলাকাভিত্তিক সমন্বয়।