ডাক্তারের কাছে যাওয়ার আগে এখন আর রোগী মারা যায় না উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ গ্রামে। হোস্ট কমিউনিটির জন্য বরাদ্দ টাকায় নির্মিত নতুন রাস্তা বদলে দিয়েছে এসব গ্রামের লাখো মানুষের জীবন। কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরে উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের টিলা ও পাহাড়ি উপত্যকাসমৃদ্ধ প্রত্যন্ত গ্রাম হরিণমারা ও বাঘঘোনা। গ্রাম দুটোর নামকরণ দেখে বোঝা যায়, এখানে একসময় বাঘ-হরিণের বিচরণ ছিল। এখানকার বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে কিছু জলাভূমিও চোখে পড়ে। সিঙ্ক হোলের কারণে ভূমি ধস তৈরি এসব জলাভূমিতে একসময় হরিণেরা পানি পান করতে এসে বাঘের হাতে প্রাণ দিত বলে ধারণা বিজ্ঞানী-গবেষকদের। অবশ্য এখনও এসব জলাভূমিতে নানা ধরনের দেশী ও অতিথি পাখির বিচরণ দেখা যায়। অথচ এমনই একটি শান্তশিষ্ট, উর্বর ও সুন্দর জনপদের অধিকাংশ বাসিন্দার জীবন কিনা বেড়ে উঠছে চিকিৎসার অভাবে স্বজন হারানোর বেদনাময় স্মৃতি নিয়ে। গত সপ্তাহে এই গ্রাম পরিদর্শনে গিয়ে কথা হয় বিধবা রোকিয়া, আনোয়ারা ও বিপত্নীক সোলতান আহমদের সাথে। সোলতানের গর্ভবতী স্ত্রী গত মাসে ৩ শিশু সন্তান রেখে মারা যান হাসপাতালে নেয়ার পথে। বিধবা রোকিয়া ও আনোয়ারার স্বামীও মারা যান কয়েক বছর আগে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে।
তারা জানান, অসুস্থ রোগীকে কোলে করে প্রায় এক কিলোমিটার দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তারপর গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিতে হয়। আর এই সময়ের মধ্যে রোগী মারা যান। অথচ মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে রাজাপালং সদরে রয়েছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। এছাড়া ৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ভালো চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে।
হরিণমারার মতোই একই সমস্যায় ভুগছিলেন একই ইউনিয়নের পাতাবাড়ি বড়ুয়া পাড়ার লোকজন। এখানে পাহাড়ি ঢলে রাস্তা বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অগ্নিকাণ্ডের সময় দমকল বাহিনীর গাড়ি ঢুকতে না পেরে কয়েক মাস আগেও এ পাড়ার সুশীল বড়ুয়ার বসতবাড়ি পুড়ে যায়। তবে বড়ুয়া পাড়ার এই সড়কটি এখন মেরামত করা হচ্ছে। খালের ভাঙন রোধে রাস্তার পাশে গাইডওয়ালও দেয়া হয়েছে। হরিণমারা গ্রামেও পৌনে এক কিলোমিটার নতুন ইটের রাস্তা ও কালভার্ট নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। হোস্ট কমিউনিটির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থে বেসরকারি সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন এসব রাস্তা-কালভার্ট- গাইডওয়াল নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করছে বলে জানান রাজাপালং ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী। তিনি জানান, ওসব গ্রামে এখনই গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে।
