একজন সৌমিত্র ও তার আলোকিত কর্মজীবন

| সোমবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ

৮৬ বছরে বয়সে শেষ হলো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কর্মময় দীর্ঘ পথচলা। হাসপাতালে লম্বা লড়াইয়ের পর চলে গেলেন বাংলার প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা, নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি ও চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি পছন্দ করতেন না উৎসবের পর বিসর্জনের দিন। ছোটবেলায় জলঙ্গী নদীর পাড়ে বিসর্জনের কোলাকুলির মাঝেও বিসর্জিত প্রতিমার মুখে অনিবার্য ‘শেষ’ সবকিছু থেকে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে রেখেছিল তাঁর মনে। পুরনো সেই ইচ্ছেপূরণে ছুট দিলেন বাঙালির অহংকার সৌমিত্র। লম্বা ছুট! একবার বিসর্জনের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন তিনি, ‘আমার মধ্যে বিসর্জনের অন্ধকার রয়েছে। যেটা এক আততায়ীর মতো বসে আছে। সে আর আমাকে ধরতে পারবে না। অতএব পালাও। দে ছুট, দে ছুট! নিজের সঙ্গে প্রায়ই কথা বলতেন ‘অপু’। খবর বাংলানিউজের।
পৃথিবী থেকে সরে যাওয়ার আগে প্রশ্ন রেখেছিলেন নিজের কাছে, এই যে এত কিছু করলে। এ সব কেন? তুমি পাশ দিয়ে গেলে ওই যে ছেলেগুলো আজও চিৎকার করে, দ্যাখ-দ্যাখ, স-উ-মি-ত্র! স-উ-মি-ত্র যাচ্ছে, তার জন্য তো নয়। এটা নিশ্চয়ই লক্ষ্য ছিল না? আমি তো চেয়েছিলাম, আমি হেঁটে গেলে লোকে বলবে, ওই যে যাচ্ছে! ওর মতো অভিনয় কেউ করতে পারে না। আদারওয়াইজ এই জীবনের কী মানে? মানুষের কী উপকার করতে পারলাম? তখন নিজেকে বোঝাই, অভিনয়ের মাধ্যমে যেটুকু আনন্দ বিতরণ করতে পেরেছি, সেটাও তো এক অর্থে মানুষের সেবা। সেটাও তো একটা উপকার। বলা হয় ‘লাইফ ইজ দ্য আনসার টু লাইফ’। বাঙালির সংস্কৃতি প্রবহমানতার ইতিহাসে থেকে গেল সৌমিত্রের জীবন। তিনি মনে করতেন, সৃষ্টি-সংস্কৃতি-নির্মাণের মধ্যে যে মানুষ নেই সে মৃতপ্রায়। কেবল শারীরিক ভাবে বেঁচে থাকা ছিল তাঁর কাছে মূল্যহীন। সৃষ্টির সব ক্ষেত্রেই মগজাস্ত্রের আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি। সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর মানসপুত্রের আলাপ ১৯৫৬ সালে। যাঁর পরিচালনায় মোট ১৪টি চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন সৌমিত্র। নাহ্‌, উত্তমকুমার হয়ে ওঠেননি তিনি। দেব, জিৎ বা অন্যান্য তারকার মতো কমার্শিয়াল সিনেমায় দাপিয়ে কাজ করেছেন-এমনও নয়। তবু ‘বেলাশেষে’ তিনি সৌমিত্র! তাঁর একমাত্র সম্পদ ‘অ্যাকাডেমিক ইনটেলিজেন্স’। অভিনয়ে বুদ্ধির সংযত ঝলক। ওই মগজ দিয়েই শিখেছিলেন তিনি সিনেমার লাগসই মাপ। ক্যামেরার সামনে অবিচল থাকার বোধ।
কখনও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ আবার কখনও সত্যজিৎ রায়ের প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ‘ময়ূরবাহন’ থেকে ‘ময়ূরাক্ষী’। ‘ক্ষিদ্দা’ থেকে ‘উদয়ন পণ্ডিত’। বাঙালি তাঁকে ঘিরে সব আশা দু’হাত ভরে মিটিয়েছে। সৌমিত্র একই সঙ্গে অভিনেতা, নাট্যকার, বাচিক শিল্পী এবং কবি। তার চিত্রশিল্পী পরিচয় অনেককে মুগ্ধ করলেও তিনি নিজে তাঁর ছবি আঁকা নিয়ে বরাবর সংশয়ী ছিলেন। একসময় ‘এক্ষণ’ সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও গভীরভাবে যুক্ত ছিলেন সৌমিত্র । সেই কাজে তাঁর পাশে ছিলেন তাঁর ‘মানসপিতা’ সত্যজিৎ। তবে অভিনয়ই তাঁর রক্তে, স্মৃতিতে, জীবনের রোজনামচায়।
হাইস্কুল থেকেই অভিনয় শুরু সৌমিত্রের। সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর মানসপুত্রের আলাপ ১৯৫৬ সালে। যাঁর পরিচালনায় মোট ১৪টি ছবিতে কাজ করেছেন সৌমিত্র। সৌমিত্র-সত্যজিতের কর্মপদ্ধতি বর্তমান প্রজন্মের অভিনেতা-নির্মাতাদের মধ্যে যেন অনেকটাই দুর্লভ।
অপু হয়ে-ওঠার জন্য সৌমিত্রকে ‘অপুর সংসার’-এর চিত্রনাট্য দিয়েছিলেন সত্যজিৎ। তার আগে তিনি কোনও অভিনেতাকে চিত্রনাট্য দিতেন না। সঙ্গে দু’টি ফুলস্কেপ পাতায় লিখে দিয়েছিলেন অপু চরিত্রটি নিয়ে নানা দৃষ্টিকোণে দেখা নিজস্ব ভাবনা। পাশাপাশি সৌমিত্রও লিখেছিলেন ‘অপুর ডায়েরি’ এবং অপু সম্পর্কিত নিজের অভিজ্ঞতায় ভর-করা কল্পনা। এখনও যখন সে ছবি তৈরির স্মৃতিতে ফেরেন সৌমিত্র, তখন তিনি লেখেন, ‘বাস্তবতাকে মাপকাঠি করে অভিনয়ের ওই যে চেষ্টা, ওটাই অভিনয়ের আসল অভিপ্রায়’। সত্যজিতের কাছে আসার আগে যখন অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রস্তুতির ভিত তৈরি করছিলেন নাট্যাচার্য শিশির ভাদুড়ির কাছে, তিনি বলেছিলেন, ‘যখন পড়বে তখন গোয়েন্দার মতো পড়বে। শিক্ষার্থী সৌমিত্র কখনও ভোলেননি সে কথা। বলেছিলেন, গোয়েন্দার মতো খোঁজা এখনও আমার ধ্রুবমন্ত্র হয়ে আছে। সৌমিত্রর এই শিল্প অভিপ্রায়ই তাঁর দু’খণ্ডের বিপুল গদ্যসংগ্রহে বিবিধ বিষয়ে বিন্যস্ত। সৌমিত্রের স্বতন্ত্র স্বরের মূলে তাঁর আজীবনের আধুনিক মন। যখন নাটক রচনা করছেন, তা ‘সমকালের জীবনযন্ত্রণার অনুভবে’ বুনছেন। সৌমিত্র অভিনীত চরিত্রগুলিতেও প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে ইতিহাসের স্বর। যে ইতিহাস বড় বিষাদময়। দেশকালের বিষণ্মতা লেগে থাকে তাতে। এ দেশে এখন ভাল অভিনেতা অনেকেই আছেন, ছিলেনও। কিন্তু সৌমিত্রর মতো শিল্পীর দেখা কম পাওয়া যায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধউত্তম-সৌমিত্রের লড়াই
পরবর্তী নিবন্ধকরোনা আক্রান্ত ‘মাস্ক’