সে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার ২০ মে ১৯৭১, ইতিহাসের জঘন্যতম চুকনগর গণহত্যাযজ্ঞ। অনেকেরই অপরিচিত অজানা প্রত্যন্ত অঞ্চল খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ‘চুকনগর’। হিন্দু অধ্যুষিত একটা গ্রাম চুকনগর। ভারত সীমান্ত থেকে বেশি দূরে নয় এর অবস্থান। বেশিরভাগ লোক খেটে খাওয়া। ১৯৭১ সনে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো ছিল না। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী সারাদেশে যখন গণহত্যা চালাচ্ছিল, এই অঞ্চলটিও তার থেকে বাদ যায়নি। দুই ভাগে বিভক্ত পাকিস্তান নামক দেশের পূর্ব অংশে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ) নেমে এসেছিল স্মরণকালের মর্মান্তিক নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, ধর্মান্তকরণ প্রভৃতি অমানবিক কর্মযজ্ঞ। কথায় আছে পাপ বাপকেও ছাড়ে না। পাপের প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই করতে হবে। পাকবাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম পাপ করেছিল সেদিন। শক্তিধর পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের হুকুম দাতাদের কুকর্মের ফলে পূর্ব পাকিস্তান আর পাকিস্তান রইল না। দ্রুত সময়ে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আমরা জয়ী হই। ৯৩ হাজার রেগুলার সৈন্য নিয়ে পাকিস্তান আর্মি মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর নিকট আত্নসমর্পণ করে। বিশ্বে এটি একটা নজির বিহীন দৃষ্টান্ত। সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। সেই মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের এমন একটা রোমহর্ষক ঘটনার অবতারণা করব আজ। যা বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষের অজানা ও আড়ালে রয়ে গেছে। যাহা কালের গর্ভে মুক্তিযুদ্ধকালীন এই ঘটনা প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই এই ইতিহাস বারে বারে তাদের নিকট তোলে ধরা কর্তব্য। ১৯৭১ সালের ২০ মে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার ‘চুকনগরে’ পাকবাহিনী হানা দেয়। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার উদ্দেশ্যে পলায়নরত হাজার হাজার নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের উপর নিষ্ঠুরভাবে পাকিস্তান আর্মি বর্বরোচিত গণহত্যা চালায়। কথিত আছে সেদিন নিহতদের মধ্যে ৯৯% হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক ছিল। দেশজুড়ে অসংখ্য গণহত্যার মধ্যে চুকনগরের গণহত্যার ব্যাপকতা ও পৈশাচিকতার কোনো তুলনা নেই। ভিয়েতনামের ‘মাইলাই’ ও ভারতের জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যু ও নিষ্ঠুরতার তুলনায় চুকনগরের গণহত্যা, মৃত্যু, ধ্বংস লীলা, পৈশাচিকতা ও নিষ্ঠুরতা ব্যাপক এবং ভয়াবহ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরকম গণহত্যা আর ঘটেনি। পরাক্রমশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সেসময় বাঙালি জাতি বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল। তাই বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় আমরা বীরের জাতি। কোনো শক্তি আমাদের দাবাইয়া রাখতে পারবে না। আর বঙ্গবন্ধুর ভাষায় ‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব তুবও এদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ’। সেদিন পাকবাহিনী নৃশংসভাবে পৈশাচিক উল্লাসে একদিনে ১০–১২ হাজার নিরীহ লোককে হত্যা করেছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনা। ১৯৭১ সালে ৫ মে পাকিস্তানী বাহিনী স্থানীয় দোসরদের সহায়তায় খুলনা ও বাগেরহাটে ব্যাপক গণহত্যা, লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ শুরু করলে, এহেন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে হাজার হাজার মানুষ স্থাবর–অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে পিছুটান উপেক্ষা করে কেবলমাত্র সোনা দানা, টাকা পয়সা, দলিলপত্র, আর অল্প কিছু খাবার নিয়ে তারা সেদিন ভিটের শিকড় ছেড়ে ছিল। অনেক পরিবারে ছিল সদ্য প্রসূতি মা, সন্তান সম্ভাবা, অচল মা–বা ও অসুস্থ লোকজন। এলাকাটি নদী বহুল এলাকা হওয়ায় নৌকা ছিল তাদের একমাত্র বাহন। তারা সবাই মিলে ঠিক করল নৌকাযোগে চুকনগরে যাবে। কারণ চুকনগর ভারতে যাওয়ার একমাত্র নিরাপদ পথ। ঐ অঞ্চলে তখন