ওয়ার্ল্ড ভিশনের বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ক্রাইসিস রেসপন্স (বিআরসিআর) এর কক্সবাজার অফিস ইনচার্জ আব্দুল মোক্তাদির জানান, ইউএসএআইডি’র আর্থিক সহযোগিতায় ওয়ার্ল্ডভিশনের জরুরি খাদ্য নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে উখিয়া-টেকনাফের ৫ ইউনিয়নে হরিণমারা-বড়ুয়া পাড়ার মতোই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য রাস্তাঘাট, ড্রেন, কালভার্ট, কাঠের সেতু, বাঁধ, ভাঙনরোধ ব্যবস্থা ও খাল খননের মতো মোট ১১০টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে প্রায় তিন মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে। যার মধ্যে রাজাপালং ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ৩৪টি প্রকল্প। এর মধ্যে ২৭টির কাজ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। আর বাকি ৭টির কাজ চলমান রয়েছে।
একই কর্মসূচির অধীনে উখিয়া উপজেলার পালংখালীতে ২০টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে ১৬টি প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন শেষ হয়েছে। জালিয়াপালং ইউনিয়নে ১৫ প্রকল্পের মধ্যে ১১টি কাজ শেষ হয়েছে, বাকি ৩টির কাজ চলমান আছে। এছাড়া টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নে ২৪টি প্রকল্পের মধ্যে ২১টির কাজ এবং হ্নীলা ইউনিয়নে ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১৪টির কাজ শেষ হয়েছে, বাকি প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। চলমান কাজগুলোও আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি।
তিনি জানান, প্রকল্পের অধীনে দুই উপজেলায় মোট ৩২ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে, যার মধ্যে শেষ হয়েছে প্রায় ২৬ কিলোমিটার, চলমান রয়েছে ৭ কিলোমিটার। এছাড়া ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ৬ কিলোমিটার, বাস্তবায়ন করা হবে মোট ৪ দশমিক ৬২৯ কিলোমিটার। ‘ক্যাশ ফর ওয়ার্ক’ বা ‘কাজের বিনিময়ে অর্থ’ কর্মসূচির অধীনে স্থানীয়রাই নিজেদের রাস্তা নিজেরা নির্মাণ করছে। এরজন্য তারা প্রশিক্ষণও পেয়েছে। ‘কাজ নেই মজুরি নেই’ ভিত্তিতে এই ধরনের ৪ হাজার ৭৮৩ জন বাসিন্দা এখন প্রকল্পটির অধীনে নিয়োজিত রয়েছে। যারা দৈনিক ৩৫০ টাকা মজুরি ভিত্তিতে মাসে ১৬ দিন কাজ করে। এছাড়া আরো ৪৪৬ জন প্রতিবন্ধী অথবা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকেও প্রকল্পটি থেকে বিনাশ্রমে একই পরিমাণ অর্থ দেয়া হচ্ছে বলে জানান ওয়ার্ল্ড ভিশন কর্মকর্তারা।
গত সপ্তাহ হরিণমারায় রাস্তা নির্মাণ কাজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ল্ড ভিশন নিয়োজিত শ্রমিকদের মধ্যে অধিকাংশই নারী। এসব নারী শ্রমিকদের আবার প্রায় সকলেই বিধবা। তাদের মধ্যে টকি শর্মা ও মনজু শর্মা ২ সন্তানের জননী। তারা জানান, কয়েক বছর আগে আকস্মিকভাবে স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তানদের নিয়ে তারা একবেলা-আধবেলা খেয়ে কোন রকমে জীবন ধারণ করেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশনের এই প্রকল্পে নিয়োজিত হওয়ার পর তাদের সংসারে শিশুদের মুখে হাসি ফুটেছে।
রাজাপালং এর ইউপি সদস্য ছৈয়দ হামজার বলেছেন, একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই হরিণমারা-বাঘঘোনার মতোই উখিয়া-টেকনাফের শতাধিক গ্রামের হাজার হাজার মানুষ বঞ্চিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে। তবে রোহিঙ্গা ইস্যুতে হোস্ট কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত টাকায় ভাগ্য বদলাচ্ছে তাদের।
কক্সবাজার-৪ আসনের এমপি শাহীন আকতার চৌধুরী বলেছেন, হোস্ট কমিউনিটির জন্য বরাদ্দ অর্থে উখিয়া-টেকনাফের ৩৩ গ্রামে নতুন রাস্তা, কালভার্ট, ড্রেন নির্মাণ হয়েছে এবং হচ্ছে। এর ফলে বদলে যাচ্ছে এসব গ্রামের লাখো মানুষের জীবন।