যুগে যুগে সময়ের প্রয়োজনে পৃথিবীতে এমন কিছু মহৎ প্রাণ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যাঁদের কর্ম-কীর্তির সৌরভ জন্ম জনপদ-সমাজ-স্বদেশ ছাড়িয়ে বিশ্ব আঙিনায় ছড়িয়ে পড়ে, মানবকল্যাণে উৎসর্গিত তাঁদের জীবনের বিজয়গাথা কাল থেকে কালান্তরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়, তাঁদের গৌরবদীপ্ত জীবনদর্শন-জীবনাদর্শ বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের জন্য অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত হয়; তেমনি এক আলোকিত মানুষ হচ্ছেন জনাব মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী, যিনি এম আর সিদ্দিকী নামেই সুপরিচিত। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার রহমত নগর গ্রামের মোহাম্মদ হোসেন চৌধুরী (চট্টগ্রাম ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নির্বাচিত সদস্য) ও মোস্তফা খাতুনের জ্যেষ্ঠ সন্তান এম আর সিদ্দিকীর (জন্ম ১ মার্চ ১৯২৬) বিদ্যা-কর্মের খ্যাতি-স্বীকৃতি শুধু দেশ নয় আন্তর্জাতিক পরিসরেও বিস্তার লাভ করে। মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা-সংস্কৃতি বিশেষ করে আর্তমানবতার সেবায় তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন, যার জন্য তিনি দেশবরেণ্য-বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।
এম আর সিদ্দিকী স্কুল জীবনে, ইন্টারমিডিয়েট ও ডিগ্রি পরীক্ষাতে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। তারপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য কলকাতা গমন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৪৭ সালে এম কম ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগে প্রভাষক (১৯৪৮-১৯৫০) হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। কিন্তু মেধাবী এম আর সিদ্দিকী আরো উচ্চ ডিগ্রি অর্জনের জন্য পাকিস্তান সরকারের বৃত্তি নিয়ে লন্ডন গমন করেন। ১৯৫৪ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এবং পরে ১৯৫৫ সালে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাস করেন। লন্ডন থেকে ফিরে এসে তিনি জেমস ফিনলে অ্যান্ড কোম্পানিতে চিফ অ্যাকাউন্টেন্ট (১৯৫৫-১৯৫৮) হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি এ কে খান গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজে ফাইন্যান্স ডিরেক্টর পদে যোগ দেন। এই বছর তিনি নিজস্ব উদ্যোগে পাকিস্তানে প্রথম বাঙালি উদ্যোক্তা হিসেবে প্রথম বাংলাদেশি বীমা কোম্পানি ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। কর্মজীবনে একজন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে তিনি অনেক শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে মৌলিক গণতন্ত্রীদের বিপুল ভোটে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য (এমএনএ) নির্বাচিত হন। তাঁর আগে কেউ সীতাকুণ্ড থেকে পাকিস্তান জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হননি। ক্রমে রাজনীতিতে তাঁর পরিচিতি, খ্যাতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এমএলএ থাকা অবস্থায় ১৯৬৪ সালে পাকিস্তানে বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। তিনি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে বৃহত্তর চট্টগ্রাম জেলা (বর্তমান চট্টগ্রাম জেলা ও কক্সবাজার জেলা) আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন, ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পুনরায় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সীতাকুণ্ড এলাকা থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
তাঁর রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে জাতির ক্রান্তিকালে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর গৌরবদীপ্ত সাহসী, দূরদর্শী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবে অবদান রাখেন। চট্টগ্রামে সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম ঠিকানা ছিল এম আর সিদ্দিকী’র বাটালী হিলের ‘বাস ভবন’। তৎসময়ে চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর সাথে এম আর সিদ্দিকীও বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের ফিরোজশাহ কলোনি, ওয়ারলেস কলোনি, আমবাগান, পাহাড়তলী এলাকায় বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা এবং সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাস প্রতিরোধে এম আর সিদ্দিকী নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। এ সময় সংগ্রাম পরিষদের জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, এম এ হান্নান, আতাউর রহমান খান কায়সার, ডা. জাফর প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সাথে সামরিক বাঙালি কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, ক্যাপ্টেন হারুন প্রমুখের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক এম আর সিদ্দিকী সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে ও চট্টগ্রামের বেতারকর্মীদের নিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামে প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাটি ২৬ ও ২৭মার্চ প্রচারের ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট থেকে, পরবর্তীতে ত্রিপুরা-কলকাতা থেকেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম পরিচালনায় এম আর সিদ্দিকীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল যা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার প্রথম উদ্যোক্তা-সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ তাঁর ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ গ্রন্থে বিশদ বিবৃত