একমাত্র সচেতনতাই পারে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করতে

ডা. দুলাল দাশ | শনিবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২৫ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

কিডনি রোগ নিয়ে এই লেখাটা বর্তমানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যক। কারণ নীরব ঘাতক কিডনি রোগ এ দেশে মহামারি পর্যায়ে আসার অপেক্ষায় আছে। ধ্বনিত হচ্ছে অশনি শংকেত। কিডনি রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তাই প্রত্যেকের প্রতি বিশেষ করে দরিদ্রদের প্রতি আবেদন থাকবে একমাত্র স্বাস্থ্যসচেতনায় আপনাকে ৬০৭০ ভাগ এই রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে। নচেৎ নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্রদের নিশ্চিত মৃত্যু। সুতরাং সাবধানতার মাইর নাই কিডনি রোগকে নীরব ঘাতক বলা হয়। কারণ কিডনি যতক্ষণ ৭০৮০ ভাগ রোগগ্রস্ত না হবে তার কোন লক্ষণই বোঝা যাবে না। যেহেতু লক্ষণ থাকে না তাই লোকেরা ডাক্তারের কাছে যায় না। তাতে চিকিৎসা পেতে দেরি হয়। কিডনি রোগের একপর্যায়ে ডায়ালাইসিস (মেশিনে রক্ত পরিষ্কার করা) ও কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়া রোগিকে বাঁচানো যায় না। খুবই ব্যয়বহুল চিকিৎসা। দেশের বিপুল সংখ্যক ৮০% লোক বুঝতে পারে না তাদের কিডনি রোগ আছে। কিডনি মানবদেহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিডনিকে মানবদেহের ছাকনি বলা হয়। পেটের দুই পাশে এদের অবস্থান। একটা ডান কিডনি অন্যটা বাম কিডনি। এটা রক্ত শোধনোর মাধ্যমে প্রশাবের সাহায্যে শরীর থেকে বর্জ্য অপসারণ করে কোনো কারণে এর ব্যাঘাত ঘটলে রোগের আবির্ভাব হয়। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে প্রায় চার কোটির মত লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। বছরে ৩০ হাজার কিডনি রোগি শেষ পর্যায়ে। হাসপাতালে ভর্তি রোগিদের মধ্যে ৫৭% দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগি প্রতি বছর কিডনি বিকল হয়ে ৪০ হাজার মানুষ মারা যায়। সুতরাং খুবই ভয়াবহ অবস্থা। তাই একমাত্র সচেতনতাই পারে এই রোগকে প্রতিরোধ করা। এই রোগের আকষ্মিক লক্ষণগুলো হলো প্রশ্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া বা প্রশ্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া। প্রশ্রাবের রং গাঢ় হওয়া, শরীরে পানি জমে যাওয়া। পা ও মুখ ফোলা, শ্বাস কষ্ট, ক্লান্তি, বমি, রক্তচাপ কমে যাওয়া, যারা কিডনি রোগে ভুগছেন, তাদের পিটে ব্যথা উপরের দিকে নয়, নিচের দিকে, এটার গুরুত্ব দিতে হবে। বার বার প্রশ্রাব করা, মাঝে মধ্যে প্রশ্রাবের সাথে রক্ত যাওয়া, বা প্রশ্রাবের সাথে অতিরিক্ত ফেনা, ওজন কমে যাওয়া। কিডনি রোগের সাধারণ কারণগুলো হল নেক্‌নাইটিস, ইনফেকশ (সংক্রমণ), ডায়রিয়া, পানিশূন্যতা, অতিরিক্ত রক্তকরণ এইগুলির চিকিৎসা অবহেলা হলে কিডনি রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিষাক্ত খাবার বিষ, দোকান থেকে অযথা ব্যথানাশক ওষুধ কিনে খাওয়া, প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিব্যায়োটিক ব্যবহার প্রভৃতি। এছাড়া জন্মগত কিছু ত্রুটির কারণে কিডনি বিকল হতে পারে। আমাদের দেশে কিডনি রোগের চিকিৎসায় অনেক উন্নতি হয়েছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রের মাধ্যমে পেট না কেটে কিডনির পাথর, মুত্রনালীর পাথর, মুত্রথলির পাথর বাহির করা হয়। বিশ্বমানের সফলতা দাবি করা যায়। সফলতার সাথে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। উপযুক্ত সময়ে এই পাথরগুলি অপারেশন না করলে অতিদ্রুত কিডনি অকার্যকর হয়ে যাবে, এমনকি কিডনি ফেলে দিতে হবে। তাই এখানেও সচেতনতার খুবই দরকার এবং জরুরি। শুধু অবহেলা এবং আর্থিক কারণে কত রোগির জীবন রক্ষার্থে কিডনি ফেলে দিতে হয়। কারণ এই পাথর বা টিউমার প্রশ্রাবের গতিপথ বাধাগ্রস্ত করে ফলে কিডনিতে পানি জমে, পুইজ জমে কিডনি নষ্ট হয়ে যায়। কিডনি রোগের অন্যান্য কারণের মধ্যে ডেঙ্গু, কলেরা, সেপটিসেমিয়া (রক্তকরণ)। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রাপ্ত বয়স্কদের কিডনিরোগের প্রধান দুইটি ক্রণ ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ। যাদের দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ থাকে তারা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। কিডনির কার্যকারিতা ভালো আছে কিনা নিয়মিত দেখা সচেতনতার মধ্যে পড়ে। রক্তে ক্রিয়োটিনিন, ইলেকট্রোলাইট, ব্লাড ইউরিয়া, জিএফআর পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রক্তচাপ, রক্তে শর্করার মাত্রা দেখা উচিত। ধূমপান, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভাস, প্রতিদিন বেশি বেশি প্রোটিন খাওয়া, অতিরিক্ত লবণ, পরিশ্রমহীন জীবন, স্থুলতা, হৃদরোগের পূর্ববর্তী ইতিহাস প্রভৃতি। ডায়াবেটিসকে বিশেষভাবে টার্গেট করা হয়েছে। কারণ ২০২৫ সালের মধ্যে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে। ডায়াবেটিক কিডনি রোগ বেড়ে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে পরিণত হতে পারে। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগিরা আরও বেশি সচেতন হউন। কিডনি সুস্থ রাখার উপায় রক্তে গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখা। রক্তে অ/প পরীক্ষা (লক্ষ্য ৭% নিচে) রক্তচাপ ১৪০/৯০ মি.মি.এম এর নিচে। নিযমিত শারীরিক পরিশ্রম, ওজন ঠিক রাখা, লবণ সীমিত খাওয়া, অ্যালকোহল পরিহার, পাতলা লবণ না খাওয়া, প্রতি সকালে খালিপেটে ২৩ গ্লাস পানি পান করা, প্রশ্রাব উঠলে ধরে না রেখে সাথে সাথে করে ফেলা, অতিরিক্ত প্রোটিন (মাংস) জাতীয় খাবার কিডনীর প্রতিকারক। টেলিফোন করলে জ্যাক ফুড বাসায় দিয়ে যায় যা ক্ষতিকর। একজন সুস্থ ও স্বাভাবিক লোক শুধু পানি খাওয়ার অভ্যাস করলে এই রোগ থেকে মুক্ত থাকা যায়। সাধারণ নাগরিক ও গরীবদের জন্য বলা যায় শুধু প্রশ্রাব ও একটু রক্ত পরীক্ষা করলে কিডনি ভালো আছে কিনা বুঝা যায়। সারাদেশে গড়ে সাড়ে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক আছে ও হাসপাতাল আছে। সেখানে বিনাপয়সায় এই পরীক্ষাগুলো করান। ২৫ বছর বয়স থেকে রাজু মিঞার উচ্চ রক্তচাপ। কিন্তু সে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে তার কিডনি অকেজো হয়ে যায়। রাজু মিঞার মত হাজার হাজার ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগি আছে যারা শুধু অবহেলার কারণ। চিকিৎসা নেয় না। নিয়মিত ওষুধ খায় না, খাদ্যভাস পরিবর্তন করে না, কোনো নিয়ম পালন করে না আস্তে আস্তে তাদের কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। তখন উপায়ন্ত না দেখে হাসপাতাল ও ডাক্তারের কাছে ছুটে। তখন ডাক্তারের কিছুই করার থাকে না। ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন একমাত্র চিকিৎসা। পরিসংখ্যান বলছে ১৯৯০ সালে অন্যান্য রোগ অনুপাতে কিডনি রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৯তম। বর্তমানে সেটা ৭ম স্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। সচেতনতার সুরে বলছি কিডনি রোগ শরীরে বাসা বাঁধলে হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি বেড়ে যায়। আমার জানামতে উচ্চ রক্তচাপের রোগিরা নিয়মিত ওষুধ সেবন করে না, ডাক্তারের পরামর্শ শুনেন না। নিজে নিজে প্রেসারের ওষুধ বন্ধ করে, আবার শুরু করে এবং সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া প্রেসারের ওষুধ বন্ধ করা যাবে না। আশার কথা হলো একটু সচেতন হলে ৬০৭০ ভাগ ক্ষেত্রে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। কিডনি সুস্থ রাখতে হলে চল্লিশোর্ধ্ব সকল নাগরিকের উচিত কিডনি পরীক্ষা করা। যারা উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে ভুগছেন তাদের কিডনিকে অবহেলা নয়। মনে রাখবেন প্রশ্রাবের ইনফেকশন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের প্রাথমিক মহোষুধ বিনাপয়সায় পানি। প্রতিদিন প্রচুর পানি সেবন করুন। ইনফেকশন চলে যাবে। পাথর বাহির হয়ে যাবে। চিকিৎসকের নিকট গিয়ে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতে হবে না। শিশুদের চর্ম রোগ থেকে ইনফেকশন হয়ে কিডনি রোগ হতে পারে, তাদের পা, মুখ ফুলে যায়। পেটে পানি আসে, তাই অবহেলা না করে অতিদ্রুত চিকিৎসা করা দরকার।

লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধমুরগির খামারে সফল কাপ্তাইয়ের কালিময় তনচংগ্যা