একাধিক স্বপ্নের অপমৃত্যু

পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের যুক্ত করার পরামর্শ ।। বাড়ছে আত্নহত্যা

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২০ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

একাধিক স্বপ্নের অপমৃত্যু হচ্ছে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। আত্মহত্যা যেন জীবন যুদ্ধ থেকে পালানোর একমাত্র রাস্তা। যখন অনেক চিন্তা করেও কোনো কূল-কিনারা পাওয়া যায় না, তখন এ রাস্তাটিকেই শেষ আশ্রয় হিসেবে ভেবে নেয় অনেকে। কিন্তু এটা তো সত্যি জীবনযুদ্ধে টিকে থাকাটা কঠিন। আত্মহত্যার রাস্তায় হাঁটা তাই একটু হলেও সহজ।
দেশে যত সময় এগোচ্ছে, ততই বাড়ছে আত্মহত্যার সংখ্যা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন নারীরা। গণমাধ্যমে প্রকাশিত আত্মহত্যা সংক্রান্ত সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিদিনই পারিবারিক ও আর্থিক সমস্যা, পারস্পরিক সম্পর্কে বিবাদ, অবিশ্বাস ও বোঝাপড়ার অভাব, অভাবের তাড়না, ধর্ষিত হওয়ার লজ্জা, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়া, যৌন হয়রানি, যৌতুক, ফতোয়া-গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে অপমানিত হওয়া, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতাসহ নানা কারণেই ঘটছে আত্মহত্যার ঘটনা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যত লোক আত্মহত্যা করে তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। আত্মহত্যা করবে বলে চিন্তা করে তারও ১০ গুণ বেশি মানুষ। মানসিকভাবে বিপর্যস্তদের মধ্যে ৭০ শতাংশই আত্মহত্যা করে।
সমাজ বিজ্ঞানী ড. গাজী সালেহ উদ্দিন বলেন, পিতা-মাতার সান্নিধ্য লাভে ব্যর্থ হয়ে হতাশা ও একাকিত্বের কারণে কিশোর-কিশোরীরা আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। এছাড়া ব্যর্থতাবোধ বৃদ্ধি, বিনোদনের অভাব, বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন তো রয়েছেই। আত্মহত্যা রোধে পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তরুণদের যুক্ত করার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের ২০ শতাংশই আত্মহত্যার চেষ্টা করে জখম হয়। হাসপাতালে নেয়ার পরও অনেককে বাঁচানো সম্ভব হয় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে। এর সংখ্যা অন্যান্য কারণে মৃত্যু, যেমন যুদ্ধ ও খুনের ঘটনায় প্রাণহানির চেয়েও বেশি। ডব্লিউএইচও’র তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহত্যা করে। তবে আন্তর্জাতিক এ সংস্থা আত্মহত্যাকে একটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা হিসেবেই দেখে। স্বাস্থ্য, সামাজিক ও অন্যান্য সেক্টরের মতো মানবিক ও আর্থিক সাহায্য দিয়ে হলেও আত্মহত্যা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেয়াটা এখন সরকারের জন্য জরুরি।
চট্টগ্রামে প্রায় প্রতি মাসেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। পারিবারিক কলহের জের ধরে গত ১২ ডিসেম্বর সকাল ১০টার দিকে নগরীর হিলভিউ আবাসিক এলাকায় সুমি আক্তার নামে এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। এর আগে ১১ ডিসেম্বর সানজিদা আকতার মিশু নামে নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। খুলশী থানার ওয়ারলেস এলাকার বাসা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। ৭ ডিসেম্বর আকবরশাহ থানার বেলতলীঘোনা এলাকায় আত্মহত্যা করেন হীরা বেগম (৩১) নামের এক গৃহবধূ।
২৯ নভেম্বর আকবরশাহ থানার কালিরহাটে তানজিলা আক্তার লিজা (১৩) নামে এক কিশোরীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৪ নভেম্বর ডবলমুরিং থানার চারিয়া পাড়া গফুর ম্যানশনের ভাড়া বাসায় ফারজানা আকতার পপি ও পাহাড়তলী থানার হরি মন্দির এলাকায় এজাহার মিয়ার ভাড়া বাসায় শাহেদা বেগম নামে আরেক গৃহবধু আত্মহত্যা করেন।
২৭ অক্টোবর সীতাকুণ্ডের সলিমপুর জেলেপাড়ায় রামপদ দাশ নামে এক যুবক গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ৫ অক্টোবর লোহাগাড়ার পদুয়া ইউনিয়নে খুরশিদা বেগম (৪৮) নামে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
২৯ সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় হালিশহরে ঘরের ফ্যানের সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করেন ১৯ বছরের তরুণী মাহি। একই দিন বোয়ালখালী উপজেলার গোমদণ্ডী ফুলতলা এলাকায় সুমাইয়া আক্তার নামে এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীর লাশ পাওয়া যায়। ২২ সেপ্টেম্বর হাটহাজারীতে এনজিওর কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন এক গৃহবধূ। তার নাম রুপনা শর্মা।
১৪ আগস্ট হাটহাজারীতে মোছনা খানম রেশমী নামে ৩৫ বছর বয়সী অপর এক গৃহবধূ আত্মহত্যা করেন। ২৭ জুলাই রাতে চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ গাছবাড়িয়া পৌরসভার হরিণারপাড়া এলাকায় ফাতেমা তুজ জোহরা নামের এক স্কুল ছাত্রী আত্মহত্যা করে। জানা গেছে, ছোট বোনের সাথে ঝগড়ার জের ধরে ওই ছাত্রী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে।
২১ জুলাই দেওয়ানবাজার এলাকায় আত্মহত্যা করেন নীলম ধর অর্পা নামে আরেক তরুণী। ১৯ জুলাই কোতোয়ালী থানার ব্রিকফিল্ড রোডের একটি বাসা থেকে বৃষ্টি মুণ্ডা নামে এক কিশোরী গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ১৬ জুলাই ডবলমুরিং থানার বাদামতলী বড় মসজিদ এলাকায় সালমান ইসলাম মারুফ নামে দশম শ্রেণির এক স্কুল ছাত্র আত্মহত্যা করে।
২৫ জুন সীতাকুণ্ডের ভাটেরখীল এলাকায় আত্মহত্যা করে কিশোরী তানিয়া আক্তার। সে মানসিক ভারসাম্যহীন ছিল বলে জানা গেছে। ১৩ জুন ইপিজেড এলাকার একটি বাসায় গলায় ওড়না জড়িয়ে আত্মহত্যা করেন সাইমা আক্তার বৃষ্টি নামে এক গৃহবধূ।
২৭ মে মীরসরাইয়ের দক্ষিণ ওয়াহেদপুর গ্রামে বাবা ঈদের সালামি না দেওয়ায় অভিমান করে আত্মহত্যা করে মাইমুনা আক্তার নামে অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রী। ১৯ মার্চ রাতে কোতোয়ালী থানা এলাকায় আত্মহত্যা করেন চট্টগ্রামের উঠতি মডেল মানজুমা পারভীন মুনা। ২০ ফেব্রুয়ারি নগরীর ডবলমুরিং থানার শেখ মুজিব রোডে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন সুমাইয়া জেসিন (২৬) নামে অপর এক তরুণী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাদের খান চেয়ারম্যান মনজুরুল হক ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত
পরবর্তী নিবন্ধবারৈয়াঢালায় ২ হাজার শীতার্তকে কম্বল প্রদান