বিদ্যুতের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে চলমান লোডশেডিংয়ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এই মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতির আশার কথা শুনিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। গতকাল সংসদে তিনি বলেছেন, আমরা মনে করি, ১৫ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আপনারা সকলেই একটু ধৈর্য ধরেন। বিশ্বের দিকে ও নিজের দেশের দিকে তাকিয়ে যদি আমরা ধৈর্য ধরি, তাহলে যে সমস্যাটা দেখতে পাচ্ছি, সেটা পার হতে পারব। খবর বিডিনিউজের।
কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশের সর্ববৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি এই মাসেই সচল করার আশা করছেন নসরুল। দেশে আরও বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালুর পাশাপাশি ভারত থেকে আমদানি বাড়ানোর কথাও বলেন তিনি। জাতীয় সংসদে ২০২২–২৩ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের মঞ্জুরি দাবির ওপর ছাঁটাই প্রস্তাবের উপর সংসদ সদস্যদের বক্তব্যেব জবাব দিতে গিয়ে চলমান বিদ্যুৎ সংকট নিয়ে কথা বলেন তিনি। খবর বিডিনিউজের।
চলতি অর্থবছরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের জন্য ৩২ কোটি ৪৬ লাখ ৪ হাজার টাকা মঞ্জুরি দাবি করেন নসরুল হামিদ। তার এ দাবিতে ছাঁটাই প্রস্তাব দেন ১০ জন সংসদ সদস্য। তবে আলোচনায় অংশ নেন ছয়জন। বাকিরা অনুপস্থিত ছিলেন।
বিদ্যুৎ সংকটের ব্যাখ্যা দেওয়ার আগে গত দুই যুগে এই খাতের উন্নয়নের কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, বেশিদিন আগের কথা নয়, ১৪ বছর আগের কথা। প্রায় ৬০% বাংলাদেশ অন্ধকারে ছিল। ১৬ ঘণ্টা, ১৮ ঘণ্টা, ১৯ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকত না। সেখান থেকে আমরা শতভাগ বিদ্যুতায়ন করেছি। সংসদ সদস্যরা স্বীকার করেছেন, বিদ্যুৎ গ্রাম–গঞ্জে ছড়িয়ে গেছে। আমরা সঞ্চালন লাইন করেছি। আমরা যে কোনো মুহূর্তে ২০ থেকে ২২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারি।
বিদ্যুতের এই অগ্রগতিতে ছেদ টানার জন্য কোভিড মহামারী এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে দায়ী করে তিনি বলেন, দুই–তিন বছর কোভিডে আক্রান্ত ছিল সারা বিশ্ব। এরপর এল রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা বিশ্বের সমস্ত কিছুর দাম বেড়ে গিয়েছিল। গ্যাস ও তেল পাওয়া যাচ্ছিল না। তারপরও আমরা চেষ্টা করেছি, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে কীভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি রাখা যায়। বিশ্বের বাজার কখন কী হবে ধারণা করা যাচ্ছে না। নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি পাব কি পাব না, নিজেদের জ্বালানি যতটুকু আছে সর্বোত্তম ব্যবহার করছি আমরা।
লোডশেড আকস্মিক : প্রতিমন্ত্রী জানান, বর্তমানে দিনের বেলায় ১২ হাজার থেকে সাড়ে ১২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। পিক আওয়ারে সন্ধ্যায় করা যাচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। দুই থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি থাকছে, যার কারণে লোডশেডিং হচ্ছে।
লোডশেডিং কোথায় কতটা হবে, জনগণের প্রস্তুতির জন্য তা জানিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি। সকলকে জানিয়েছি, কোথায়, কীভাবে হবে এবং মিডিয়াতে বলা হয়েছে বারবার। লোডশেডটা আকস্মিক, এটা বেশিদিন থাকবে না। এই আকস্মিকতার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করেছি।
বিদ্যুৎ বিভাগের প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা বিল বকেয়া থাকার তথ্য তুলে ধরে নসরুল বলেন, অনেকেই বিল দিচ্ছে না, কেন হলো? সেটা হলো করোনার কারণে। করোনার সময় আমরা বিল নিইনি।
মধ্যরাতে বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের ব্যবহার হয় জানিয়ে তিনি বলেন, অটোরিকশা সাড়ে ৩ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ নিয়ে যায়। আমরা তো বন্ধ করিনি। সেগুলোও চালু রেখেছি, যাতে সাধারণ মানুষ সেটা ব্যবহার করতে পারে। ৪০ লাখের মতো অটোরিকশা আছে দেশে।
জ্বালানি খাতে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী বলেন, তেলে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা সব মিলিয়ে। এই বছরে ২৪ থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি যাবে খালি বিদ্যুৎ খাতে। আমরা তো সমন্বয় করতে পারতাম। কিন্তু সেটা করিনি। প্রধানমন্ত্রী চাচ্ছেন সকলের কাছে যাতে বিদ্যুৎটা পৌঁছায়। এ কারণে আমি মনে করি, সকলকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে।
১৫ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক : পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংকটে পড়ার বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, আমরা সময়মতো কয়লার জন্য এলসি করতে পারিনি। যার কারণে পায়রার এ অবস্থা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে প্ল্যান্ট চালু করে দেব। নতুন পাওয়ার প্ল্যান্ট চালু হবে, পায়রা চালু হবে। রামপাল চলছে। এসএস পাওয়ার চালু হয়ে যাবে, মহেশখালীরটা চালু হয়ে যাবে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আনা হচ্ছে। আরও নিয়ে আসা হবে।
বৈশ্বিক জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় অর্থের জোগানটা সময়সাপেক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এটা বেশি দিনের জন্য নয়। আমরা মনে করি, ১৫ থেকে ১৬ দিনের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আপনারা সকলেই একটু ধৈর্য ধরেন। একটু সমস্যা হয়ে গেছে, এই মাসের মধ্যে সমাধান করতে পারব।
বিরোধী দলের ক্ষোভ : তার আগে ছাঁটাই প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সদস্যরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, লোডশেডিং যেভাবে বাড়ছে তাতে জনরোষের সৃষ্টি হতে পারে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ফখরুল ইমাম বলেন, আমাদের ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার, কিন্তু করে ফেলেছি ২৬ হাজার মেগাওয়াট। আর আজকে উৎপাদন হচ্ছে ৭ হাজার মেগাওয়াট।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, এই লোডশেডিং আরও বাড়বে। বিল পরিশোধের কারণে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছেন। বিদ্যুৎ বিল তো মানুষের বাকি নেই। গ্রাহকরা তো সবাই বিল দিচ্ছেন। তাহলে এই বিল কেন বাকি থাকছে? বিএনপির আমলে বিদ্যুৎ ছিল না, খাম্বা ছিল। এখন বিদ্যুৎ আছে, খাম্বা নেই। ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। টাকা শর্টেজ। সরকারের ধারাবাহিক সাফল্যের একটি জায়গা ছিল বিদ্যুৎ। সেটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেল। এর থেকে তো আমি মনে করি জনরোষের সৃষ্টি হবে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রওশন আরা মান্নান বলেন, কবে যে আবার লোডশেডিং কমবে। এখন যেভাবে বিদ্যুৎ সমস্যা দেখা দিচ্ছে, আগামী ১০ বছর পরে আমাদের গ্যাসও শেষ হয়ে যাবে।
জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না। বিদ্যুৎ না থাকলে দেশের অগ্রগতি থেমে যাবে। কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। সমস্ত জায়গায় স্থবিরতা তৈরি হবে। বিদ্যুৎ মন্ত্রী গোটা বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দিয়েছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু হঠাৎ করে কী হলো যে বিদ্যুৎ চলে গেল। আগেই যদি কয়লা বা ডিজেল আমদানি করা যেত, আজকের এই সমস্যা হতো না। আমাদের মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।
রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, জনগণকে কনভিন্স করতে হবে। গণশুনানি করে বিষয়টি জানাতে হবে। লোডশেডিংয়ের তথ্য জানাতে হবে। কোথায় অববস্থাপনা রয়েছে সেটা দেখতে হবে।