সারা পৃথিবী আজ নারীর ক্ষমতায়ন, নারী অধিকার ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে সোচ্চার। ভার্জিনিয়া উলফ এক মন্তব্যে বলেছিলেন ‘নারী সম্ভবত জগতের সবচেয়ে আলোচিত প্রাণী’। তার ইচ্ছে ছিল নারীর জন্য একটি নিজস্ব কক্ষ তৈরি করার। তাতে তিনি কতটুকু সফল হয়েছিলেন জানি না। তবে নারী এখন সর্বক্ষেত্রে দাপটের সাথে এগিয়ে চলেছে। ১৯৭০ সালে মার্কিন ডেমোক্রেটিক পার্টির জাতীয় অগ্রাধিকার কমিটির উদারনৈতিক সদস্য এডগার এফ বারম্যান বলেছিলেন, ‘হরমোন জনিত ভেদাভেদ রয়েছে বলেই সরকারের উচু পদে নারী আসীন হতে পারেন না’। কিন্তু একজন কর্মমুখী নারী কি সত্যি এ ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে পারে নি? অবশ্যই পেরেছে, তাই তার সে কথা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আজকাল তো অনেক নারীই আধুনিক শিল্প, উন্নত প্রযুক্তি, সৈনিক, পুলিশ, আইন পেশা, সাংবাদিকতা, ব্যাংকিংসহ শিক্ষকতা পেশায় দাবড়ে বেড়াচ্ছেন। আবার অনেকে তো রীতিমত বিদুষী হয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করতে প্রাণবন্ত ছুটে চলেছেন। ইন্দিরা গান্ধী, গোন্ডা মেয়ার, শেখ হাসিনা কিংবা খালেদা জিয়ার মত অনেক নারী হয়েছেন রাষ্ট্র প্রধান। ইতিহাসের পাতা ওল্টালেই এইসব যশস্বিনী নারীদের কর্মদক্ষতা সহজেই চোখে পড়ে। ‘৭০ এর দশকের আগে কর্মমুখী নারীর উপর তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা সমীক্ষা একেবারে হয়নি বললেই চলে। একজন কর্মমুখী নারী তো ব্যতিক্রমধর্মী কাজকর্মে হরহামেশা সমাজে অবদান রেখে চলেছেন। এটা কি সমাজের কখনও কারও অনুসরণীয় হতে পারে না? পুরুষ শাসিত সমাজই নারীকে বানিয়ে রেখেছে-মাতা, কন্যা, গৃহিণীর ভূমিকায় অর্থাৎ নারীকে সুকন্যা, সুমাতা, সুগৃহিণীরূপে দেখতে ভালোবাসেন তারা। পৃথিবীতে চিরকালীন তো কিছুই নয়। প্রথা থেকে বেরিয়ে এসে আজ নারীরা অবিশ্বাস্য রকমের সাড়া জাগিয়েছে। এভারেস্ট চূড়া? তাও জয় করে নিয়েছে নারী। কোথায় নেই নারীর বিচরণ। প্রথা ভাঙার এখন একমাত্র হাতিয়ার হচ্ছে নারী। মেরী ওলস্টোন ক্রাফট ১৭৯১-এ নারীর অধিকার আদায়ে দাবি তোলেন এবং লেখেন ভিন্ডিকেশন। বেগম রোকেয়া পিতৃতন্ত্রের কাছে মহয়ীসী, তিনি সাজিয়েছেন পুণ্যময়ীদের পংক্তি, যে কোনো প্রথাগত রমণীর জন্য এটা পরম পাওয়া। কারণ তিনি সবসময় দৃঢ়চিত্তে নারীর সাম্য চেয়েছেন। একবার পাহাড়তলী কলেজের সাবেক প্রিন্সিপ্যাল মরহুম সালমা চৌধুরী দৈনিক আজাদী অফিসে এলে আমাদের দেখে বলেছিলেন, যখন দেখি আর্মিতে মেয়েরা কাজ করছে আর ছেলেরা তাদের স্যালুড দিচ্ছে বা যখন দেখি মেয়েরা সাংবাদিকতা করছেন আর ছেলেরা তাদের স্যালুড দিচ্ছে তখন মনে হয় সমাজ এতদিনে মেয়েদের সম্মান দিতে শিখেছে। আমি প্রথম দিন। দৈনিক আজাদীতে এসে কাজ করার ইচ্ছে পোষণ করলে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ বলেছিলেন আমাদের মুসলমান মেয়েরা সাংবাদিকতা পেশায় আসতে চায় এটা খুব ভাল। দৈনিক আজাদীতে এসে প্রথম দিন, সাংবাদিক সিদ্দিক আহমেদের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। এটা আমার পরম সৌভাগ্য বলতে হবে। স্বাভাবিকভাবে আমি একটু নার্ভাস ছিলাম। তখন সিদ্দিক আহমেদ বলেছিলেন এখানে কেউ কাজ শিখে আসে না। আমিও আসিনি। উনার এই একটি কথা আমার ২১ বছরের সাংবাদিকতা জীবনের লম্বা জার্নিতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এবং প্রেরণা যুগিয়েছে। এখন আমরা বেশ গর্বের সাথে বলতে পারি এ ব্যাপারে অনেকখানি অগ্রসর আমাদের সমাজ। একজন নারী যখন পারিবারিক নিয়ম কানুন এবং সমাজের চাপের মোকাবেলা করতে পারে তার কাছে নিঃসন্দেহে বাইরের যে কোনো কাজের ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করা কঠিন কিছু নয়। এই ক্ষেত্রে চট্টগ্রামে বসবাসকারী নারীরাও পিছিয়ে নেই। এরকম কয়েকজন পেশাজীবী নারীর সাথে আমি কথা বলেছি।
এডিশনাল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ইশরাত রেজা ২০০৩ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন তিনি নিজেই তার অনুপ্রেরণা। নিজের ইচ্ছেতে এই পেশায় এসেছেন। তাঁর ইচ্ছে শক্তিই তাকে প্রতি মুহুর্তে এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগায়। তিনি কাজের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল। কারণ তাঁদের সব কাজই আইন অনুযায়ী চলে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে চলতে হয়। এক্ষেত্রে আইনকে প্রাধান্য দিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা হয়ে থাকে। তিনি বলেন, কাজ করতে গেলে বাধাতো আসবেই। বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়াই বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে আমার বৈশিষ্ট্য। আমি চন্দনাইশ স্বাধীনতা পরবর্তী প্রথম উপজেলা নির্বাহী অফিসার ছিলাম এবং সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। সরকার নারীর ক্ষমতায়নকে অনেক বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। যা আমাদের কাজের ক্ষেত্রে অতি মাত্রায় আগ্রহ যুগিয়ে যাচ্ছে। নুরজাহান খান নারী নেত্রী এবং ব্যাংকের উচ্চ পদে চাকরীও করেছেন। ব্যাংকে কাজ করতে গিয়ে বেশ স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন বলে জানান নুরজাহান খান। ১৯৬৯-৭০ সালে মেয়েদের জন্য আলাদা কোনো প্রক্ষালন না থাকায় মেয়েদেরকে ম্যানেজারের প্রক্ষালন কক্ষ ব্যবহার করতে হতো। তারা ৫ জন মেয়ে ঐ ব্রাঞ্চে কাজ করতেন। তখনতো কর্মমুখী মেয়ের সংখ্যা একেবারে কম ছিল। তাদের প্রতিষ্ঠানে একটি কমনরুম ছিল। সকাল ১১ টার দিকে সবাই মিলে সেখানে বসে নাশতা করতেন। এমনও দিন গেছে এক একদিন এক একজন বাসা থেকে নাশতা বানিয়ে আনতেন। সবাই আনন্দ করে খেতেন। দীর্ঘ চাকুরী জীবনে স্টাফ বা বস কেউই কোনো অসম্মানজনক আচরণ করেননি বলেও তিনি উল্লেখ করেন। জুন এবং ডিসেম্বরে ক্লোজিং ডে-তে রাত ১১টা-১২ টা কোনো কোনো সময় ২টা পর্যন্ত বেজে যেতো। কিন্তু অফিসের যিনি মূল কর্মকর্তা তিনি তার গাড়ি করে সকলকে বাসায় পৌঁছে দিতেন। শিল্পী নাজলী লায়লা মনসুর, কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন তিনি চারুকলায় মাস্টার্স করেছেন। পরীক্ষার পর বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে ১০-১২ বছর ছবি আঁকেননি। দু’সন্তানকে দেখভাল করতে গিয়ে দীর্ঘদিন ছবি আঁকা থেকে দূরে থাকতে হয়েছে। দীর্ঘদিন ছবি না আঁকার কারণে নতুন করে ছবি আঁকার ব্যাপারে যে ভয়-দ্বিধা কাজ করছিল বাচ্চাদের স্বাচ্ছন্দে ছবি আঁকা দেখে তিনি নতুনভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন সর্বক্ষণ। চারুকলা কলেজে দীর্ঘ ৩৩ বছর কাজ করেছেন। তিনি বলেন, সেখানে আমি অনেক রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি। যেমন আমার স্বপ্ন ছিল এটিকে একটি ভাল প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার। অনেক বিরোধিতা মোকাবেলা করেছি। প্রতিকূল অবস্থা পেরিয়ে এগিয়ে গেছি। চারুকলার প্রতি সমাজ, রাষ্ট্র বা মন্ত্রণালগুলোর তেমন আগ্রহ নেই। তারা এ বিষয়টিকে গুরুত্বপুর্ণ মনে করে না। সে কারণে যে কোনো বিষয়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সমস্যাগুলো সমাধান করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। নাজলী মনসুর বলেন, তবে কর্ম ক্ষেত্রে তিনি ভালই স্বাচ্ছন্দবোধ করতেন। দীর্ঘ বিরতিতে ছবি আঁকার চিন্তা মাথায় সব সময় কাজ করতো। কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে আঁকা হয়ে ওঠেনি। স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সবাই, সহকর্মী বন্ধু বান্ধবের উৎসাহে আমি ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বেশ প্রেরণা ও উৎসাহ পেয়েছি। অধ্যাপক ফেরদৌস আরা আলীমের সাথে কথা বলে জানা যায়, এ শহরের এক প্রান্তে একটি বেসরকারি কলেজে তিনি ছাত্র পড়িয়েছেন অনেকদিন। নারী বলে কোনও অসুবিধে হয়েছে বা কোনও সমস্যায় পড়েছেন বলে তার মনে পড়ে না। প্রথম দিকে ছাত্র-ছাত্রী হিসেবে যাদের পেয়েছিলেন। অবসর নেবার আগে তাদের কারও কারও পুত্র-কন্যাকেও পড়িয়েছেন। প্রজন্মের ফারাকটা ভালই বুঝেছেন বলে জানান তিনি। পুরুষ সহকর্মীদের বৈরী আরচণ কখনও পাননি আনন্দময় পরিবেশে কাজ করেছেন। আসলে শিক্ষকতা এমন একটা পেশা যেখানে পরিবেশটা আপনা থেকেই সুন্দর থাকে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিচিত্র পেশায় কাজ করছেন আজকের নারী। নারী ও পুরুষের মধ্যে সহজ সম্পর্কই নারীকে মানুষ হিসেবে গণ্য করার প্রথম ধাপ। অতিক্রান্ত হলে নারী মানুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত হতে পারে নারী ছড়িয়ে পড়তে পারে সবখানে। পেশাজীবী নারী মানে আত্মবিশ্বাসে দৃঢ় ও আত্মমর্যাদায় অধিষ্ঠিত নারী; এরা নির্যাতিত হয় না, হবে না। এক্ষেত্রে খুব প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে দেহমনের সম্পূর্ণ সমর্থন এবং ভালোবাসা ছাড়া কোনও পেশায় নারী ঝাপিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা আজকের নারী ঘরে বসেও ভোগ করতে পারেন। সুতরাং ভেবে চিন্তে পেশা নির্বাচন করা চাই। এডভোকেট রেহানা বেগম রানু বলেন, এই পেশায় তিনি দারুণ স্বাচ্ছন্দে আছেন। কেননা এই পেশা খুবই মর্যাদাবান। প্রতিটি অধিকারের বিষয়টি কিন্তু আইনকেন্দ্রিক। আর আইনের মতো পেশায় থাকার কারণে নির্যাতত, নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তার তা কিছুটা হলেও সফল হয়েছে বলে মনে করেন। টানা ১৫ বছর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকাকালে সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলরদের অধিকার সংরক্ষণে এলাকাবাসীর প্রতি দায়িত্ব বিশেষ করে নির্যাতিত নারীদের আইনি সহায়তা প্রদান, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অধিকার সংরক্ষণ, পরিবেশ আন্দোলন, জলাশয়-জলাধার রক্ষা, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ, পারিবারিক কাউন্সিলিংসহ নানান অধিকার সংরক্ষণের কাজ গতি পেয়েছে, সহজসাধ্য হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। প্রথাগতভাবে তিনি নারী আইনজীবী, পুরুষ আইনজীবী নন। বস্তৃত আইনজীবীই তার পরিচয়। নারী কিংবা পুরুষ হিসেবে নয়। তবে নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু আদালত প্রাঙ্গণে নয় কোথাও আজও পুরোপুরি গড়ে উঠেনি বলে তিনি মত দেন। তিনি বলেন, সহকর্মীদের সহযোগিতা পেয়েছি। যখনই প্রতিকূল পরিবেশ কিংবা পরিস্থিতি দেখেছেন সেটাকে অনুকূলে আনার চেষ্টা করেছেন। নিজেই নিজের কাজের প্রয়োজনে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে নিয়েছেন। নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে কখনও কখনও বাড়তি মানসিক যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়, সে সংকটও নিজের যোগ্যতা দিয়ে উত্তরণ করে নিয়েছেন। এই পেশায় শুধু অর্থ উপার্জন নয়, চেষ্টা করেছেন ভুক্তভোগীর অর্থ, সময় ও মানসিক নির্যাতন রোধের জন্য মামলায় উৎসাহিত করার চেয়ে কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে মামলা প্রতিরোধ করাও তাঁর অন্যতম কাজ বলে জানান তিনি। পরিশেষে উল্লেখ করতে হয় নারীর নিজস্ব জগৎ তৈরির পরিবেশ এখন বেশ অনুকূল। অবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে সকল পেশায় পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে কাজ করার জন্য।
লেখক : সহ-সম্পাদক, দৈনিক আজাদী










