নগরীর এম এ আজিজ স্টেডিয়ামের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে শতাধিক শিশু-কিশোরের মেলা। কেউ খেলছে ক্রিকেট, কেউ বা ফুটবল। কিন্তু এসব শিশু-কিশোরদের যারা খেলাচ্ছে, সেই একাডেমিগুলো কতটা যত্নশীল? এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বড় করে। বিশেষ করে করোনার এ সময়ে যখন প্রচণ্ড ধুলো-বালির মাঝে শিশুরা গায়ে গা লাগিয়ে খেলতে থাকে-তখন ঝুঁকির পাশাপাশি প্রশ্ন ওঠে একাডেমিগুলোর দায়িত্ববোধ নিয়েও।
চট্টগ্রাম শহরে ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়েছে ক্রিকেট একাডেমি। এবার যোগ হয়েছে ফুটবল একাডেমিও। কিন্তু এসব একাডেমি যারা পরিচালনা করছেন-তারা আদৌ একাডেমি কি জিনিস সেটা বুঝে কিনা প্রশ্ন তুলেছেন অনেক ক্রীড়াবিদ। তাদের মতে, একাডেমি শব্দটার অর্থ ব্যাপক। এটা চাট্টিখানি কোনো কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একাডেমি নাম দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিলেও শিশুদের জন্য নেই কোনো খেলার ব্যবস্থা। যেনতেনভাবে ব্যাট-বল দিয়ে কিছুটা সময় পার করতে পারলেই যেন খেলা শেখানোটা শেষ। ছোট্ট একটা মাঠে ফুটবল-ক্রিকেট মিলিয়ে খেলছে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিশু-কিশোর। একজনের গায়ের সাথে লেগে আছে আরেকজন। এতদিন এই মাঠে কেবল ক্রিকেটারদের প্রশিক্ষণ হতো। এবারে সেখানে যোগ হয়েছে ফুটবল একাডেমি। কিন্তু ২০০ ফুটের একটি মাঠে যখন দেড় শতাধিক শিশু ফুটবল শিখতে নামে-তখন সেটা কেমন একাডেমি তা বুঝতে কষ্ট হয় না কারো। কোনো ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী ছাড়াই ফুটবল নামের খেলাটি শিখছে শিশুরা। তবে কোচদের মুখে ঠিকই মাস্ক রয়েছে। করোনার কারণে গতকাল বাতিল করা হয়েছে এইচএসসি পরীক্ষা। কিন্তু একাডেমির নামে যারা খেলা শেখার স্কুল খুলে বসেছে-তাদের যেন কোনো শঙ্কা নেই। বাচ্চাদের নিয়ে চরম ঝুঁকির মাঝে খেলিয়ে যাচ্ছেন তারা। একটিবারের জন্যও তাদের মাথায় ঢুকছে না এই বাচ্চাগুলো কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে। কিন্তু একাডেমি মালিকদের কাছে অর্থটাই যেন বড় ব্যাপার।
গতকাল বিকেলে সিজেকেএস প্যাভেলিয়নের সামনের অনুশীলন মাঠটা একেবারে ভরপুর দেখা গেছে। চারপাশে চলছে ক্রিকেট প্রশিক্ষণ। আর তার মাঝে ফুটবল প্রশিক্ষণ। কার বল কোন দিকে যাচ্ছে-তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দূর থেকে বাচ্চাদের ফুটবল প্রশিক্ষণ প্রত্যক্ষ করছিলেন কয়েকজন সাবেক জাতীয় ফুটবলার। বেশ আফসোসের সুরেই তারা বললেন, এটা কি করা হচ্ছে বাচ্চাদের নিয়ে। এটা কি ফুটবল বা ক্রিকেট শেখানো হচ্ছে, নাকি বাচ্চাগুলোকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তারা বলেন, এখানে ফুটবল শেখা কোনোমতেই সম্ভব নয়। তবে যেটা হবে তা হচ্ছে, বাচ্চারা কিছুটা গা নাড়াচাড়া করতে পারবে।
চট্টগ্রামে ক্রিকেট একাডেমির ইতিহাস বেশ পুরোনো হলেও সম্প্রতি আত্মপ্রকাশ করেছে একটি ফুটবল একাডেমি। আবার সে একাডেমির যারা মূল উদ্যোক্তা, তাদের ফুটবল জ্ঞান কতটুকু তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। গতকাল একাধিক সাবেক জাতীয় দলের ফুটবলার বলেন, করোনার মাঝে এভাবে গাদাগাদি করে অনুশীলন করাটা রীতিমত অন্যায়। যেখানে বড়দের ফুটবল আয়োজন করতে গিয়ে হাজারো সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হচ্ছে সিজেকেএসকে, সেখানে কতগুলো বাচ্চাকে মাঠে নামিয়ে
ফুটবলার বানানোর চেষ্টা রীতিমত হাস্যকর।
ফুটবল একাডেমির এক কমকর্তা জানান, প্রতিটি বাচ্চার কাছ থেকে ভর্তি ফি বাবদ নেওয়া হয়েছে ৫০০ টাকা। আর প্রতি মাসের বেতন ২০০ টাকা। এর মধ্যে প্রায় দুইশর বেশি বাচ্চা ভর্তি হয়েছে। যদিও নিয়মিত অনুশীলনে আসে ১৩০ জনের মত।
এ ব্যাপারে দেশের শীর্ষ স্থানীয় দুই ফুটবল কোচ বলেন, এদের একাডেমি বলা যাবে না। বড়জোর কোচিং সেন্টার বলা যেতে পারে। কারণ একাডেমি যেনতেন ব্যাপার নয়। করোনায় যেখানে সবকিছু বন্ধ, সেখানে বাচ্চাদের নিয়ে একাডেমি নামক কোচিং সেন্টারগুলোর এ কেমন মশকরা।
এই কোচদের মতে এরকম কোনো স্কুলে ফুটবল শেখানোটাও অন্যায়। যদিও একাডেমির কোচ শামসুদ্দিন জানান, ফুটবলাররা এভাবেই শিখে। কারণ যেখানে মাঠের অভাব, সেখানে এছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। বাচ্চাদের জন্য বড় মাঠ ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না বলেও জানান তিনি।
শামসুদ্দিনের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করেন সিজেকেএস-এর একাধিক কর্মকর্তা। তারা বলেন, যারা একাডেমি করেছে, তারা তো নিজেদের ব্যবসার জন্য করেছে। তাদের ব্যবসার জন্য কেন সরকারি বা রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ব্যবহার করার সুযোগ দেওয়া হবে? দেশের কোনো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি সরকারি স্থাপনা ব্যবহার করে? নিজেদের সামর্থ্য না থাকলে একাডেমির নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসতে বলেছে কে? তাদের মতে, যে মাঠে এখন বাচ্চাদের অনুশীলন করাচ্ছে, সে মাঠও কেড়ে নেওয়া উচিত।
তারা আরো বলেন, করোনার মাঝে যেখানে বড়দের ফুটবল টুর্নামেন্ট করতে গিয়ে আমাদের গলদগর্ম হতে হচ্ছে, নানা ঝুঁকি থেকে রেহাই পেতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি থাকছে না, সেখানে ধুলা-বালির মাঝে বাচ্চাদের নামিয়ে দিয়ে তারা রীতিমত ক্রাইম করছে। অবিলম্বে এসব একাডেমির অনুশীলন বন্ধ করে দেওয়া উচিত। বাচ্চাদের জীবন নিয়ে খেলার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
এছাড়া ক্রিকেট একাডেমিগুলোও একই কাজ করছে স্টেডিয়াম এলাকায়। কোনো ধরনের নিরাপত্তার বালাই নেই বাচ্চাদের জন্য। উঁচু-নিচু, ধুলা-বালির মাঠে যে যার মত অনুশীলন করছে। কার বল কোনদিকে যাচ্ছে-সেদিকে কারো কোনো খেয়াল নেই। একদল দৌড়াচ্ছে পাকা রাস্তার ওপর। এর যে ফলে শিশুদের পায়ে আঘাত পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, সেদিকেও যেন খেয়াল নেই এসব একাডেমি মালিকদের। বাচ্চাদের জীবনের চাইতে তাদের কাছে অর্থটা যেন বড় হয়ে গেছে। আর অভিভাবকরাও ক্রিকেটার বা ফুটবলার বানানোর নেশায় সন্তানদের ঠেলে দিচ্ছেন ঝুঁকির মুখে। কিন্তু এসব একাডেমি থেকে শেষ পর্যন্ত কি বের হচ্ছে-সেটা একেবারেই পরিষ্কার।