শিক্ষা নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষা চলছেই। আগের পরীক্ষাপদ্ধতি বাদ সহ বেশ কিছু পরিবর্তন এনে গত শিক্ষাবর্ষ থেকে বাংলাদেশে নতুন যে কারিকুলাম চালু হয়েছে, তা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে দেশে। শিক্ষক ও অভিভাবকরা নতুন ওই কারিকুলাম নিয়ে উদ্বেগের কথা জানালেও সরকার বলেছিল, নতুন বিধায় এটি বুঝতে সময় লাগছে। শিক্ষকদের অনেকে বলেছেন, নতুন এ পদ্ধতি বোঝার জন্য যে প্রশিক্ষণ দরকার তা সঠিকভাবে দেয়া হয়নি। এর ফলে পাঠ্যক্রম ও মূল্যায়ন নিয়ে শিক্ষক–শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সবাই আছে অন্ধকারের মধ্যে। অন্যদিকে নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি পুরোপুরি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্তের পর এ নিয়ে আপত্তি তোলেন অভিভাবকরা। এ ক্ষেত্রেও সরকার বলেছে, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ হিসেবে প্রস্তুত করতে এই উদ্যোগ তাদের।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আমরা মুখস্ত করার প্রতিযোগিতা থেকে বেরিয়ে এসে এক দক্ষ প্রজন্ম গড়ে তুলতে এই শিক্ষাক্রম চালু করেছি। কিন্তু এটি নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বেশি আসছে শহুরে বাবা–মায়েদের কাছ থেকে। সবাই এর বিরোধিতা করছে না।” কিন্তু দফায় দফায় কারিকুলামে এরকম পরিবর্তনের ফলে শিক্ষার ওপর, শিক্ষার্থীদের ওপর ভীষণ প্রভাব পড়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমের যেসব বিষয় নিয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মূল্যায়ন পদ্ধতি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের বেশ কিছু দেশের আদলে সাজানো হয়েছিল নতুন শিক্ষাব্যবস্থাকে। এতে পাঠ্যবই, পাঠদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আনা হয়েছে আমূল পরিবর্তন। এই শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক শিখনকালীন মূল্যায়ন। অর্থাৎ সারা বছর শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করার কথা বলা হয়েছে। এ কারণে আগের মতো পরীক্ষা হচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণির আগের সব পাবলিক পরীক্ষা তুলে দেয়া হয়। পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত হয় এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায়।
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে অভিভাবকদের একটি অংশ মূল্যায়নে লিখিত পরীক্ষা রাখার দাবি জানিয়ে এসেছেন শুরু থেকে। গত বছর মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করা হয়। এ আন্দোলন থেমে নেই। করোনাকালে সীমাহীন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত। আবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাব পড়েছে এই শিক্ষা খাতে।
শিক্ষা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, ঘন ঘন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনে জাতীয় মেরুদণ্ড দুর্বল হচ্ছে। তাদের দাবি, শিক্ষার্থীদের ডিভাইসমুখী হতে উৎসাহিত না করে বরং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করা চাই। এ দাবি যে অত্যন্ত যুক্তিসংগত– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। জ্ঞান মানুষকে দক্ষ করে, কিন্তু জ্ঞান তো ভাসমান তথ্য বৈ নয়, তার অভ্যন্তরে যদি তত্ত্ব না থাকে আর ডিভাইসমুখী করে স্মার্ট করা যাবে, শিক্ষিত করা যাবে না। শিক্ষাবিদ ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘তাতে হবে শিক্ষার্থীকে যান্ত্রিক ও চালিয়াত করারই নামান্তর। চালিয়াত আর দক্ষ এক জিনিস নয়। আর এটাও তো এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত সত্য স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার মানুষের বিষণ্নতা বৃদ্ধি করে চলেছে। সূচনাকাল থেকেই শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী কী শিখল, কতটা শিখল তা নয়; কেমন ‘ফল’ করল, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটাকেই করে তোলা হয়েছিল মূল্যবান। নতুন শিক্ষাক্রমেও মূল্যায়ন গুরুত্ব পাবে। তবে সেটা নাকি ঘটবে ভিন্নভাবে। নম্বর থাকবে না, গ্রেডও উঠে যাবে; ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ দিয়ে নাকি মূল্য জ্ঞাপন করা হবে। বিজ্ঞান শিক্ষা সংকুচিত হলেও জ্যামিতিরই দোকানদারি বেশ দাপটে থাকবে, বোঝা যাচ্ছে।’ অন্যদিকে, সাম্প্রতিক পরিস্থিতি অবলোকন করে টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব তাঁর এক প্রবন্ধে বলেছেন, শিক্ষাকে ক্লাসরুমে ফেরাতে হবে। ক্লাসরুমে শিক্ষাকে ফেরানোর এ কাজ মহাযজ্ঞ। এর প্রধানতম একটা হাতিয়ার হবে ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’। ক্লাসরুমে সফটওয়্যারভিত্তিক শিক্ষা (লার্নিং সফটওয়্যার), টিচারদের ট্রেনিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে লার্নিং অ্যান্ড সার্টিফিকেশন সফটওয়্যার, স্কুল ও ক্লাসের প্রশাসনিক কাজের সফটওয়্যার ইত্যাদি সবকিছুর জন্য, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম বুকিং–ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের অনেক সফটওয়্যার ফুটপ্রিন্ট তৈরি করতে হবে।
নিয়োগ ও বদলি–বাণিজ্য থামাতেও কর্মদক্ষতা অনুসারে নিয়োগ, সঠিক লোককে সঠিক জায়গায় বসানো এবং চাহিদা অনুযায়ী নিয়োগ বা বদলিকে সফটওয়্যারভিত্তিক ব্যবস্থাপনায় এনে অটোমেশন করা যায়। এতে ঘুষের চক্রে বাধা দেওয়া যাবে। এমনকি কলেজগুলোয় পুরোনো কোর্স ও আসন কমিয়ে কর্মদক্ষতার জন্য যুব ট্রেনিং, বিদেশমুখী শ্রমবাজারের উপযোগী অনলাইন কোর্স, সফটওয়্যার লার্নিংকেন্দ্রিক ক্লাসরুম কোর্স খোলা যেতে পারে।
শিক্ষাবিদরা বলেন, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা থাকলে যে কোনো আর্থিক সংকট আমরা কাটাতে পারবো, আইন–শৃঙ্খলা ফেরাতে পারবো, কিন্তু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া শিক্ষাকে যদি সংস্কার করা না যায়, তাহলে সর্বনাশ ঠেকানো কষ্ট হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে জাতীয় স্বার্থেই।