মানুষের একটি সুপ্ত বাসনা থাকে সর্বোচ্চ উঁচু জায়গা থেকে পৃথিবীকে নিজের চোখ দিয়ে দেখার। এভারেস্ট ও লোৎসের চূড়া থেকে দেখা নিচের পৃথিবীর দৃশ্য এ জীবদ্দশায় ভুলে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বাবর আলী। গতকাল বুধবার সকালে নগরীর চকবাজারে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলনে এভারেস্ট ও লোৎসে জয়ের রোমাঞ্চকর অভিযানের অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বাবর আলী এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, এভারেস্টের চূড়ায় আমি এক ঘণ্টা ১০ মিনিট ছিলাম। প্রথমেই উড়িয়েছি আমার দেশের লাল সবুজ পতাকা। তিব্বতের সাইড দেখে খুব ভালো লেগেছে। এভারেস্ট জয়ের পর নেমে আসার সময় তুষার ঝড়ে দেড় ঘণ্টা আটকে ছিলাম। পরে কোনো ঝামেলা ছাড়াই ক্যাম্পে নেমে আসতে পেরেছি।
তিনি বলেন, এভারেস্টে যাওয়ার চেয়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ পৃষ্ঠপোষকতা। প্রথম আমি স্পন্সর ও মানুষের সহযোগিতা নিয়ে কোনো মাউন্ট অভিযানে গিয়েছি। সবার সহযোগিতা পেয়েছি বলেই এভারেস্ট জয় করতে পেরেছি। পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশের অনেক তরুণ এভারেস্ট জয় করতে পারবে। তিনি আরও বলেন, আবার এমন অনেক পাহাড় আছে যেগুলোতে এখনও কেউ যায়নি সেগুলোতে যেতে চাই। নেপালের অন্নপূর্ণা মাউন্টে যাব সামনে। বাবর আলী বলেন, আমার দুই মাসের অভিযান ছিল এটি। আজ এভারেস্ট ডে। ১৯২৪ সালে জর্জ মেলোরির মহাকাব্যিক অভিযান ছিল। একশ বছর পর আমি এভারেস্ট আরোহণ করতে পেরেছি। তার মতে এভারেস্ট সামিট করার ক্ষেত্রে আবহাওয়া বড় ফ্যাক্টর। বাংলাদেশের একজন আবহাওয়াবিদ তাকে দারুণ সহযোগিতা করেছেন।
বাবর আলী বলেন, গত ১০ এপ্রিল বেস ক্যাম্পে পৌঁছি। কুমু আইসফলের (বরফের প্রপাত) রাস্তা তখনো ওপেন হয়নি। এ সড়কটি অ্যালুমিনিয়াম সিঁড়ি দিয়ে পার হতে হয়। প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। নেপালের একজন পর্বতারোহী আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করতে হয়েছিল। ক্যাম্পের তিন থেকে চার নম্বর রাস্তা অনেক চ্যালেঞ্জিং। জীবনে প্রথম কৃত্রিম অঙিজেন ব্যবহার করেছি। ডাক্তারি পড়ার সময় প্রেসক্রিপশনে রোগীদের অঙিজেনের মাত্রা কত নেবে সেটা লিখতাম। এখন নিজেকেই সেটা ব্যবহার করতে হয়েছে। তবে অঙিজেন সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও চেষ্টা করেছি অভিযানে যতটা সম্ভব কম কৃত্রিম অঙিজেন নিতে। তিনি স্বপ্ন দেখেন আগামীতে অঙিজেন সহায়তা ছাড়াই কোনো আট হাজারী শৃঙ্গ আরোহণ করা।
বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তন দেখার অন্যতম জায়গা হিমালয় জানিয়ে বাবর আলী বলেন, কেউ যদি গ্লোবাল ওয়ার্মিং দেখতে চায় তাকে হিমালয় যেতে হবে। হিমালয়ে প্রচুর সুন্দর লেক। এগুলো কেন সৃষ্টি হচ্ছে? দেখার চোখ থাকলে অনেক কিছু আছে। দুই হাজার মিটারের গাছ আরও উপরে গেলে ঝোঁপ হয়ে যায়। কিন্তু শেকড় মোটা। তিনি বলেন, শরীর উচ্চতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য উপরে পৌঁছে নিচে নেমে ঘুমাতাম।
এভারেস্টে খাবারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেস ক্যাম্প পর্যন্ত নরমাল খাবার। ডাল–ভাত খাওয়া যায়। এরপর যত উপরে উঠবেন বরফ গলিয়ে পানি ফোটাতে হবে। তারপর সেই পানি দিয়ে যেসব খাবার রান্না করে খাওয়া যায় সেগুলো খেতে হয়। আমরা নুডলস, স্যুপ এগুলোই খেয়েছি। তিনি জানান, এভারেস্টে অনেক মরদেহ দেখেছি। এর মধ্যে অনেক ইকুইপমেন্ট নতুন, তারা মারা গেছে বেশিদিন হয়নি।
শিগগির চাকরিতে যোগ দেবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ডাক্তারি ছাড়া তো আর কিছু পারি না। তাই চাকরি নিতে হবে। সঞ্চয় দিয়ে পর্বতারোহণের নেশা পূরণ করতাম।
এর আগে, এভারেস্ট চূড়ায় উঠে বাবর আলী বাংলাদেশের যে পতাকা উড়িয়েছিলেন সেটা তার ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের হাতে তুলে দেন।
সংবাদ সম্মেলনে এভারেস্ট অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফারহান জামান বলেন, পুরো অভিযানে বাবর আলীর শুধুমাত্র পর্বতারোহণ অভিযানে মোট খরচ হয়েছে প্রায় ৪৫ লাখ টাকার মতো। যার একটি বড় পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে। বাংলাদেশে বাবর আলীই প্রথম যিনি ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে এভারেস্ট জয় করেছেন। তিনি আরও বলেন, আমরা বিশ্বাস করি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে প্রতিটি ঘরে ঘরে বাবর আলী জন্ম নেবে। ক্রাউড ফান্ডিংয়ে আমরা বিকাশে ২৫ টাকা পর্যন্ত সহায়তা পেয়েছি। বাবর একা এভারেস্টে ওঠেনি। যারা যারা তাকে সহযোগিতা করেছে, তার পাশে থেকে সাহস দিয়েছে সবাইকে নিয়েই সে এভারেস্টের চূড়া জয় করেছে।