করেছেন। এম আর সিদ্দিকী ছিলেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখের সাথে তাদের (বেলাল মোহাম্মদ প্রমুখ) অন্যতম প্রত্যক্ষ উপদেশক ও তত্ত্বাবধায়ক। ভারত সরকারের সহায়তা লাভের প্রত্যাশায় ৩০ মার্চ এম আর সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, আতাউর রহমান খান কায়সার ও আবদুল্লাহ আল হারুন ত্রিপুরার আগরতলায় পৌঁছেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র চন্দ্র সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সহায়তা কামনা করেন। এম আর সিদ্দিকীসহ আওয়ামী লীগের ৩৫জন এমএনএ, এমএলএ আগরতলা থেকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের হস্তক্ষেপের দাবি জানিয়ে দঝঃড়ঢ় ঃযরং মবহড়পরফব, বন্ধ কর এই গণহত্যা’ এই শিরোনামে ইংরেজিতে তৈরি করা একটি যৌথ বিবৃতি প্রচার করেন, এটাই হচ্ছে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্তানি গণহত্যা বন্ধের লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রথম আহ্বান- বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের প্রথম যৌথ বিবৃতি।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে মুজিবনগরে বাংলাদেশ অস্থায়ী প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। এম আর সিদ্দিকীকে পূর্বাঞ্চলীয় জোনের প্রধান করা হয়। আগরতলায়-কলকাতায় হাজার হাজার শরণার্থীদের রেজিস্ট্রেশন, আশ্রয় ও রেশনিং এর ব্যবস্থা করা, মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, নেতৃবৃন্দকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগঠিত করা, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনায় সহায়তা করা ইত্যাদি কাজে এম আর সিদ্দিকীর দক্ষতা ও দায়িত্ব-কর্তব্য নিষ্ঠায় মুগ্ধ প্রবাসী সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী সরকারের বিশেষ দূত হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জ্ঞাপন করেন। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এম আর সিদ্দিকী দেশে ফিরে আসেন। স্বাধীন দেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এবার স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে সামিল হলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের সাথে অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করে যান। ১৯৭৩ সালে পুনরায় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের বিশেষ দূত রূপে আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালী ও পশ্চিম জার্মানির রাষ্ট্র এবং সরকার প্রধানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালিদের প্রত্যাবাসনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার দায়িত্ব অত্যন্ত সফলতার সাথে পালন করেন।
ব্যবসা-বাণিজ্য শিল্প-কারখানা রাজনীতি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়িত থাকা সত্ত্বেও এম আর সিদ্দিকী আর্তমানবতার সেবায় সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৫৮ সালে আন্তর্জাতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লায়ন্স ক্লাব (১৯১৭, প্রতিষ্ঠাতা গবষারহ ঔড়হবং, শিকাগো, আমেরিকা)-এর শাখা খরড়হং ঈষঁন ড়ভ ঈযরঃঃধমড়হম-এর ঋড়ৎসধঃরড়হ করা হয় এবং ১৯৫৮ সালের ২ এপ্রিলে ঈযধৎঃবৎ প্রাপ্ত হয়। এটিই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম লায়ন্স ক্লাব। লায়ন এম আর সিদ্দিকীর মস্তিষ্ক প্রসূত ধারণা থেকে ঈযরঃঃধমড়হম খরড়হং ঋড়ঁহফধঃরড়হ গঠিত হয়। এর দু’বছর পর ১৯৬৮ সালে ঈখঋ ধারণা থেকে খরড়হং ঈষঁনং ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ঋড়ঁহফধঃরড়হ (খঈওঋ) গঠিত হয়। তাই খঈওঋ-এর সূতিকাগার হচ্ছে ঈখঋ. এসব কারণে লায়ন এম আর সিদ্দিকীকে ‘বাংলাদেশে লায়নিজম-এর জনক’ বলা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরপর দুইবার ১৯৭২-১৯৭৩ ও ১৯৭৩-১৯৭৪ সালের জন্য লায়ন এম আর সিদ্দিকী উরংঃৎরপঃ ৩১৫ ইধহমষধফবংয-এর গভর্নর মনোনীত হন। চারবার লায়ন্সের গভর্নর মনোনীত হওয়া সম্ভবত লায়ন্স ক্লাবের জন্য এটি একটি রেকর্ড।
এম আর সিদ্দিকী শিক্ষার প্রসারেও অবদান রাখেন; বিশেষ করে সীতাকুণ্ড-মিরসরাই এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় তাঁর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণযোগ্য। মিসরাই-সীতাকুণ্ড’র দুই আদি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিজামপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজ ও সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজ গোড়াপত্তনে এম আর সিদ্দিকী পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে শিক্ষা অনুরাগের পরিচয় দিয়েছিলেন। সীতাকুণ্ড’র মধ্যাংশে মছজিদ্দায় প্রতিষ্ঠা করেন লতিফা সিদ্দিকী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৭৩) এবং লতিফা সিদ্দিকী বালিকা মহাবিদ্যালয় (১৯৮৫), কলেজটিতে ২০০৩ সালে সহশিক্ষা প্রবর্তন করায় বর্তমান নাম ‘লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ’। যতদিন বিশ্বে বাংলাদেশ নামে একটা রাষ্ট্র থাকবে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস আলোচিত হবে, শিক্ষাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের কথা বলা হবে ততদিন বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের ও মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী, বাংলাদেশে লায়নিজমের জনক, লব্ধ প্রতিষ্ঠ শিল্পোদ্যোক্তা, প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, সমাজহিতৈষী, বিদ্যোৎসাহী, বিদ্বজ্জন এম আর সিদ্দিকী স্মরিত হবেন- ২৯ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।
লেখক: অধ্যক্ষ, লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ; প্রাবন্ধিক।