মোহাম্মদ নুর হোসেন (১৯৩৪–১৯৭১)। প্রকৌশলী, বুদ্ধিজীবী, সংগঠক, সৌখিন নাট্যশিল্পী, বেতার কথক, ধারাভাষ্যকার, পরামর্শক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। মোহাম্মদ নুর হোসেন ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল চট্টগ্রামে এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনভাই এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। পিতা মো: জাকের হোসেন, মাতা মা‘বিয়া খাতুন। পিতৃনিবাস: বাথুয়া, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। স্থায়ী ঠিকানা: হোসেন মঞ্জিল, রিয়াজুদ্দিন রোড, চট্টগ্রাম। শিক্ষাজীবন শুরু হয় এনায়েত বাজার জুবিলী রোডস্থ এবাদুল্লাহ পণ্ডিত প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৫১ সালে চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন, অংক এবং অতিরিক্ত, উভয় বিষয়ে লেটার মার্কস অর্জন করেন এবং সেইসাথে বৃত্তি পান। ১৯৫৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে দ্বাদশ স্থান অধিকার করে রসায়ন ও অংকে লেটার নিয়ে প্রথম বিভাগে আইএসসি পাশ করেন এবং বৃত্তি লাভ করেন। পরে ১৯৫৭ সালে ঢাকা আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিএসসি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং–এ প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। পাশ করার সাথে সাথেই কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে যোগদানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে (তৎকালীন সদরঘাট পোর্ট কমিশনার অফিসে) সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৮ সালের ৬ জুন বিয়ে করেন চট্টগ্রামের প্রখ্যাত পুঁথিসাহিত্যিক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের নাতনী খুরশীদ জাহান বেগমকে। শহীদ নুর হোসেন শুধুমাত্র প্রকৌশলী ছিলেন না, ১৯৬৩ সালে বন্দরের পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ড সফরে গেলে সেখানে তাঁর কথাবার্তা শুনে একজন বলেছিলেন, ‘ তোমার প্রকৌশলী না হয়ে আইনবিদ হওয়া উচিত ছিলো। ’ এ কথা তাঁর মনে এতটা দাগ কেটেছিল যে, দেশে ফিরে এসে কাউকে না জানিয়ে আইন বিষয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। সবাই জানলো সেদিন, যেদিন ‘দৈনিক আজাদী’ পত্রিকায় খবর ছাপা হলো ‘প্রকৌশলী আইনজ্ঞ হলেন’, হ্যাঁ, ১৯৬৬ সালে তিনি এলএলবি পাশ করেন। বেতারে কথিকা পড়তেন, ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার ধারাভাষ্যকার হিসেবেও কাজ করেছেন। তাঁর কৌতুকপূর্ণ উক্তি শ্রোতাসাধারণকে আকর্ষণ করতো। বেতারের শিশুকিশোর মেলায় তিনি ধাঁধা‘র আসর পরিচালনা করতেন। তাঁর নিজের তৈরি অনেক ধাঁধা‘র মধ্যে চট্টগ্রামকে নিয়ে একটি ধাঁধা – ‘নাম শুনে মনে হয় যেন গণ্ডগ্রাম, আসলে শহর এক নয়নাভিরাম’। আজ তিনি নেই, রয়ে গেছে তাঁর রক্তের স্বাক্ষর স্বাধীন বাংলাদেশ। বন্দরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডসহ বেতারের সকল উৎসব আয়োজনে তাঁর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: নুর হোসেন সপরিবারে থাকতেন বন্দর অফিসার্স কলোনির ৩০ নম্বর বাংলোতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাক্কালে অসহযোগ আন্দোলন এবং গণভ্যুত্থানে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি অফিসার, কর্মচারীদের একত্র করে গোপন বৈঠক ইত্যাদিতে নেতৃত্ব দান, বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সম্পর্কের কারণে বন্দরের অবাঙালি অফিসারদের মনে জেগেছিল প্রতিহিংসার আগুন। ১৯৭১–এর মার্চে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাঁরা ছিলেন একরকম নজরবন্দি, কারণ এলাকাটি ছিল পাকবাহিনীর কঠোর নিয়ন্ত্রণে। সে মুহূর্তে সেখান থেকে সরে আসাও তাঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল না। তবুও ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নিলেন শহরের দিকে বাসা বদলের। নতুন বাসার প্রস্তুতি কাজ সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত তিনি সপরিবারে উঠলেন নিজস্ব বাসা ‘হোসেন মঞ্জিল’ রিয়াজুদ্দিন রোডে। উদ্দেশ্য ছিল সুযোগ বুঝে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং এজন্যে বাসায় এসে তাঁর ছোট ভাইয়ের হাতে গচ্ছিত রেখেছিলেন বন্দর সম্পর্কিত বেশ কিছু মূল্যবান বইপত্র ও নকশা, যেগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের বন্দর অপারেশনে অত্যন্ত প্রয়োজন। এসব বইপত্র ও নকশা জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী মো: ইব্রাহীমের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। পাকসেনা ও তাদের দোসরদের শ্যেন দৃষ্টির কারণে তিনি কয়েকদিন বাসা থেকেই অফিসে যাতায়াত করছিলেন, আর সেদিনও যথারীতি রওনা দিয়েছিলেন অফিসের উদ্দেশ্যে। সে দিনটি ছিল শনিবার ২২ মে ১৯৭১। সে দিনের কোনো একটি ক্ষণ তাঁকে বিচ্ছিন্ন করলো মা–বাবা, ভাই–বোন, তাঁর স্ত্রী, তিন ছেলে ও একমাত্র মেয়ের কাছ থেকে, পুরো পরিবারকে পংগু করে দিয়ে গেল সেই ক্ষণটি। পাকসেনারা তাঁর ব্যক্তিগত গাড়ির নিরপরাধ ড্রাইভার আবুল কালামকেও ছেড়ে দেয়নি। এর আগের দিন শুক্রবার বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী জনাব শামসুজ্জামানকে অফিস থেকে পাকসেনা লে. কমান্ডার সিদ্দিকী সুকৌশলে নেভাল ব্যাজে নিয়ে গিয়েছিল ড্রাইভারসহ, যেখান থেকে তাঁরাও আর ফিরে আসেননি। শুরু হলো খোঁজাখুঁজি, পাওয়া গেল শুধু আশ্বাস। তাঁদের লাশ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া গেল না। ত্রিশ লক্ষ শহীদের ভীড়ে স্মৃতি হয়ে রইলেন তাঁরা।
লেখক: বেতার ব্যক্তিত্ব।