বিরাট এলাকা জুড়ে বর্বর পাকবাহিনী গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছিল। সে সমস্ত জায়গা থেকে শরণার্থীরা চুকনগরে আসছিল সেগুলো হলো খুলনা, বাগেরহাট,, রূপসা, দৌলতপুর, ডুমুরিয়া, মোংলা, গোপালগঞ্জ, ফিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, বরিশাল, আরও অন্যান্য দূরদূরান্ত থেকে অসহায় লোকজন জমায়েত হচ্ছিল। ১৯ মে বাদামতলা ও ডাকরায় গণহত্যা ঘটে যাওয়ার পর সেখান থেকেও দলে দলে মানুষ ভারতে যাওয়ার জন্য চুকনগরের দিকে আসতে থাকে। এদিকে নৌকায়ও তারা নিরাপদ ছিল না। কারণ নদীতে পাকিস্তানী নেভির গানবোট টহল দিচ্ছিল। যাদের নৌকা ছিল না তারা ভাড়া নৌকা বা সড়কপথে যে যেভাবে পারে চুকনগরে পৌঁছার চেষ্টায় ছিল। ১৯ মে সারারাত নৌকার মিছিল। নদীর বুকে হারিকেন ও কুপির আলো মিটমিট করতেছিল। নদীর বুকে দাঁড় টানার শব্দ। আবার গানবোটের ভয় ছিল। শরণার্থীরা জানতে পেরেছিল ভারতে শরণার্থী শিবির খুলেছে। ২০ মে তারিখে চুকনগরের মানুষজন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে চারিদিকে লোকে লোকারণ্য। নদী তীরে হাজার হাজার নৌকার বহর। মানুষদের দেহ মনে ক্লান্তির ছাপ। চোখে মুখে আতঙ্ক। শক্ত কাগজে চোঙা বানিয়ে স্বেচ্ছাসেবকরা শরণার্থীদের খবরাখবর দিচ্ছে। গ্রামের ৩–৪ কি.মি. ব্যাসার্ধ এলাকা নিয়ে প্রায় দুই লক্ষ মানুষের জমায়েত। সকাল সাড়ে ১০ টা কি ১১ টা হঠাৎ গুলির শব্দ, চারিদিকে ছুটাছুটি, প্রাণ বাঁচাতে মানুষ উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। চারিদিকে আর্তচিৎকার, আহাজারী, গুলির শব্দ থেমে নেই। চুকনগর কলেজের দক্ষিণে পাতিখোলা বিলে এসে পাক আর্মি শুরু করলো একটানা ব্রাশ ফায়ার। মুহূর্তের মধ্যে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বের হতে থাকে। অসংখ্য মানুষ মৃত্যুর কোলে লুটিয়ে পড়ল। যাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়েছিল সবাইকে গুলির আঘাতে হত্যা করা হলো। কী পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড। যারা প্রাণ বাঁচাতে নদীতে বা পুকুরে ঝাঁপ দিয়েছিল বুলেটের আঘাত তাদের ক্ষমা করেনি। পাক সেনারা এক মুসলিম পাড়ায় প্রবেশ করে দেখল একটা ঘরে অনেক লোক প্রাণ বাঁচানোর জন্য কালেমা পড়তে থাকে, আল্লাহ আকবর, পাকিস্তান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ, টিক্কাখান জিন্দাবাদ শ্লোগান দিতে থাকে। সৈন্যরা মুসলিম পাড়া মনে করে সেখান থেকে চলে গেল।
এভাবে অসংখ্য নারকীয় হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় চুকনগরে। আর্মিরা চলে যাওয়ার পর দেখা গেল লাশের স্তুপ। অসংখ্যা লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। স্বজন হারানোদের বিলাপে চুকনগরের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে আসলো। চারিদিকে আর্তনাত, যারা বেঁচে রইল দিশেহারা শোকে বিহবল। এরশাদ আলি তার বাবার লাশ নিতে এসে লাশের মাঝে পা ফেলতে পারছে না। লাশ অপসারণকারীরা ৪২০০ লাশ অপসারণ করে অপারগতা প্রকাশ করলো। ভদ্রা ও ঘ্যাংরাইল নদীতে প্রচুর লাশ ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অনেককে গণকবর দেওয়া হয়। সেদিন এরশাদ আলি এক মর্মান্তিক দৃশ্য দেখল। পাঁচ–ছয় মাসের এক ফুটফুটে কন্যা শিশু মৃত মায়ের বুকে উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছে। শিশুটি মায়ের বুকে দুধ খুঁজছে। মৃত মায়ের কপালে সিঁদুর দেখে মনে হলো শিশুটি হিন্দু পরিবারের। এরশাদ আলি শিশুটিকে এক হিন্দু দম্পতিকে লালন পালনের জন্য দিয়ে দিল। সে বড় হলো, তার নাম রাখল সুন্দরী। এখন সে সুন্দরী দাসী, দু’সন্তানের জননী। এই যে পূর্বসুরীদের আত্নত্যাগের কথা এটা উত্তরসুরীদের কাছে পৌঁছাতে হবে। অতি পরিতাপের বিষয় ইতিহাসের এতো বড় জঘন্যতম গণহত্যা ১৫ খণ্ড সম্বলিত মুদ্রিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা দলিলে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। তবে জানা যায় বর্তমান সরকার এ বিষয়টি জোরদার করার লক্ষ্যে কাজ করছে। ১৯৯৩ সালে চুকনগরে গঠিত হয় ‘চুকনগর গণহত্যা–৭১ স্মৃতি রক্ষা পরিষদ’। এই পরিষদের অধিকাংশ সদস্যই ১৯৭১ সালের ২০ মে এর সংঘটিত গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। প্রতি বৎসর ২০ মে চুকনগর গণতত্যা–৭১ স্মৃতিরক্ষা পরিষদ দিবসটি পালন করে থাকে।
লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।