একাত্তরের ঐতিহাসিক যুদ্ধে রামগড় পতন

সামসুদ্দিন আহমদ | শনিবার , ৭ মে, ২০২২ at ৬:৫৮ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালে প্রতিরোধ যুদ্ধে চট্টগ্রাম শহরের পতনের পর পাকিস্তানি সৈন্যরা চট্টগ্রামকক্সবাজারের দিকে আসর জন্য দুটি কলামে বিভক্ত হয়ে কালুঘাটের দিকে আসতে থাকে, একটি রেললাইন দিয়ে অপরটি আরাকান সড়ক দিয়ে অন্যদিকে কর্ণফুলী নদীতে অবস্থানরত বাবর যুদ্ধজাহাজ থেকে পাকিস্তানি নৌ সেনারা শেলিং করতে থাকে। আমাদের সৈন্যরা প্রাণপণ যুদ্ধ করার পর কালুরঘাট সড়ক বন্ধ হয়ে গেল।

১১ এপ্রিল কালুরঘাট পতনের পর আমরা দুজন অফিসারকে হারালাম। এরা হচ্ছে বন্ধু শওকত ও ফারুক। অন্যদিকে আহত ক্যাপ্টেন হারুনকে পটিয়ার দিকে পাঠানো হলো। লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন বন্দী হলেন। এখানে আমরা যারা যুদ্ধের সৈনিক ও ছাত্র ভাইয়েরা ছিল একটা অংশ পাহাড়তলী হয়ে অন্যরা বান্দরবান হয়ে রামগড়ের দিকে চলে যায়। পাহাড়তলী হয়ে রাউজান হয়ে ফটিকছড়িতে মির্জা মনছুরের বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার পর রাতযাপন করি। তার পরদিন সকালে আবার যাত্রা শুরু। মানিকছড়ির রাজবাড়িতে সবার থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাজা মংশু প্রু শরণার্থীদের খাওয়ার পানির ব্যবস্থা করেন। পরে রাজা ভারতে চলে যান। রাজা মংশু প্রু স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু তাকে পার্বত্য চট্টগ্রামে গভর্নর করেন। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম কিছু ই.পি.আর নিয়ে হাটহাজারী পশ্চিম দিকে উদালিয়া চা বাগানে একটি ঘাটি করে অবস্থান নেন। তারপরে ভারতের আগরতলায় চলে যান অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। সেখানে ত্রিপুরা সরকারের সঙ্গে সাক্ষাতকার করে তিনি কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। ফটিকছড়ি থেকে রাজবাড়ি পর্যন্ত মংশু প্রু রাজা তার নিজের লোকদের দিয়ে শরণার্থীদের জন্য পথে পথে খাবার পানির ব্যবস্থা করেন। কারণ হাজার হাজার শরণার্থী এ রাস্তা দিয়ে রামগড় যাচ্ছে। এক নাগাড়ে হাঁটতে হাঁটতে অবুঝ শিশু ছেলেমেয়েসহ সবারই করুণ অবস্থা।

