চট্টগ্রাম অঞ্চলে, বিশেষ করে কর্ণফুলীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন গ্রামে বৌদ্ধ বড়ুয়া সমপ্রদায়ের বাস এবং তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতির সাথে মিশে আছেবেশ কিছু উৎসব।
যদিও মহামতি গৌতম বুদ্ধ তাঁর ধর্ম প্রচারের প্রারম্ভেকোন উৎসব বা আচার অনুষ্ঠানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেননি, কালক্রমে সামাজিক ও ধর্মীয় উৎকর্ষ সাধন কল্পেবৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিভিন্ন প্রকার উৎসব অনুষ্ঠান প্রচলিত হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় বুদ্ধ পূর্ণিমা, আষাঢ়ী পূর্ণিমা, মধু পূর্ণিমা , আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান এক সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়। এসব উৎসবের মধ্যে প্রবারণা অন্যতম। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত এই তিন মাস ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রত পালনের বিধান রয়েছে। এই তিন মাস ভিক্ষুরা নির্দিষ্ট কিছু কারণ ছাড়া রাত্রিতে নিজ বিহারের বাইরে অবস্থান করতে পারেন না। এই সময়ে তাঁরা শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার সাধনা করে থাকেন। মূলত মহামতিগৌতম বুদ্ধ আজথেকে আড়াই হাজার বছর আগে যখন ভিক্ষুসংঘ প্রতিষ্ঠা করেন তখন এই বর্ষাবাসের বিধানটি ছিলনা। ভিক্ষুগণকে ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য বিভিন্ন জায়গায় চলাচল করতে হতো।দেখাগেল, বর্ষাকালে তাঁদের চলাচলে অত্যন্ত অসুবিধা হতো, বিভিন্ন প্রকার ভয়ানক প্রাণির উপদ্রব দেখা যেত, তাতে তাঁদের প্রাণ সংহারেরও ভয় দেখা যেত। তাই বুদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বিধান দিয়েছিলেন, এই তিন মাস ভিক্ষুগণ একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করবেন এবং শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞার অনুশীলন করবেন। এটিই বর্ষাব্রত।
তিন মাস পর পবিত্র আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষুগণ ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান সমাপ্ত করেন এবং এই দিনটি “প্রবারণা পূর্ণিমা” বলে পরিচিত। বর্ষাবাস পালনযেমন ভিক্ষুদের বাধ্যতামূলক,তেমনি বর্ষাবাস অবসানে তাঁদের “প্রবারণা” করাও বাধ্যতামূলক। “প্রবারণা” শব্দটির আভিধানিক অর্থ প্রকৃষ্ট রূপে বারণ বা নিবারন, মানা, নিষেধ, বরণ বা অভীষ্টদান। বুদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে এই দিনটি প্রচলন করেছিলেন এই জন্যযে, তিন মাস একই বিহারে একসাথে থাকতে গিয়ে ভিক্ষুগণের পরস্পরের কাছেদোষ গুণ, ভালো মন্দ ধরা পড়ে। মানুষ মাত্রই ভুল করে, আর নিজের ভুল ত্রুটি অনেকসময় মানুষের নিজেরচোখে ধরা পড়েনা। তাই ভিক্ষুগণ পরস্পরের কাছেকোন ভুল, অপরাধদেখিয়েদেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান এবং অকুশল, ভুলভ্রান্তিকে বর্জন করে ক্ষমা প্রার্থণা করেন ও সকল কুশল ও সুন্দরকে বরণ করেন। এতে তাঁদের আত্ম গরিমা, আত্ম অহংকারলোপ পায়। নিজেরদোষ স্বীকারের মধ্যেযে মহত্ত্ব আছে এ শিক্ষার মাধ্যমে তা ধারণ করা হয়। এই আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের মন পবিত্র হয় এবং আত্মশক্তি বৃদ্ধি পায়। তাই প্রবারণা আত্মশুদ্ধি, আত্মসংযম ও আত্মজিজ্ঞাসার অনুশীলন। প্রবারণার মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের মধ্যেসৌভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য ও মৈত্রীভাব সুদৃঢ় হয়। পারস্পরিক দায়বদ্ধতা এবং ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি পায়।
প্রবারনার এ বিধান ভিক্ষুদের জন্য দেয়া হলেও তা শুধু ভিক্ষুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নাথেকে গৃহীবৌদ্ধ নরনারীদের মধ্যেও এটি যথেষ্ট তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে। এ দিনে তারা সবভেদাভেদ ভুলে পরস্পরের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এর মাধ্যমে চিত্তের সংকীর্ণতা দূর হয়ে পরস্পরের জন্য মৈত্রী ও ভালবাসায় হৃদয় পরিপূর্ণ হয়। প্রবারণার মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের মধ্যে, সাধারণ গৃহী সমাজের মধ্যে এবং ভিক্ষুসংঘ ও গৃহী সমাজের মধ্যে পারস্পরিক এক সামাজিক ও ধর্মীয়মেল বন্ধনের সৃষ্টি হয়।
প্রবারণা পূর্ণিমাকে উপলক্ষ্য করে বিহারগুলোকে ধর্মীয় পতাকা, বেলুন, ফেস্টুন দিয়ে সাজানো হয়। ঐদিন সকালথেকেইবৌদ্ধ নর নারীবৃন্দ সাধ্যমত নতুন ও পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে বিবিধ দানীয় সামগ্রী নিয়ে বিহার বা মন্দিরে যায়, ধর্মীয় আমেজ ও ভাব গাম্ভীর্যের মাধ্যমে সারা দিন অতিবাহিত করার পর সন্ধ্যায় উৎসব মুখর পরিবেশে আকাশ প্রদীপ প্রজ্জ্বলন বা ফানুস উড়ানো হয়।
কথিত আছে, রাজকুমার সিদ্ধার্থগৌতম গৃহত্যাগ করে অনোমা নদীর পাড়ে উপনীত হলে তাঁর সারথী ছন্দককে শরীরের আবরণাদি দিয়ে বিদায়দেন। তারপর তিনি ভাবলেন “আমার মস্তকের এই সুবিন্যস্তকেশরাশি গৃহত্যাগী সন্যাস জীবনের জন্যশোভনীয় নয়“। তাই তিনি ডান হাতে তলোয়ার এবং বাম হাতে তাঁরকেশরাশি ধরে সত্যক্রিয়া করেছিলেন, “যদি আমি ইহজন্মে পরম সত্যের (বুদ্ধত্ব) সন্ধান পাই তাহলে আমারকেশরাশি মাটিতে না পড়ে উর্দ্ধাকাশে উত্থিতহোক“। তাঁরকেশরাশি আকাশে উত্থিত হয়েছিল। বৌদ্ধ বিশ্বাস মতে, এইকেশরাশি নিয়ে স্বর্গেরদেবগণ চুলামনি জাদী প্রতিষ্ঠা করে পূজা করা যাচ্ছে।বৌদ্ধগণ বুদ্ধেরসেই পবিত্রকেশরাশির প্রতি পূজা ও সম্মান প্রদর্শন করার জন্য আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথিতে আকাশপ্রদীপ উড়িয়ে থাকে। নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে, বুদ্ধ সংকীর্তনের সুর মূর্চ্ছনার সাথেনেচেগেয়ে ওড়ানো রঙবেরঙের ফানুসে প্রবারণা পূর্ণিমার সন্ধ্যাথেকে শুরু করেবেশ রাত পর্যন্ত আকাশ হয়ে ওঠেমোহনীয়।
কালের পরিক্রমায় “প্রবারণা” বর্তমানে শুধুবৌদ্ধ পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধনেই। বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমার দিনেযে ফানুস বা আকাশ প্রদীপ উড়িয়ে পূজা করে, তাকে ঘিরে একটি উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় এবং অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এ উৎসবে সামিল হয়। আনন্দের এক মাহেন্দ্রক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে তারাও যেকোন শুভ কাজের প্রারম্ভে ফানুস উত্তোলন করে। তাই এটি এখন সর্বজনীন জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে। মূলত এই ফানুস উত্তোলনের জন্যই প্রবারণা পূর্ণিমা একটি উৎসবের রূপ লাভ করেছে এবং বাংলারবৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর আরকোন উৎসবই এর মতো সর্বজনীনতা পায়নি। এই আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার পরদিনথেকে কার্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত এক মাস ব্যাপী কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে বিহারের বাইরে বসে মেলা, বাড়িরবৌ ঝিয়েরা নতুন শাড়ি পরে গল্পে, আনন্দেমেতে ওঠে, ছেলে বুড়ো সবাই উজ্জ্বীবিত হয় প্রত্যাশিত আনন্দে।
কর্ণফুলীর অববাহিকায় হাজার বছর ধরে বসবাসকারী নৃগোষ্ঠীর নানা কৃষ্টি আচারের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে এই বাঙালি কৃষ্টি ও সভ্যতা, আর বাংলারবৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের পথ পরিক্রমায় রচিত হয়েছে এই সভ্যতার গতিময়তা। প্রবারণার শিক্ষাকে অন্তরে ধারণ করে ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে সকলে মিলে আমরা একটি সুখী, সমৃদ্ধশালী ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারি। আসুন, আমরা আত্ম জিজ্ঞাসা, আত্ম সংযম ও আত্ম শুদ্ধির মাধ্যমে নিজেরা সুখী হই, অন্য সকলকেও সুখী করি। জগতের সকল প্রাণি সুখীহোক।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সরকারি সিটি কলেজ