চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রধান দপ্তর টাইগারপাসের অস্থায়ী কার্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল গত বছরের ২০ জুন। তখন বলা হয়েছিল, আন্দরকিল্লাহস্থ পুরাতন ভবনটি ভেঙে সেখানে আধুনিক নগর ভবন নির্মাণ করা হবে। আজ তার ১৬ মাস পূর্ণ হয়েছে। অথচ এখনো নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদনই হয়নি। এমনকি সম্ভাব্যতা যাচাইও হয়নি। অবশ্য গত বছরের ডিসেম্বর মাসে একবার আন্দরকিল্লার নগর ভবন ভেঙে নিলামে বিক্রির উদ্যোগও নেয়া হয়েছিল। সেটিও থমকে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আধুনিক নগর ভবন নির্মাণে চসিকের তিনজন মেয়র উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এরা হলেন আ.জ.ম নাছির উদ্দীন (২০১৫-২০২০), মোহাম্মদ মনজুর আলম (২০১০-২০১৫) এবং প্রয়াত এবিএম মহিউদ্দীন চৌধুরী (১৯৯৪-২০১০)। আন্তরিকতার কমতিও ছিল না তাদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজ মেয়াদে প্রকল্প বাস্তুবায়ন করে যেতে পারেননি তারা। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, নগর ভবন আদৌ হবে তো?
চসিকের প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত ১২ মার্চ প্রি-একনেক সভায় ২২৯ কোটি ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকায় নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন হয়। তবে ওই সভায় ফিজিবিলিটি স্টাডি রির্পোট বা সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদনসহ প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনা (ডিপিপি) সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। একইসঙ্গে প্রকল্পে ব্যয়ের খাতগুলোর প্রাক্কলন গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন প্রস্তুত হয়নি।
এ বিষয়ে চসিকের এক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই প্রায় শেষ পর্যায়ে। দুয়েকদিনের মধ্যে প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। এরপর প্রতিবেদনের আলোকে ডিপিপি সংশোধনে আরো দুয়েকদিন সময় লাগবে। সময় মিলিয়ে আগামী সপ্তাহেই সংশোধিত ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা যেতে পারে। এ বিষয়ে চসিকের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে কিছু ফাইন্ডিং দেয়া হয়েছে। সেগুলো ঠিকঠাক করে প্রকল্পটি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব। প্রকল্পটি নিয়ে মন্ত্রণালয়ে কথা হয়েছে। মন্ত্রীসহ সবাই নগর নির্মাণে একমত। এই মাসের শেষে ঢাকা যাব। তখন এ বিষয়ে কথা বলব।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রশাসক বলেন, যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা প্রপারলি ফাইল ডেভেলাপ করেনি। সেজন্য একটু লেট হয়েছে। তবে আমি আশাবাদী। নগর ভবন হওয়া উচিত। আগামী দিনের চট্টগ্রামের যে চাহিদা সে কারণে হলেও প্রয়োজন নগর ভবন। তিনি বলেন, আন্দরকিল্লায় যে ভবন ফেলে আসছি সেখানে আরো ২০/৩০ বছর থাকা যেত। এখন তো আমরা বস্তিবাসীর জন্য নির্মিত ঘরে আছি।
তিন মেয়রের চেষ্টা ছিল : প্রি-একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্পটি গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন। গত বছরের মার্চ মাসে ২০২ কোটি ২৪ লাখ টাকায় প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। পরবর্তীতে গত ২৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত প্রকল্প পর্যালোচনা সভায় (আইপিইসি) প্রকল্পটি অনুমোদন দেয়া হয়। তবে প্রকল্পের কিছু অঙ্গে সংশোধনের নির্দেশনা দেয়া হয়। সে আলোকে একই বছরের ১৯ ডিসেম্বর প্রকল্পটি সংশোধন করে মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে চসিক। এতে প্রকল্প ব্যয় ২৭ কোটি ২০ লাখ ৮৫ হাজার টাকা বেড়ে প্রকল্পের আকার হয় ২২৯ কোটি ৪৪ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। অবশ্য এর আগে আরো দুইবার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল আ.জ.ম নাছিরের মেয়াদকালে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ৭৪ কোটি টাকায় ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করে। ২০১৭ সালে ডিপিপি সংশোধন করা হয় ১২০ কোটি টাকায়। তখন ভবন নির্মাণে জনতা ব্যাংকের কাছ থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণও চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু এতে আপত্তি জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। ফলে সৃষ্টি হয় অর্থ সংস্থানের জটিলতা। একারণেই প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সভা থেকে প্রকল্পটি বাদ পড়ে।
এ বিষয়ে সাবেক সিটি মেয়র আ.জ.ম নাছির উদ্দীন দৈনিক আজাদীকে বলেন, দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই চেষ্টা করেছি নগর ভবন নির্মাণে। বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও অর্থ সংস্থান না হওয়ায় করতে পারিনি। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে এবং চীনের সহায়তায়ও করতে চেয়েছি। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে এবং তাদের ম্যানেজ করে ডিপিপি প্রস্তুত করি। সেটা প্রি-একনেকও হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি না হলে এতদিনে একনেকও হয়ে যেত। তিনি বলেন, নগর ভবন অপরিহার্য। বর্তমানে টাইগারপাসে কার্যক্রম চলছে সেখানে সবার জায়গার সংকুলান হচ্ছে না। আশা করছি নগর ভবন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন হবে। যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের জন্য আন্তরিক সমস্যা হবে না।
জানা গেছে, নগর ভবন নির্মাণে প্রথম উদ্যোগটা নিয়েছিলেন প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীন চৌধুরী। ২০১০ সালের ১১ মার্চ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়ায় শুরু হয়েছিল এ নির্মাণ কাজ। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ জে কনস্ট্রাকশন নগর ভবনের প্রথম ছয়তলা নির্মাণের কাজ পেয়েছিল ওই সময়। ওই সময় চসিকের নিজস্ব তহবিল থেকে নগর ভবনের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৮ কোটি ৮৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ২০১০ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত চসিক নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরী পরাজিত হলে নগর ভবন নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মোহাম্মদ মনজুর আলম মেয়রের দায়িত্ব পালনকালে ২০১১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নগর ভবন নির্মাণে অনুমোদন দেয়। এরপর বিভিন্ন জটিলতায় প্রায় তিন বছর কাজ বন্ধ থাকে। ২০১৪ সালে পুনরায় কাজ শুরু হয়। কিছুদিন যেতেই অর্থাভাবে আবারও কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, ১৮৬৩ ও ১৯৬৪ সালে নির্মিত পৃথক দুটি পৌরভবনে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। এরমধ্যে ১৮৬৩ সালে নির্মিত ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় ২০০৯ সালে ভেঙে ফেলা হয়েছে। সেখানেই মহিউদ্দীন চৌধুরী নতুন ভবন নির্মাণে ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ১৯৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পৌরভবনটি এখনো রয়েছে। ভবনটিতে বর্তমানের চসিকের জনসংযোগ শাখার অফিস রয়েছে।
নগর ভবনের সামনে থাকবে ফুলের বাগান : অনুমোদনের অপেক্ষায় থাকা নগর ভবনটি হবে ২৩ তলা বিশিষ্ট। দুইটি বেইজমেন্ট ফাউন্ডেশনসহ তিনটি পার্কিং থাকবে এবং এর দুইটি হবে আন্ডারগ্রাউন্ডে। প্রকল্পের প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী এটি হবে ‘আইকনিক’ ভবন। ভবনের ওপরে থাকবে সিটি ক্লক। ভবনের তিনপাশে সাজানো বাগান থাকবে। ভবনের কয়েকটি ফ্লোর বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেয়া হবে। থাকবে মাল্টিপারপাস হল, কনফারেন্স হল ও ব্যাংকুয়েট হল। যে স্থানে ‘নগর ভবন’ নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে মোট ভূমির পরিমাণ ৩৩ দশমিক ৮১ গণ্ডা। বা ২৯ হাজার ২১১ দশমিক ৮৪ স্কয়ার ফুট। মোট ভূমির ৬৭ শতাংশ ব্যবহার হবে ভবন নির্মাণে এবং সবুজকে প্রাধান্য দিয়ে বাকি ৩৩ শতাংশ খালি রাখা হবে। উন্মুক্ত এ অংশে সবুজায়ন করা হবে এবং সেখানেই বৃক্ষরোপণ করা হবে। করা হবে ফুলের বাগান। ভবনের তিনপাশেই বাগান করার পরিকল্পনা আছে। নির্মাণ করা হবে ফোয়ারা।