রামগড় ছিল পূর্বপাকিস্তানের মহকুমা শহর। বনজঙ্গলপাহাড় বিস্তৃত শান্ত একটি শহর। কালুরঘাট যুদ্ধের পর ই.পি.আর ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা চট্টগ্রামে যুদ্ধরত সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মাহালছড়ি হয়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময় থেকে রামগড় জমায়েত হতে থাকে। তখন রামগড়কে সামরিক বাহিনী যুদ্ধের সদর দপ্তর হিসেবে স্থাপিত করে। ১৮ তারিখ থেকে আমরা ১৫০ জন ছাত্র ভারতীয় বি.এস.এফএর নির্দেশে ৯১/বি.এস.এফ এর হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরায় দুই ব্যাচ করে আমরা ট্রেনিং গ্রহণ করি। ট্রেনিং শেষ করে আমরা রামগড় সদর দপ্তরে যোগদান করলাম। এরপর বিভিন্ন সাবসেক্টরে ভাগ হয়ে যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলাম। পাশাপাশি শরণার্থীদের দেখার দায়িত্ব পালন করি। এই সময় মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে নির্দেশ আসে যেভাবে হোক রামগড়কে রক্ষা করতে হবে। আমাদের বড় সমস্যা ছিল শরণার্থীরা দলে দলে রামগড়ে যেতে শুরু করে। রামগড়ে একটি বড় মাঠ আছে। শরণার্থীরা এখানে এসে আশ্রয় নেয়। তারপর সকালে দলে দলে চলে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের বড় সমস্যা ছিল শরণার্থীদের নিয়ে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে এপ্রিলের শেষের দিকে শুভপুর ব্রিজের আশেপাশে তুমুল যুদ্ধ হয়। আমাদের প্রধান টার্গেট ছিল রামগড়কে দখলে রাখা। করনহাট থেকে পূর্বদিকে পাহাড়ের ভিতর দিয়ে চলে গেছে রামগড়ের রাস্তা। সদর দপ্তরের বাঙালি অফিসাররা রামগড় রক্ষার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছিল। দুঃখের বিষয় আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের অভাব ছিল। ভারতীয় বাহিনী তেমন কোন সাহায্য করছে না। তারা বাংলাদেশের ভেতর বসে আছে। আমরা তার আগে শুভপুর ব্রিজ, বারইয়ারহাট, করনহাট হারালাম। নারায়ণহাট থেকে আমাদের সৈন্যরা চলে আসে রামগড়ের উত্তরদিকে ফেনী নদী ওই পাড়ে ভারতের ক্রিপুরা মহকুমা শহর সাবরুমে। এদিকে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন রামগড়ের দিকে এগোতে না পারে সেজন্য করনহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কালভার্ট আছে। আমাদের সৈন্যরা কালভার্টগুলো ধ্বংস করে দিয়েছিল। যেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী না আসতে পারে। আমাদের বাঙালি সৈন্যরা হিয়াকুতে অবস্থান করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা তিনদিক দিয়ে তিন কলাম ধরে আসতে থাকে। নারায়ণ হাট এবং একটি গ্রুপ করহাট দিয়ে এবং অপর গ্রুপ মাহালছড়ি হয়ে আসতে থাকে। ২৭ এপ্রিল মাহালছড়িতে তুমুল যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি কমান্ডোরা মিজোদের পাঠায়, পাকিস্তানিরা মিজোদের পিছনে এমনভাবে অবস্থান নেয় যেন মিজোরা পালাতে না পারে।

পাকিস্তানিরা মিজোদের সামনে দিয়ে মিজোদের পিছনে বন্দুক ধরে তাদেরকে এগোতে বলে কিন্তু কিছু উঁচু পাহাড়ে মিজোরা অবস্থান নিল। ওখান থেকে ফায়ার করতে থাকে ই.পি.আর এর সিপাহী মুন্সী আবদুর রউফ। সুবিধাজনক অবস্থানে আমাদের সৈন্য ও অফিসারদেরকে বাঁচানোর জন্য অবিরাম গুলি করতে থাকে সে। হঠাৎ পিছনে অবস্থানরত মিজোদের গুলিতে প্রাণ হারায়। আমাদের যে বাঙালি অফিসাররা আছে তার মধ্যে কিছু ছাত্রবন্ধ দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন কাদের সবাইকে রক্ষার জন্য একটি পাহাড়ের সুবিধাজনক অবস্থা থেকে গুলি করতে থাকে। ওখান থেকে সবাই রক্ষা পায়। হঠাৎ মিজোদের গুলিতে ক্যাপ্টেন কাদের গুলিবিদ্ধ হয়। তখন ড্রাইভার আব্বাস সাহসের সঙ্গে তাকে নিয়ে রামগড়ে চলে যান। পথিমধ্যে তিনি মারা যায়। রামগড়ে তাকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয়। কাদের সাহেব এপ্রিল মাসে বিয়ে করার জন্য ছুটিতে আসেন। পরে পরিস্থিতি আর দেশের প্রতি দৃঢ় ভালোবাসা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। এদিকে হিংগুলিতে ক্যাপ্টেন রফিকের সৈন্যদের অবস্থান এবং পূর্বদিকে মাহালছড়ির দিকে লেফটেন্যান্ট মাহফুজের অবস্থান। তার কয়েকদিন আগে করনহাট ও নারায়ণহাট পতনের পর আমাদের অস্থায়ী সদর দপ্তর ত্রিপুরা রাজ্যে হরিনাতে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে কিছু সৈন্যদের রাখা হয়। আমাদের পূর্ব দিকের মাহালছড়ির সৈন্যরা ৩০ এপ্রিল রামগড়ে চলে আসে। ক্যাপ্টেন রফিকও হিংগুলি থেকে রামগড়ে চলে আসেন। তিনি চলে আসার পর অধিক সৈন্য হরিনাথে পাঠানো হয়। অতি দুঃখের বিষয় যে পথ দিয়ে শরণার্থীরা আসে সেসব রাস্তা পাকিস্তানিরা দখল করে রামগড়ের দিকে এগিয়ে আসে।

এদিকে পাকিস্তানিরা ৩০ এপ্রিল রাতে নারায়ণহাট দিয়ে রামগড়ের সামনের পাহাড় ও সমতল ভূমিতে রাতের আঁধারে অনেক সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়। পাকিস্তানিরা ভোরবেলা ১ এপ্রিল থেকে ৩ দিকে মাহালছড়ি হয়ে মিজুদের নিয়ে আসতেছে। নারায়ণহাট দিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা রামগড়ের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেছে। ৩নং হিয়াকু দিয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বহু উচ্চপদের অফিসার এ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে রামগড় দখল করার জন্য। আমরা ভেবেছিলাম ভারতীয় সৈন্যরা রামগড়ে আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে। সেটা না তারা বাঙ্কারে বসে বসে দেখছে। আমাদের কিছু জ্বালানি ও খাদ্য মজুদ ছিল। আমরা আগেই ওই পারে সব নিয়ে গেছি। আমাদের একটি অস্থায়ী হাসপাতাল ছিল আহতদের চিকিৎসার জন্য। পাকিস্তানিরা আমাদের বাঙালি দালালদের নিয়ে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে ভারতের সাবরুমে অবস্থানরত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সাবরুম থেকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে নিরাপত্তার জন্য। সাবরুমে ভারতীয় উচ্চপদস্থ অফিসার, বহু বিদেশি সাংবাদিক জড় হতে থাকে। এরপর ৫টা বাজার পাঁচ মিনিট পর বি.এস.এফ এর ক্যাপ্টেন মেঘসিং দুটি তেলের কন্টেইনার আমাকে আর অমল মিত্রকে দেয়। রামগড়ে ১টি বিদ্যালয় একটি পোস্ট অফিস কয়েকটি বন বিভাগের বাংলাে ছিল। আমরা দুজন গিয়ে বাড়ি গুলিতে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম। যাতে প্রতিপক্ষ ভয় পায়। তার আগে আমরা রামগড় থেকে প্রয়োজনীয় সবকিছু সরিয়ে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলাম।

রামগড় পাকিস্তানিদের জিম্মায় চলে যায়। মে মাসের ২ তারিখে বাংলাদেশের শেষ বর্ডার মাতৃভূমি আমাদের হাতছাড়া হল। রামগড় দখল করার পর থেকে কালবৈশাখী শুরু হলো। ওইপারে চলতে থাকে মাতৃভূমি থেকে চলে আসার হৃদয় বিদারক দৃশ্য। ছাত্র পুলিশ, .পি.আর অফিসার সবার চোখে জল। এ স্মৃতি ভুলে যাওয়ার নয়। অনেকদিন না শুধু পরকাল যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত এ স্মৃতি আমার মনে থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধ রক্ষা করা সম্ভব হলো না। রামগড়ের দখল হারানো এর একটি বড় কারণ। গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রের অভাব। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেনি। কালুরঘাটের যুদ্ধ থেকে রামগড় পর্যন্ত আমরা চারজন অফিসারকে হারিয়েছি কালুরঘাট যুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন ও লে. শমসের মুবিন চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়। মাহালছড়িতে সিপাহী আবদুর রউফ শহীদ হয়। শহীদ হয় ক্যাপ্টেন কাদের।

সে সময় রামগড় সীমান্ত দিয়ে তখনকার জাতীয় পরিষদের সদস্য ও গণপরিষদের সদস্যরা পার হয়েছিলেন। চট্টগ্রামে যারা জাতীয় নেতৃত্বে ছিল তাদের সবাই রামগড় দিয়ে সপরিবারে আসে এবং চলে যায়। তার মধ্যে জহুর আহম্মদ চৌধুরী এম.আর সিদ্দীকি, .আর. মল্লিক, . আনিসুজ্জামান, . মান্নান এম.পি, আব্দুল্লাহ আল হারুণ, এম.এ ওহাব মিয়া, এইচ.টি ইমাম, শিল্পপতি এ.কে খান, সি.আর দত্ত এবং কবরী।

আরো অনেক পরিবার এই রামগড় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তত্ত্বাবধানে পারাপার হয়। রামগড়ের পতন পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে ছিল আওয়ামী লীগের সভাপতি এম.এ হান্নান, সাধারণ সম্পাদক এম.এ মান্নান, ছাত্রলীগের সভাপতি আবু মোহাম্মদ হাসেম। স্বাধীনতার পর সরকার যাঁদেরকে বিভিন্ন খেতাবে ভূষিত করেন। ১. ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী (বীর উত্তম), . ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের শহীদ (বীর উত্তম) চট্টগ্রাম। সেনানিবাসের (.বি.আর.সি সেন্টার) বর্তমান উক্ত সেন্টারের নাম আফতাব কাদের গ্রাউন্ড। ৩. লে. শমসের মুবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম) . মুন্সী আবদুর রউফ (১ম বীরশ্রেষ্ঠ)। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি স্বপ্নের মৃত্যুবার্ষিকী
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে