‘মৃত্যু কী সহজ, কী নিঃশব্দে আসে। অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়’।– সমরেশ মজুমদারের একটি লেখায় পড়েছিলাম। মৃত্যু যখন মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’ এই চিরায়ত বাণীকেই অবলম্বন করে আবারো প্রাণপণে বেঁচে থাকতে চায় মানুষ। আজ বাস্তবতার মুখোমুখি একটি প্রত্যক্ষ ঘটনা বলছি। এইতো সেদিন নগরীর জামাল খান লেনে এক বহুতল ভবনে গিয়েছিলাম গান রেকর্ডিং এর জন্য। লিফটের সামনে দাঁড়াতেই ৭ এর বাটন চাপ দিলাম। সাথে আরো দুজন ছেলে ছিলো। যথারীতি লিফ্ট নেমে এলে আমরা উঠে পড়লাম। নিচতলা থেকে একতলায় উঠতেই লিফট বাইরের কোনো একটা অংশের সাথে ধাক্কা লেগে থামল। আবার দোতলায় উঠতেই ধাক্কা। এভাবে চার তলায় পৌঁছলাম। চার তলায় লিফট যথারীতি খুলে গেল। কিন্তু বাইরে বেরুনোর রাস্তা বন্ধ। মনে হল চার দেয়ালের মধ্যে আটকে আছি। ওদের কেউ একজন বলল ৭ তলায় চাপ দিয়ে দেখি। কিন্তু না। একই শব্দে ধাক্কা লেগে লেগে উপরে উঠতে লাগলো। এখানেও একই অবস্থা। লিফট খুললেও বাইরে নামার জায়গা বন্ধ। একজন বলল নিচে যেতে হবে মনে হয়। এবার গ্রান্ড ফ্লোরে দিল। যথারীতি প্রতি ফ্লোরে ধাক্কা। লিফট খোলে কিন্তু বেরুনোর পথ বন্ধ। প্রথমে তেমন ভয় না পেলেও পরবর্তীতে প্রচণ্ড ঘামতে শুরু করলাম। ছেলেগুলো প্রথমদিকে আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু অবস্থা দেখে ওরাও ঘাবড়ে গেল। লিফটে কোনো ফ্যান ছিল না। অক্সিজেনের অভাব বোধ করছিলাম। ভিতরে জরুরি তিনটি নাম্বার দেয়া ছিল। একটা নাম্বারেও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। আমার ফোন থেকে যতই চেষ্টা করছি কোনো ফোনে যাচ্ছে না। নিচতলায় নামার পর লিফট থেকে আমরা বলছিলাম, ‘কেউ আছেন? আমরা আটকে গেছি‘। একজন বলল চার তলায় যান ওখানে ঠিক আছে। চার তলায় যেতে আবারো সেই ভয়ংকর ধাক্কা। মনে হচ্ছে ছিঁড়ে পড়বে। কিন্তু চার তলায় এবারও সব বন্ধ। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে। ভাবলাম ছেলেদের সাথে বুঝি আর দেখা হবে না। ঈশ্বরকে স্মরণ করছি। ওরাও আল্লার নাম স্মরণ করছে। সুরা পড়ছে। ততক্ষণে ১২–১৫ মিনিট কেটে গেছে। এই কি তবে জীবনের পরিণতি? হঠাৎ শিল্পীদিকে মোবাইলে পেয়ে গেলাম। বললাম, দিদি আমরা লিফটে আটকে গেছি। দিদি অমনি রেকর্ডিং স্টুডিওতে দীপেনদাকে ফোন দিলেন। দাদা ছুটে এলেন। ওদিকে কিছুক্ষণ পর স্টুডিওতে মুন্নিকে পেলাম। ও ছুটে গিয়ে একই বিল্ডিংয়ে অবস্থিত কাচ্চি ডাইনে খবর দিল। এবার বাইরে হট্টগোল শুনতে পেলাম। ওরা বলছে ‘আপনারা ভিতরে বাটন প্রেস করবেন না’। আমরা ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় হঠাৎ দেখলাম চার তলায় লিফট খুলে গেছে। বাইরের দরজাটাও খুলেছে। কিন্তু ওই দরজা থেকে আমরা অনেকটা নিচে। কয়েক সেকেন্ড যাওয়ার পর অন্যরা বলল ওনাদের তুলে নেন। একটা হাত বাড়িয়ে দিল। আমি ওই হাতটা ধরে ‘বেঁচে আছি‘ সত্যিটা উপলব্ধি করলাম। ওদের দুজনকেও তুলে নিল। অনেক সময় লেগেছিল ট্রমা থেকে বের হতে। মনে পড়ছিল শ্রদ্ধেয় রঞ্জিত রক্ষিত স্যারও লিফটে ধাক্কায় হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন। আর ফিরেননি। নগরীতে এমন অনেক বহুতল ভবনে লিফট রয়েছে যেখানে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্ঘটনা সম্মুখীন হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নষ্ট হলে বোর্ডে লিখে সতর্ক করে দেওয়া কর্তৃপক্ষের প্রধান কাজ। কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার কারো নেই। বিভীষিকাময় সেই ক্ষণ যেন আর কারো জীবনেই না আসে সেজন্য কর্তৃপক্ষকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত বলেছেন ‘জন্মিলেই মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’?- তাই বলে মানুষের সৃষ্ট মৃত্যু ফাঁদগুলো আমাদের জীবন কেড়ে নেবে তা হতে পারে না।