একটি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ সম্ভার

রীতা দত্ত | শুক্রবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৪২ পূর্বাহ্ণ

নাসের রহমান একজন মননশীল লেখক হিসেবে সুপরিচিত। সাহিত্যের নানান শাখায় তাঁর স্বচ্ছন্দ প্রকাশ। পেশাগত জীবনে ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মননের শৃঙ্খলা ও রুচির স্নিগ্ধতা নিয়ে নিরন্তর লিখে চলেছেন। ছোটদের বড়দের সকলের উপযোগী করে তিনি লেখেন। ইতোমধ্যে তাঁর ২৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লেখেন ছোট গল্প, ভ্রমণ গল্প, শিশুতোষ গল্পকবিতা যা প্রশংসিত হয়েছে পাঠকমহলে। সম্প্রতি ‘শৈলী প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত হলো তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘সমকালে চিরকালের অনন্তধারা’। এ গ্রন্থে ৩৫টি প্রবন্ধ গ্রন্থিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে, প্রবন্ধ হলো গদ্যের প্রাগ্রসর বন্ধনযুক্ত রচনা কিংবা প্রকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্ত রচনাকে প্রবন্ধ বলা হয়। প্রকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্ত বলতে বুঝায় উত্তমরূপে গঠিত রচনাযে রচনায় থাকে বুদ্ধিদীপ্তি, মনন, উপলব্ধিজাত অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, নিজস্ব ভাবনা এবং সঙ্গতিপূর্ণ যুক্তি। এসব কিছুর শৈল্পিক বন্ধন বা সমন্বয়জাত রচনাই প্রবন্ধ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এ বিচারে নাসের রহমানের প্রবন্ধ গ্রন্থে প্রতিটি প্রবন্ধই উৎকৃষ্টরূপে বন্ধনযুক্ত হয়েছে। তাঁর শব্দচয়ন সহজ, বাক্য সাবলীল। তথ্যের বৈচিত্র্য, মননের স্বচ্ছতা নাসের রহমানের প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য। এতে নেই বর্ণনার ছটা, ঘটনার ঘনঘটাএকেবারে নিরাভরণ। প্রবন্ধগুলো একাধারে বস্তুনিষ্ট আবার ব্যক্তিনির্ভরও বটে। কখনো সমকালের ঘটে যাওয়া বিষয়আশয় আবার কখনো তাঁর ব্যক্তিগত অনুভবের অভিব্যক্তি এসব প্রবন্ধে প্রকাশ পেয়েছে।

গ্রন্থের ভূমিকায় ড. শিরীণ আখতার, প্রাক্তন উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লিখেছেন ‘নাসের রহমান শিক্ষক নন কিন্তু আলোচ্য গ্রন্থে শিক্ষা, শিক্ষার্থী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ক তাঁর বেশ কিছু লেখা আমাকে আকৃষ্ট করেছে।’ তাঁর প্রবন্ধগুলোকে বিভিন্ন পর্যায়ে সন্নিবেশিত করা যেতে পারে। পারিবারিক জীবন, সমাজে ঘটে যাওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়আশয়, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা, বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ, স্বপ্ন সেতু পদ্মা, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা। ‘ছোট গল্পে অমর একুশে’, ‘তরুণ প্রজন্মের মানবিকতা’, ‘দ্রব্যমূল্যের কশাঘাতে সাধারণ মানুষ’, ‘সর্বকালের কবি নজরুল ইসলাম’, ‘বেগম রোকেয়া স্মৃতি বিজড়িত’, ‘আশ্রমের নাম আপন নিবাস’ ইত্যাদি প্রবন্ধ এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।

প্রথম প্রবন্ধটি ‘চিরকালের পারিবারিক বন্ধন’। আমরা জানি পরিবার হচ্ছে সমাজের সামাজিকীকরণের প্রথম স্তর। মানবশিশু বেড়ে উঠে পরিবারে মাবাবা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের আদরে যত্নে। মাবাবার প্রত্যাশা থাকে সন্তানটি ভালো মানুষ হবে। অধিকাংশ মাবাবা চান তার সন্তানটি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু, পরবর্তীতে দেখা যায় যথেষ্ট পড়ালেখা করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাবাবার সাথে যে অকৃত্রিম বন্ধন ছিলো তা ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে পড়ে। একান্নবর্তী পরিবার তো উঠেই গেছে। এক পর্যায়ে মাবাবার স্থান হয় বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ পর্যন্ত দেখা যায় বৃদ্ধ বয়সে মাবাবা আপন ভূমিতে পরবাসী হয়ে যান এবং বৃদ্ধাশ্রমই আপন ভূবন হয়ে ওঠে। এই বিষয়গুলো লেখক অত্যন্ত আবেগের সাথে উল্লেখ করেছেন। ‘তরুণ প্রজন্মের মানবিকতা’ এখানে তিনি লিখেছেন, আমাদের তরুণেরা যথেষ্ট পরিমাণ মেধাবী, পড়ালেখা করছে কিন্তু এক পর্যায়ে গিয়ে তারা মানবিক মূলবোধগুলো হারিয়ে ফেলছে এবং অসামাজিক কাজে নিজেদেরকে জড়িত করছে। অতিরিক্ত মোবাইল প্রীতি আমাদের সন্তানদের ক্ষতির কারণ হয়েছে। প্রতিদিনই পত্রিকায় এধরনের খবর ছাপা হয় যা আমাদেরকে ব্যথিত করে। আমাদের শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টার নির্ভর হয়ে পড়েছে। পাঠ্যপুস্তকের গভীরে তারা প্রবেশ করে না, নোট মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করে। ফলে কাঙ্ক্ষিত জ্ঞান অর্জন হয় না। এতে করে পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা বিপর্যয়গ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা যথাযথ মনোযোগ দিয়ে পাঠদান করেন না (অবশ্য কিছু ব্যতিক্রম আছে)। প্রাইভেট কোচিং এর দিকে মনোযোগী তারা। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে।

স্বপ্ন সেতু পদ্মা’ এবং ‘পদ্মা এখন সেতুর নাম’ এই দুটি প্রবন্ধে তিনি অত্যন্ত সাবলীলভাবে স্বপ্ন সেতু পদ্মাকে নিয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘হাজার বছরের বাঙালি। আরো কয়েক হাজার বছর আগে থেকে পদ্মা নদী। পদ্মার দু’পারের মানুষের সুখদুঃখের সাথে পদ্মা মিশে আছে। পদ্মাই তাদের জীবিকার সন্ধান দেয়, বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়, পদ্মা নদীতে মাছ ধরে জীবন চালায়।’ আমরা পড়েছি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সাহিত্যচর্চায় বেশ কিছু সময় পদ্মার পাড়ে কাটিয়েছেন। তাঁর গল্পগুচ্ছের অধিকাংশ গল্পই এই পদ্মাপাড়ের মানুষের সুখদুঃখের কাহিনী। পদ্মার পাড়ে পাড়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন এবং গল্পের উপাদান সংগ্রহ করতেন। সেই পদ্মার উপরই এখন সেতু নির্মিত হয়েছে। রাজধানী ঢাকার সাথে খুলনা, ফরিদপুর সহ ২১টি জেলার যোগাযোগ অনেক সহজ করে দিয়েছে এই সেতু। এছাড়া ব্যবসাবাণিজ্য অনেক সহজ হয়েছে এই সেতুর কল্যাণে। পদ্মা এখন সুপরিচিত হয়েছে সেতুর কারণে। লেখক যেহেতু ব্যাংকিং পেশায় ছিলেন প্রাসঙ্গিকভাবে তিনি ‘‘ব্যাংকের সাফল্য ও অগ্রগতি ও আস্থা’’ প্রবন্ধ লিখেছেন। লেখাটি অত্যন্ত তথ্যনির্ভর, সুচিন্তিত, সাবলীল যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য।

ছোট গল্পে অমর একুশে’ এ প্রবন্ধে লেখক আমাদের মহান ভাষা আন্দোলন অমর একুশে যে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার অনুপঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন। একুশে আমাদের চেতনার নাম, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার স্মারক। এ দেশের লেখকরা একুশের চেতনাকে সমৃদ্ধ করে তুলেছেন তাঁদের লেখনীর মাধ্যমে। এ প্রবন্ধে কথাশিল্পী শওকত ওসমানের গল্প ‘মৌন নয়’ আনিস চৌধুরীর গল্প ‘চেতনার চোখ’, মাহমুদুল হকের গল্প ‘ছেড়া তার’ সহ বেশ কয়েকটি গল্পের উল্লেখ আছে। ‘সর্বকালের কবি নজরুল ইসলাম’ এ প্রবন্ধে লেখক আমাদের চেতনার কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি প্রেমের কবি, দ্রোহের কবি, যেকোনো অন্যায়অবিচারের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছেন। অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস দেখিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িকতার বরপুত্র আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। ৩৫টি প্রবন্ধের সব কয়টি স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করতে পারিনি তবে সামগ্রিকভাবে গ্রন্থটি সর্বসাধারণের অবশ্য পাঠযোগ্য একটি বই বলে আমি মনে করি। এই বইটি তিনি উৎসর্গ করেছেন দেশের ১১৭ জন বরেণ্য ব্যক্তিবর্গকে যাঁরা তাঁর লেখা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এটি একটি ব্যতিক্রমী প্রয়াস। যা লেখকের সুন্দর মনের পরিচায়ক। তাঁকে দেখেছি একজন পরিশীলিত, সংস্কৃতিবান, স্বল্পভাষী এবং সুবক্তা হিসেবে সর্বোপরি একজন মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ হিসেবে। আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী মোমিন উদ্দীন খালেদ। আমি লেখকের সুস্বাস্থ্য এবং অব্যাহত সৃজনশীলতা কামনা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসুফিবাদ পৃথিবীর সকল মানুষের কল্যাণে কাজ করে : সিটি মেয়র
পরবর্তী নিবন্ধএকটি অভাবনীয় প্রকাশনা প্রসঙ্গে