একুশে পদক প্রাপ্ত একুশের প্রথম কবি ভাষা সৈনিক মাহবুব উল আলম চৌধুরী (কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’র রচয়িতা)। রাউজান থানাধীন গহিরা আসাদ চৌধুরী বাড়ির মাহবুব উল আলম চৌধুরী আমার নিকট আত্নীয়- আমার দাদু একজন অকৃত্রিম, সাহসী বন্ধু, স্বজন, প্রিয়জন, দুঃখ সুখের সাথী, অনুপ্রেরণার কান্ডারী, বিনয়ী, উদার, কোমল প্রাণ ছিলেন। তাঁর স্নেহধন্য অনেকের মাঝে আমিও একজন ছিলাম বলে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। তাঁর স্নেহের আধার যে কতখানি আমার জন্য ছিল, একান্ত সান্নিধ্যে গিয়ে তাঁর মুখে শুনেছি তাঁ দীর্ঘ গৌরবময় সংগ্রাম ও ইতিহাসের কথা। চল্লিশ দশকে তিনি ফ্যাসিবাদ ও দাঙ্গা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সাহিত্য ও রাজনীতির সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। সেই সময়ে এই বাংলায় একদল সংস্কৃতি কর্র্মী ও সাহিত্যিক মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে পুঁজি করে পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। মাহবুব উল আলম চৌধুরী এই পথে অগ্রসর না হয়ে বাঙালি জাতির নিজস্ব জাতি সত্তা গঠনের প্রত্যয়ে সাহিত্য পত্রিকা “সীমান্ত” প্রকাশ করে দুই বাংলার প্রগতিশীল লেখকদের লেখার মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করেছিলেন। একজন বড় মাপের সংগঠক, কবি হিসেবে তিনি সাহিত্য, সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে একই মেলবন্ধনে মিলিয়েছিলেন। আজীবন প্রগতিশীল রাজনীতির হাত ধরে হেঁটেছিলেন।
কিন্তু কখনো নিজের সৃষ্টিকে রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত করেননি। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের ছয় দশকের একটি অধ্যায় ছিল ১৯৭২-১৯৮২ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রামের দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন। এরপর তিনি ঢাকায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। তিনি ঢাকায় থাকলেও প্রায় সময় উনার বাসায় ছুটে যেতাম। ফোনে কথা হত নিয়মিত। মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে নিয়োজিত থাকার উৎসাহ দিতেন। তিনি কবিতা ভালবাসতেন, ফুল ভালবাসতেন, মানুষকে ভালবাসতেন। তিনি মানুষকে সত্যিকার অর্থে তাঁর কাছে শুধুই মানুষ- কোন ধর্ম বা শ্রেণিতে পড়ে না। তিনি মানুষের ভালবাসা পেয়েছেন সীমাহীন। মানুষকে সম্মান করা এবং অকাতরে ভালবাসতে পারা ছিল তাঁর চরিত্রের বিশেষ গুণ। মানুষকে ভালবাসলেও যে কত ভালবাসা পাওয়া যায়, সম্মান করলে যে কত সম্মান পাওয়া যায় তার দৃষ্টান্ত তিনি নিজে স্থাপন করে গেছেন। নিরহংকারী চরিত্রের এই বিশেষ গুণধর মানুষটিকে শেষ পর্যন্ত প্রদান করা হলো মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় একুশে পদক। আজীবন দৃঢ়চেতা ও সংগ্রামী এই কবি একুশের অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ, মুক্তিযোদ্ধের চেতনা ও আবহমান বাঙালির সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক ছিলেন। পাশাপাশি আরো গর্বিত রাউজান তথা চট্টগ্রামবাসী। তিনি গৌরবময় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। ৭ নভেম্বর তাঁর শুভ জন্মদিনে আমরা তাঁকে স্মরণ করছি গভীর কৃতজ্ঞতায়।