এলপিজির ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার তৈরিতে বিনিয়োগকারীদের খরচ আড়াই হাজার টাকা। বাজার ধরার জন্য ভর্তুকি দিয়ে ৫শ থেকে ৬শ টাকায় এসব সিলিন্ডার বিক্রি করা হয় ডিলার-ডিস্ট্রিবিউটরদের কাছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশে বাড়তে থাকে ইস্পাতের দাম। এ সুযোগে ভর্তুকির সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করে রোলিং মিলে বিক্রি করছে চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট। এলপিজি সেক্টরের বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করার মাধ্যমে বাজারে সিলিন্ডারের সংকট তৈরি করে এলপিজির দাম অস্থির করার চেষ্টা করছে অসাধু সিন্ডিকেট। সিলিন্ডারের সংকট তৈরি হলে বাড়তে পারে ভোক্তা খাতের এলপিজির দাম।
জানা যায়, তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বর্তমানে দেশে গৃহস্থালী, হোটেল, রেস্তোরাঁয় জনপ্রিয় জ্বালানি। ৫৭টি অপারেটর জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ থেকে লাইসেন্স নিলেও বর্তমানে ২৭টি অপারেটর বাজারে তাদের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু করেছে। বর্তমানে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বছরে প্রায় ১২ লাখ টনের বেশি এলপিজি আমদানি করে বোতলজাত করে ভোক্তা পর্যায়ে সরবরাহ করছেন। এ খাতে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে।
বেশ কয়েকজন ডিস্ট্রিবিউটরের সাথে কথা বলে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে এলপিজির বাজারে যুক্ত হয়েছে বেশ কয়েকটি বড় প্রতিষ্ঠান। বাজারে নিজের অংশদারিত্ব তৈরির জন্য নতুন প্রতিষ্ঠানগুলো কম দামে খালি সিলিন্ডার বাজারে ছাড়ে। এতে করে বাজারে অন্য ব্র্যান্ডের সিলিন্ডারের দামও কমে যায়। অন্যদিকে বর্তমানে বাজারে প্রতি টন ৬০ গ্রেডের রড কোম্পানিভেদে ৭৬ হাজার থেকে ৭৭ হাজার টাকা, ৪০ গ্রেডের রড ৬৪ থেকে ৬৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বিগত এক বছরে প্রতি টন লোহায় ১৫-১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে করে স্ক্র্যাপ লোহার দামও বেড়েছে বাজারে।
হালিশহর এলাকার সুপার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির স্বত্বাধিকারী জহুরুল হক জম্মু আজাদীকে বলেন, এলপিজি খাতের দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটছে। কোম্পানিগুলো ভর্তুকি দিয়ে সিলিন্ডারগুলো বাজারে ছেড়েছে। এসব সিলিন্ডার কম দামে বিক্রি করলেও এগুলোর স্বত্ব সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর। কিন্তু বাজারে লোহার দাম বেড়ে যাওয়ার সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কম দামের সিলিন্ডারগুলো কেটে স্ক্র্যাপ করে ফেলছে। এতে জাতীয় সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। প্রকারান্তরে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ হুমকিতে পড়ছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বাজারে ৫শ থেকে ৭শ টাকায় খালি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক এলপিজি ডিলার বলেন, গত দুই মাস ধরে চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে চোরাইভাবে এলপিজি সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে নগরীর পাহাড়তলী, ফৌজদারহাট এবং লোহাগাড়ার পদুয়া এলাকায় বেশ কয়েকটি সিন্ডিকেট রয়েছে। বর্তমানে প্রতি কেজি স্ক্র্যাপ লোহার মূল্য ৫০ টাকার বেশি। একটি সিলিন্ডার কাটলে ৬০০ টাকার লোহা ও ৮০-১০০ টাকায় বাল্বটি বিক্রি হয়। এতে একটি সিলিন্ডার কাটলে ১০০ টাকার মতো লাভ হয় সিন্ডিকেটের।
সরেজমিনে গতকাল দুপুরে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম-কঙবাজার মহাসড়কের পদুয়া এলাকায় মীর পাড়া রোডের এন আলম মার্কেটের পেছনে একটি ওয়ার্কশপে শত শত সিলিন্ডারের স্তূপ। ওই ওয়ার্কশপে গ্যাসের মাধ্যমে সিলিন্ডারগুলো কেটে স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে। প্রথমে সিলিন্ডারের বাল্বগুলো খুলে রাখা হয়। পরে গ্যাস দিয়ে কাটা হচ্ছে। তাদের গোডাউনে কাটা অবস্থায় কয়েকশ সিলিন্ডার মজুদ অবস্থায় দেখা গেছে। কাটা সিলিন্ডারগুলোর মধ্যে লাফস, পদ্মা, কর্ণফুলী, বসুন্ধরাসহ অনেক ব্র্যান্ডের সিলিন্ডার রয়েছে।
দুপুরে মোবাইলে কথা হলে মার্কেটটির মালিক মৌলভী নুরুল আলম বলেন, সাইফুল নামের এক ব্যক্তি বেশ কয়েক দিন ধরে রাতের বেলা সিলিন্ডারগুলো কাটছে। শব্দের কারণে রাতে ঘুমানো যাচ্ছে না।
পরে সাইফুল নামের ওই ব্যক্তির সাথে সিলিন্ডার বিক্রেতা সেজে কথা হলে তিনি বলেন, সিলিন্ডার কেজি ৩৫ টাকা করে কিনছি। আমি গারাঙ্গিয়ার আলমগীর ভাই থেকে বাল্ব ছাড়া কিনেছি। উনারও এলপি গ্যাসের ডিলার রয়েছে। বাল্বগুলো আলমগীর ভাই খুলে নিছে। আমাদের পরশু ২শ পিস, কালকে (শুক্রবার) দিছে ৮০ পিস। একটি খালি সিলিন্ডার ১২ কেজি থেকে সাড়ে ১২ কেজি হয়। ১২ কেজি হলে ৪২০ টাকা দাম পড়ে।
সন্ধ্যায় লোহাগাড়ার গারাঙ্গিয়া এলাকার শাহ মজিদিয়া রশিদিয়া এলপি গ্যাস ট্রেডার্সের মালিক মো. আলমগীরের কাছে জানতে চাইলে প্রথমে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। পরে সাইফুলের কাছে সিলিন্ডার বিক্রির কথা বললে তিনি বলেন, পুরো সিলিন্ডার ওকে দিয়ে দিছি।
এ ব্যাপারে পদ্মা এলপিজির সিনিয়র এঙিকিউটিভ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী আজাদীকে বলেন, আমরা বেশ কয়েক দিন থেকে শুনে আসছিলাম পদুয়া এলাকায় একটি সিন্ডিকেট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সিলিন্ডার কেটে রোলিং কারখানায় স্ক্র্যাপ হিসেবে বিক্রি করছে। বাজারে একটি সংঘবদ্ধ চক্র পদ্মা, লাফস, বিন হাবিব, কর্র্ণফুলী, বসুন্ধরা, ওমেরাসহ অনেক কোম্পানির খালি সিলিন্ডার কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে।
লাফস এলপিজির এরিয়া ম্যানেজার একরামুল হক জুয়েল আজাদীকে বলেন, একটি সিলিন্ডার তৈরি করতে কোম্পানিগুলোর ২২শ টাকা খরচ হয়। ভবিষ্যতে লাভ করার আশায় কোম্পানিগুলো ভর্তুকিতে সিলিন্ডারগুলো বাজারে ছাড়ছে। বর্তমানে কোম্পানি থেকে নতুন সিলিন্ডার বাজারে দেওয়া হচ্ছে না। এখন পুরনো সিলিন্ডারগুলো স্ক্র্যাপ করা হলে বাজারে সিলিন্ডারের সংকট তৈরি হবে। অথচ একটি সিলিন্ডার ১৫-২০ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়। প্রশাসনের উচিত অসাধু চক্রগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া। না হলে এলপিজি সেক্টর মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এলপিজি বোটলার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লাবাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. শামীম চৌধুরী আজাদীকে বলেন, এলপিজি ব্যবসার শুরুতে একেকটি সিলিন্ডারে ১৫শ থেকে ১৬শ টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে উদ্যোক্তারা। এলপিজি সেক্টরে এই পর্যন্ত প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এসেছে। সিলিন্ডার খাতে বড় বিনিয়োগ রয়েছে। সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করার মাধ্যমে বিনিয়োগের একটি বড় অংশই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, চট্টগ্রামে বেশ কিছু অসাধু সিন্ডিকেট সিলিন্ডার স্ক্র্যাপ করার মাধ্যমে বাজারে সিলিন্ডারের সংকট তৈরি করে এলপিজির বাজারকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র করছে। সিলিন্ডার সংকট দেখা দিলে এলপি গ্যাসের দাম বেড়ে যাবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে। তাই প্রশাসনের উচিত এলপিজি সিলিন্ডার স্ক্র্যাপিংয়ে জড়িত সিন্ডিকেটগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।
বিস্ফোরক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন আজাদীকে বলেন, সিলিন্ডার কাটতেও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স নিতে হয়। তারপরও অবৈধভাবে এলপি গ্যাসের সিলিন্ডার যেখানে কাটা হচ্ছে আমরা বিষয়টি তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেব।