উনিশ শতকের নবজাগরণ বাংলার ইতিহাসে এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। বাঙালি জীবন ও সমাজ সুদীর্ঘকাল ধরে অশিক্ষা, কুশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার এবং কুপ্রথা এমনকি পুরুষতান্ত্রিকতার নির্মম মোড়কে বন্দি ছিল। ব্যক্তি-মানুষের স্বপ্ন-স্বাধীনতা , ইচ্ছার প্রতিফলন মধ্যযুগীয় সমাজ-ব্যবস্থায় উপেক্ষিত ছিল। সমাজ ও সামষ্টিক দৃষ্টিভঙ্গিই মানব-ভাগ্য নির্ধারণ করতো। মানুষের জীবনের আদৌ কোনও মূল্য ছিল না। ‘সতীদাহ’ উচ্ছেদ-আন্দোলন, ‘বিধবা বিবাহ’ প্রচলনের আন্দোলন অন্তত বাঙালি নারী-জীবনের অবর্ণনীয়, দুঃসহ এবং করুণ বাস্তবতারই স্বাক্ষরবাহী। সামাজিক এবং ধর্মীয় সংস্কার মানুষের জীবনকে নারকীয় করে তুলেছিল। অন্ধকারাচ্ছন্ন সেই সমাজ-ইতিহাসে খানিকটা আলোর ঝলকানি ছড়াতে সক্ষম হয়েছিল ইংরেজরাই। প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ-শাসন আমাদের আর্থ-সামাজিক-রাজনেতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে চরমভাবে শোষণ-লুণ্ঠন করেছে সত্যি; কিন্তু আমাদের শাপে বর হয়েছে একটি জায়গায়। সেটি হলো- ইংরেজ আমলে শিক্ষার-প্রসার এবং প্রচলন। ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ প্রতিষ্ঠা, ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর আবির্ভাব, কতিপয় ইংরেজের নারী-শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ, রাজা রামমোহন রায়ের ধর্ম-সংস্কার, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো মানবহিতৈষীর সমাজ-সংস্কার ও শিক্ষা-বিস্তারে অগ্রপথিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, মাইকেল মধুসূদনের সাহিত্য-সংস্কারের চেতনা নবজাগরণকালের অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এর পরের ধাপেই আমরা পাই বাঙালির ‘জীবনবৃক্ষ’ রবীন্দ্রনাথকে। ‘রেনেসাঁস’ মানে পুনর্জাগরণ। কিন্তু পাশ্চাত্য-প্রভাবিত রেনেসাঁসকে বাঙালি সমাজ ‘নবজাগরণ’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমন চিন্তার মূলে হয়তো এই ভাবনা কাজ করেছিল যে- ভারতবর্ষীয় বাঙালি সমাজে কোনোদিনই আলো ছিল না! কিংবা কোনও কালে জাগরণ ঘটে থাকলেও সেটি ইউরোপীয় বা পাশ্চাত্য প্রভাবিত ছিল না। তা নিয়ে অন্যত্র বিতর্কের অবকাশ রইলো। বর্তমান প্রবন্ধে রেনেসাঁসের মৌল প্রেরণা এবং লালন ফকিরের চিন্তা-দর্শনের ভাবকেন্দ্র নির্ধারণ, এই ভাবনার তাৎপর্য নিরূপণ এবং চিন্তা-সূত্র দুটোর সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য সংক্ষিপ্ত তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছি।
রেনেসাঁসের প্রভাবে চেতনাগতভাবে পেয়েছি জাতীয়তাবোধ, স্বদেশপ্রেম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, মানবমহিমা। ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথা এবং আচারের বাইরে মানুষ মহীয়ান হবার দৃষ্টিভঙ্গি মধ্যবিত্ত বাঙালি শিক্ষিত সমাজ প্রথম লাভ করলো রেনেসাঁসের প্রভাবেই। মানুষ, মানবমহিমা সর্বোপরি মানবমুক্তিই রেনেসাঁসের মূলমন্ত্র- সন্দেহ নেই। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, দেবেন্দ্রনাথ, ,অক্ষয়কুমার দত্ত, ইয়ং বেঙ্গল-গোষ্ঠী নিশ্চয়ই পাশ্চাত্য-দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য-শিল্পকলা প্রভৃতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজ-সংস্কার ও মানবমুক্তির প্রেরণা গ্রহণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে মানবমহিমা প্রতিষ্ঠা এবং মানবমুক্তিই আমাদের আরাধ্য। বাঙালি সমাজ চিরকাল এই সব মহারথীদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। কিন্তু প্রশ্ন অন্য স্থলে। ঔপনিবেশিক আমলে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে শিক্ষা-ব্যবস্থার চির-বিচ্ছেদ রচিত হয়। অর্থাৎ বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত লোকায়ত সমাজ ও সংস্কৃতি হতে আলগা হতে থাকে। ১৮০০ সাল পর্যন্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের বিষয় ও প্রবণতা বিশ্লেষণ করলে তা সহজেই টের পাওয়া যাবে। এই অমোঘ সত্যটিকে গ্রহণ করে যদি আমরা লালন সাঁইজির তত্ত্ব-দর্শনের ভাবকেন্দ্রটিকে বিশ্লেষণে প্রয়াসী হই তাহলে দেখবো- লালনের মানুষ/ মানবমহিমা/ মানবমুক্তি ভাবনা বহিরাগত প্রভাবজাত নয়। তা একান্তই হাজার বছরের ঐতিহ্য-লালিত সহজিয়া সাধনার ভারতবর্ষীয় ভিত্তিভূমির উপর প্রতিস্থাপিত। লালনের পূর্বেই বাউল-দর্শনের উন্মেষ ঘটলেও লালনের হাতেই বাউল-দর্শন একটি পূর্ণাঙ্গ এবং পরিণত রূপ লাভ করে। লালনের চেতনাজুড়ে এবং সাধন-ভজনের কেন্দ্রসুর হলো মানুষ, মানবমহিমা এবং মানবমুক্তি। তা তাঁর বস্তুবাদী দর্শন এবং অধ্যাত্মবাদী দর্শনেরও অভীষ্ট প্রেরণা। রাজা রামমোহন রায়কে রেনেসাঁসের বরপুত্র বলা হয়। কলকাতা-কেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সীমিত এই নবজাগরণকে বাংলার সর্বব্যাপী রেনেসাঁস বা নবজাগরণ বলা চলে না। কারণ এই নবজাগরণের প্রভাব কলকাতা নগরের বাইরে অবস্থিত বৃহৎ লোকসমাজে জাগরণ ঘটাতে সক্ষম হয়নি। এই নবজাগরণকালে লালন সাঁইয়ের মতো আত্মজ্ঞানী একজন সাধক লোকায়ত সমাজে আত্মদর্শনলাভ, মানবতার বাণী প্রচার তথা মানুষের সামূহিক মুক্তির বার্তা ঘোষণা করেছিলেন। একতারা বাজিয়ে। গানে গানে। মানবতার এই বার্তা ভারতবর্ষের সীমা ছাড়িয়ে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। ঔপনিবেশিককালে সৃষ্ট এই মহান সাধকের গান গণমানুষের মধ্যে উদার-মানবিক চেতনা ও আত্মজ্ঞানের বীজ বপন করেছে। ‘মানুষই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু’ এই সারসত্য উদ্ভাসিত হয়েছে লালনের গানে। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করেন: ‘মানুষতত্ত্ব যার সত্য হয় মনে/ সেকি অন্য তত্ত্ব মানে।’ কিংবা ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি/ মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি।’ প্রভৃতি গানে মানুষকেই জীবন-সাধনার ভাবকেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। আশরাফ-আতরাফ, ধনী-গরীব, ব্রাহ্মণ-শুদ্র, ধর্মীয় বিভেদ, বর্ণভেদ বা জাতিভেদ কোনও সংস্কার এখানে ঠাঁই পায়নি। মানুষ ও সমাজের তৈরি জাতপাত-বর্ণভেদের আক্রমণে পিষ্ট-ভুক্তভোগী লালন। তাই মেকি এই জাতপাত-বর্ণভেদের বিরুদ্ধে সোচ্চার লালন কেবল জাতিভেদ-বর্ণভেদের অসারতা প্রমাণ করেননি; বরং মানুষের স্বতন্ত্র-সুউচ্চ মহিমারই জয়গান ঘোষণা করেন দৃপ্তকণ্ঠে। তিনি বলেন: ‘ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল চামার-মুচি/ একই জলে সব হয় গো শুচি/ দেখে শুনে হয় না রুচি/ যমে তা কাউকে ছাড়বে না।’ – এই গানের ভাবভাষ্য কেবল বর্ণভেদের ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না; বরং তা সকল প্রকার প্রথা ও সংস্কারের প্রাচীর ভেঙে সকল ধর্ম-জাতিকে, সকল মানুষকে সম-মর্যাদায় সমাসীন করেন। লালনের এই প্রেরণার মর্মমূলে রয়েছে ‘মানবপ্রেম।’ মানব অন্তরে একমাত্র প্রেমের জাগরণই সকল প্রকার প্রথা-সংস্কার ভাঙতে সক্ষম। প্রেম এমনই এক নিয়ামক শক্তি- যার জাদুস্পর্শে মানুষের মনোজগতে ইতিবাচক রূপান্তর সাধিত হয়। লালন হিন্দু না মুসলিম- এই বিতর্কের জবাব নিজেই দিয়েছেন এভাবে: ‘সবে বলে লালন ফকির হিন্দু না যবন/ লালন বলে আমার আমি না জানি সন্ধান।’ লালনের এই ভাবনা আমাদের চকিতে স্মরণ করিয়ে দেয় নজরুলের অমোঘ পঙ্ক্তির কথা: ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম এই জিজ্ঞাসে কোন জন হে/ কাণ্ডারি বল ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা’র।’- উল্লিখিত ভাবাদর্শে লালন এবং নজরুলের ভাবকেন্দ্র ‘মানুষ’। লালনের গানটিতে বরং সম্প্রসারিত আত্মদর্শনের প্রেরণা উৎসারিত হয়েছে। এই আত্মপ্রেরণা লালন কোথা হতে পেলেন! এই প্রেরণা বাইরের কোনও প্রেরণা নয়। স্বদেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের শেকড় হতেই লালন তা অর্জন করতে এবং এর বিন্তার ঘটাতে সক্ষম হন। ‘চড়ংঃ ঈড়ষড়হরধষ উরংপড়ঁৎংব্থ মতবাদের আলোকে আমরা লালনের স্বতন্ত্র এবং মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিরূপণ করতে পারি। রবীন্দ্রনাথের মতো বাঙালি মনীষা লালনের চিন্তা-দর্শনকে সকলের আগেই অব্যর্থরূপে গুরুত্ব দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় লালনের ২০টি গান প্রকাশ করেন এবং বাউল গান সংগ্রহ ও প্রকাশ সম্পর্কে উৎসাহিত করেন। বলা যায়, রবীন্দ্রনাথই প্রথম বাউলদের সম্পর্কে গুরুত্ব অনুধাবন করেন এবং শিক্ষিত মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সচেষ্ট হন। তবে বাউল-দর্শনকে রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো করে গ্রহণ করেছেন, বাউলতত্ত্ব হিসেবে নয়। বাউলতত্ত্বের বস্তুবাদী সাধনা বাদ দিয়ে তিনি এর মানবতাবাদী ও অধ্যাত্মবাদী প্রবণতাটুকুকে গ্রহণ করেছিলেন। বাউলের ‘মনের মানুষের’ অনুসন্ধান-অনুসন্ধিৎসাই পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্ট কবিতা-গানে-নাটকে উপন্যাসে বিচিত্র তাৎপর্যে চিত্রিত হয়েছে। পূর্ববঙ্গের বাউল গান বিশেষ করে লালনের গানের বাণী ও সুর, তত্ত্ব-দর্শন তাঁকে রূপান্তরিত করতে সমর্থ হয়েছিল। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয় না সরাসরি। রবীন্দ্রসহোদর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালন সাঁইয়ের সাক্ষাৎ হয়েছিল। লালনের যে স্কেচটি আদি- সেটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা। শিলাইদহে বসবাস কালে জনৈক লালন-শিষ্যের নিকট থেকে লালনের গানের খাতা নিয়ে তিনি তাঁর কর্মচারী দিয়ে লালনের গানের কপি তৈরি করেছিলেন। তিনি লালন সাঁইয়ের ২৯৮টি গান সংগ্রহ করেছিলেন। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সংগ্রাহকের ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন কয়েক বছর। ইংল্যান্ডের হিবার্ট বক্তৃতায়ও লালন, হাসন প্রমুখ মহাজনের গানের মর্মবাণী নিয়ে অলোচনা করেছেন তিনি। লালন তাঁকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছিল সন্দেহ নেই। এটিও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রবীন্দ্রনাথের কল্যাণেই সুধী মহলে লালন-চর্চা গৌরবের সঙ্গে যাত্রা শুরু করে।
সমকালীন নয়া বিশ্বব্যবস্থার রাহুগ্রাসে যেনো জিম্মি আজ পৃথিবী। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা নয়া ঔপনিবেশিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের নানামাত্রিক আচরণে বিপন্ন একাল, এসময়। রাজনীতি এবং ধর্মের যুগপৎ থাবায় অস্থির সমাজ-জীবন। ধর্মের আচার-যজ্ঞের প্রাবল্যে ম্রিয়মাণ ধর্মের অধ্যাত্মবাদী দিক। সময় যেনো সর্বগ্রাসী কুটিল-জটিলাবর্তে মানুষকে ক্রমাগত যন্ত্রমানবে পরিণত করছে। প্রাণহীন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে মানুষ। সম্পদের প্রাচুর্যে চাকচিক্যময় চারপাশ; কিন্তু স্বস্তি বা শান্তির হাওয়া উধাও। প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের এই মোহনীয় সময়ে মোবাইল-ইন্টারনেটে আচ্ছন্ন তরুণ প্রজন্ম আজ প্রায় শেকড়চ্যূত। আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির প্রভাব প্লাবনের জলের মতো সবকিছুকে মূল জায়গা থেকে বানভাসিতে পরিণত করছে। ভাসছে সংস্কৃতি। ভাসছে জাতিগত আপন-সত্তা। আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকট আজ সর্বব্যাপী। তা থেকে উত্তরণের জন্য লালনের উদার-অসাম্প্রদায়িক ভাবনা এবং মানবতাবাদী চেতনার প্রাসঙ্গিকতা ও শক্তিমত্তাকে নতুন করে উপলব্ধি করা ও গুরুত্ব দেয়ার বিকল্প নেই। সমকালীন সামাজিক-ধর্মীয়-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংকটের অভিঘাত দেখে সন্ত্রস্ত হই-শংকিত হই। সংকট মোচনের স্বপ্ন দেখি লালনের মানবতাবাদী ভাবাদর্শে। লালনের মতো আমাদেরও স্বপ্ন এবং আক্ষেপ ধ্বনিত হয়: ‘আত্মতত্ত্ব না জানিলে/ ভজন হবে না পড়বি গোলে।’/ ‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান/ জাতি গোত্র নাহি রবে।’ যত সংকট-সমস্যাই আসুক না কেন মানুষ তার শুভবুদ্ধির প্রেরণায় ঠিক মুক্তির পথ খুঁজে নেবে- এই তো লালনের দীক্ষা।
সহযোগী অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়