কীর্তিনাশা কিলভীতি
মাধ্যমিক স্তরে এখন অনেক বিকল্প বিষয় নেয়া যায়। একসময় যখন মাধ্যমিক এতগুলো বিভাগে বিভক্ত হয়নি তখনও দু’টো স্তরে অল্প কিছু বিষয়ে বিকল্প বাছাই করার সুযোগ ছিল। প্রথমতঃ সপ্তম ক্লাসে ক্লাসিঙ বিষয়ে আরবী, উর্দু, সংস্কৃত ও পালির মধ্যে যেকোন একটি বেছে নেয়ার সুযোগ হত। এ বিষয়টিকে তখন এডিশনাল বা বাড়তি বিষয় বলা হত। এরপর নবম শ্রেণীতে উঠে বিজ্ঞান, এডিশনাল ম্যাথমেটিঙ, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান এবং লোকপ্রশাসন বিষয়গুলোর যেকোন একটি বাছাই করার সুযোগ দেয়া হত। এ স্তরে ক্লাসিঙ বিষয়ে সপ্তম শ্রেণীতে বাছাইকৃত বিষয়টি নিয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার নিয়ম চালু ছিল।
আমি সরকারি মুসলিম হাই স্কুলের ছাত্র। এখানে শুধু মুসলমান ছাত্রদের ভর্তির সুযোগ ছিল। সুতরাং সংস্কৃত বা পালি পড়াবার ব্যবস্থা এখানে ছিলনা। আমরা আরবী বা উর্দু যেকোন একটি বাছাই করার সুযোগ পেতাম।
আরবী পড়বার আকর্ষণ ছিল এটি মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থের ভাষা হওয়ার কারণে সবার পরিচিত মনে হত। এর চেয়ে অনেক বড় আকর্ষণ ছিল এ বিষয়ে খুব ভাল মার্ক পাওয়ার সম্ভাবনা। ঐতিহ্যগতভাবে গণিতের পরে সবচেয়ে ভাল মার্ক আরবীতেই তখন পাওয়া যেত। স্বাভাবিকভাবে আমি আরবীকে আমার বিকল্প স্থির করে রেখেছিলাম এবং সেভাবে আরবীর ক্লাসে যোগ দিলাম। উর্দু, আরবী একই ঘণ্টায় দেখানো হত স্কুলের রুটিনে। যে বিষয়ে ছাত্র সংখ্যা বেশী হত সে বিষয়টির ক্লাস বসত মূল ক্লাসকক্ষে। অন্যটি বসত সাধারণত অপেক্ষাকৃত ছোট কোন একটি কাছাকাছি কক্ষে। সেখানে ঐ বিষয়ের ছাত্ররা ঐ ঘণ্টার জন্য স্থান বদল করে চলে যেত। এই কক্ষ বদল একটা মজার ব্যাপার ছিল। সংখ্যাগুরু ছাত্ররা এ মজা থেকে বঞ্চিত ছিল। এবার আমাদের আরবীর গ্রুপটি সংখ্যায় ছোট হয়ে গেল। সুতরাং মজাটা আমাদের ভাগ্যেই জুটল। অন্য গ্রুপের ছাত্ররা লোভাতুর চোখে আমাদের যাওয়া আসার গতিবিধির দিকে তাকিয়ে থাকত।
স্কুলের দু’জন ক্লাসিক্সের শিক্ষকের মধ্যে হেডমৌলভি সাহেব আরবী আর দ্বিতীয় জন উর্দুর ক্লাস নিতেন। আমি আরবী নেয়ায় মনে হল বাড়তি সুবিধা আরও একটি পেলাম- প্রধান মৌলভীর সঙ্গে ক্লাশ পেলাম। আগে শুনেছি তিনি মৌলভি হয়েও রসিকতার জন্য ছাত্র-শিক্ষক উভয় মহলেই সুপরিচিত ছিলেন। ছাত্ররা তাঁর পড়াবার যেরকম প্রশংসা করত তার হাতে শাস্তি পাওয়া নাকি সেরকম উপভোগ করত। তাঁর দ্বিতীয় গুণটি কিরকম এবং তা’ কেন উপভোগ্য হয় তার করুণ স্বরূপটি বুঝার জন্য আমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়। আমি সপ্তম ক্লাসে নতুন ভর্তি হয়েছি। দেরিতে ভর্তি হওয়ার কারণে তখনও আমার বই কেনা হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে প্রথম কয়েকদিন তিন-চার ঘণ্টা ক্লাশ হয়ে ছুটি হয়ে যেত। বছরের প্রথম দিকে আরম্ভটা এরকমই হয়। পুরো দিনের ক্লাশ জমতে সপ্তাহ দুই লেগে যেত। ক্লাসিঙের পিরিয়ড সাধারণত দিনের দ্বিতীয় অর্ধভাগে দেয়া হত। ফলে, আরবী ক্লাস পেতে বেশ কয়েকদিন লেগে গেল। প্রথম ক্লাসে বেশ হালকা বোধ হল। পড়া দেয়া হলেও পড়া নেয়ার পর্বটা খুব কড়াকড়িভাবে শুরু হয়নি। এরইমধ্যে যেদিন থেকে নিয়মিত পুরো রুটিন মত সব ক্লাস বসেছে তখন মৌলভী স্যারকে দেখলাম বেশ আয়েস করে পড়া দেন। পড়া নেয়ার সময় যারা কম পারত বা পারত না তাদের কিছু কটু কথা বলে ছেড়ে দিতেন। ক্ষেত্রবিশেষে, কাউকে কাউকে বিশেষ বিশেষ বিশেষণে ভূষিত করছেন। আমি কানে শুনেও সবগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! একটু অবাক হলাম, যাদের উপর এগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে তারা পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে, কারো কারো মুখে উপভোগ করার হাসিও দেখলাম। স্যার দেখলাম তাদের হাসির জন্য ভর্ৎসনা করতে গিয়ে আরও অবিশ্বাস্য হাস্যকর বিশেষণ প্রয়োগ করছেন। বিস্মিত হয়ে দেখলাম তাতে পরিবেশ ভারী হওয়ার বদলে আরো হালকা হচ্ছে।
এরমধ্যে নিয়মিত ক্লাস শুরু হয়ে গেল। তখন বই থেকে সব পড়া দেওয়া শুরু হল। তাঁর পড়ানোর ধরনটা আমার খুব ভালো লাগলো। ক্রমে ক্রমে পড়া নেয়ার কড়াকড়িও শুরু হয়ে গেল। কিছু কিছু শাস্তিও। নিয়মিত ক্লাশ বসার প্রথম সপ্তাহটি শেষের দিকে গড়িয়েছে। আমি দেখলাম স্যার শাস্তি দেয়ার জন্য কোন সরঞ্জাম ব্যবহার করছেন না। যারা পড়া দিতে পারছে না তাদের শাস্তি শারীরিক। তার ধরনটা অদ্ভুত। যেদিন পুরোদস্তুর পাঠ দেয়া শুরু হল সেদিন দেখলাম শুধু ভর্ৎসনা নয়, রীতিমত শারীরিক নিগ্রহ শুরু হল। কিন্তু কাউকে কাতর হতে দেখলাম না। আমি তখনও অক্ষত। আমার অজুহাত তখনও বই কেনা হয়নি, এটা যেন আমার নয়, অভিভাবকের দোষ। ক্রমে ক্রমে পাঠদানে কড়াকড়ি শুরু হল।
সেদিন সপ্তাহের শেষ দিন, বৃহস্পতিবার। যারা পড়া পারেনি তাদের দাঁড়িয়ে থাকার হুকুম হল। আজও আমি বই না থাকার অজুহাতে পার পেলাম। ক্লাসের জনা পনের ছাত্রের মধ্যে জনা পাঁচেক এই অভিযোগে দাঁড়িয়ে আছে। স্যার নতুন পড়া দিয়ে নিজের আসন থেকে উঠে অভিযুক্তদের দিকে রাগের ভাব নিয়ে কাছে এলেন। খালি হাতে কি শাস্তি দেবেন তা নিয়ে ভাবছি। একেবারে কাছের ছাত্রটিকে তার আসনে বসিয়ে দিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে বাঁহাতে তার মাথাটা সজোরে নিচের দিকে নামিয়ে এনে বই-পুস্তক রাখার সামনের উঁচু বেঞ্চের উপর প্রায় চেপে ধরলেন। আর ডান হাত দিয়ে প্রচ- এক কিল বসালেন ছেলেটির উঁচু হয়ে থাকা পিঠের উপর। দু’তিন বেঞ্চ দূরে বসে আমার মনে হল যেন সারা কামরায় কিলের প্রতিধ্বনি শুনলাম। এভাবে একে একে সব ক’জনকে মাথা সামনের দিকে নুইয়ে দিয়ে পিঠের উপর কিল বসাবার পর শাস্তিদানের পালা শেষ হল। স্যার নিজের আসনে ফিরে গেলেন। আগামীতে পড়া তৈরি করে না আসলে শাস্তি যে আরও বাড়বে তার ঘোষণা দিলেন। এমন কিল যাদের উপর বর্ষিত হলো তাদের চোখে-মুখে বেদনার কোন আভাসই নাই। বরং তাদের বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখলাম। নিজেদের সহজে গুছিয়ে নিয়েছে। ভবিষ্যতের শাস্তি ঘোষণায় তাদের কোনো ভাবান্তর হলনা।
এদিকে এক এক জনের পিঠে কিল পড়ার সময় আমি শিউরে উঠছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল এরকম কিল হজম করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ওদের রপ্ত আছে। কি সেই গোপন ক্ষমতা তখন বুঝে উঠিনি। কোনদিন যদি বুঝিওবা, আমি কি তা আয়ত্ত করতে পারব! সে দুশ্চিন্তা আমাকে পেয়ে বসল। সেদিন ছুটির পর ঘরে ফিরে কাউকে কিছু বলিনি। আমাকে আশ্চর্যরকম চুপচাপ দেখে মা একেকবার জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছেন। আমি এড়িয়ে গেছি। পরের দিন শুক্রবার, সাপ্তাহিক ছুটি। কিছু সময় আরো পাওয়া গেল। ভেবেছি শনিবার স্কুলে যাবার আগে কোন একটা সমাধানে আসতে হবে। দেখতে দেখতে দিনটা কেটে গেল।
কিলকলাপ অনেকসময় জ্ঞানপ্রদ হয় শুনেছি। কিন্তু, আমার সেরকম সম্যক অতীত কোন উদাহরণ জানা নাই। আমি কোন সুরাহা পেলাম না। অবশেষে ঠিক করলাম আরবী ক্লাসে আর যাব না। আমার বিকল্প ক্লাসিঙ বিষয় হয়ে গেল উর্দু।
যাই বলিনা কেন, মনে একটু দুঃখ রয়ে গেল। আরবী নিয়ে পড়তে পারলে একটা বিষয়ে লেটার মার্ক পেতাম। কিন্তু শাস্তির দৃশ্যটা আমার কাছে বিভীষিকা হয়ে আছে, তা জয় করতে পারলাম না। ক্লাসিঙ বিষয়ে একটা লেটার মার্ক আমার অধরাই রয়ে গেল।
লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ।