একজন ডলি আনোয়ার

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ৪ আগস্ট, ২০২৫ at ৮:৫০ পূর্বাহ্ণ

মূলতঃ ডলি আনোয়ারের পরিচিতি ছিল অভিনেত্রী হিসেবে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে এবং চলচ্চিত্রে তাঁর অভিনয় দেখেছি। টেলিভিশনে “একতলা দোতলা” নামে একটি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁর অভিনয় জীবন শুরু। পরে মঞ্চ নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। তারও পরে ১৯৭৯ সালে “সূর্য দীঘল বাড়ি” চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক আলোচিত হন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারেও ভূষিত হন। ১৯৮৬ সালে “দহন”’ এবং ১৯৮৯ সালে “হুলিয়া” নামে আরও দুটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে “সূর্য দীঘল বাড়ি” চলচ্চিত্রে ডলি আনোয়ারের অভিনয় আজও মনে পড়ে। অত্যন্ত সাবলীল অভিনয় তাঁর মতো দক্ষ শিল্পী ছাড়া ঐ চরিত্র ফুটিয়ে তোলা অন্য কারোর পক্ষে সম্ভব ছিল কিনা ঐ সময়ে, তা আজও ভাবনায় আসে।

টেলিভিশনেও ডলি আনোয়ার কিছু মনে রাখার মত নাটক করে গেছেন। “জোনাকি জ্বলে”, “চিঠি রোজ রোজ”, “দুয়ে দুয়ে চার”, “সোনার শেকল”, “সুখের আরেক নাম”, “আর এক বসন্ত”, “বকুলতলা কতদূর ”, “সূর্যাস্তের সমুদ্র অনেক দূর” ইত্যাদি নাটকগুলো উল্লেখযোগ্য।

সবচেয়ে করুণ বিষয় : ডলি আনোয়ার একজন আলোকচিত্রশিল্পী ছিলেন, তা জানতে পারি তাঁর অকাল মৃত্যুর পর। ১৯৯১ সালের ৩ জুলাই ডলি আনোয়ার এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যান।

আর ১৯৯৩ সালের ৯ এপ্রিল১৫ এপ্রিল প্রয়াত আলোকচিত্রী মৃণাল সরকার তাঁর সংগঠন ‘আলোকচিত্রম’এর ব্যানারে আয়োজন করেছিলেন ডলি আনোয়ারের আলোকচিত্র প্রদর্শনী, চট্টগ্রাম আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ মিলনায়তনে। প্রয়াত মৃণালদাই ডলি আনোয়ারকে আলোক চিত্রশিল্পী হিসেবে উপস্থাপন করেন। তখনই ডলি আনোয়ারের তোলা আলোকচিত্র দেখার সুযোগ হয়। এবং মৃণাল সরকারের অনুরোধ সেই আলোকচিত্র প্রদর্শনী উপলক্ষে ছোট্ট লিফলেট প্রকাশিত হয় আমার লেখা দিয়ে। দৈনিক আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এই আলোকচিত্র প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন ১৯৯৩ সালের ৯ এপ্রিল তারিখে।

ডলি আনোয়ার ছিলেন একাধারে অভিনেত্রী, সংস্কৃতিকর্মী, আলোকচিত্রী । দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ঐ সময়ে তিনি ছিলেন অতি পরিচিত মুখ। মঞ্চ, চলচ্চিত্র, পত্রিকা সম্পাদনা প্রভৃতি মাধ্যমে তাঁর সাবলীল পদচারণা এবং ব্যতিক্রমী উপস্থাপনার কারণে ডলি আনোয়ার আজও স্মরণীয়। দেশের সংস্কৃতির সুস্থ ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ও বিদেশে উপস্থাপন করতে ডলি যে ভূমিকা পালন করেছিলেন, তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ।

দেশের মহিলা আলোকচিত্রী হিসেবে ডলি আনোয়ারের সঠিক মূল্যায়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে আজ। বিভিন্ন ঘটনার কারণে ব্যক্তিগতভাবে তিনি সামাজিক পরিবেশে কিছুটা সমালোচিত। তবুও তাঁকে আমাদের মনে রাখতে হবে। প্রগতি আর মানব কল্যাণের পক্ষে তাঁর উচ্চারণই আলোক চিত্রের প্রধান উপকরণ। আলোকচিত্র, যে মাধ্যম আমাদের সুখদুঃখ, ত্রুটি বিচ্যুতি কিংবা মনের সংবেদনশীল বিভিন্ন দিক তুলে ধরে ডলি সেই মাধ্যমটিকে বেছে নিয়েছিলেন; যেন নিজস্ব তাগিদেই এবং তাঁর আলোকচিত্রে আমরা দেখতে পাই ব্যতিক্রমী একটি প্রেক্ষাপট, নতুনত্বের ইঙ্গিতে এবং আধুনিকতার নিপূণ শৈলী, তবুও পরিতাপের বিষয় যে, আলোকচিত্রী হিসেবে ডলির পরিচিতি, তাঁর তোলা আলোকচিত্রগুলো বিস্মৃতির অতলে। তাঁর তোলা আলোকচিত্রগুলো এখন কোথায়, কি অবস্থায় আছেজানি না।

সাধারণত ডলি আনোয়ার অভিনেত্রী হিসেবেই সকলের কাছে পরিচিত। কিন্তু তাঁর এই অজানা পরিচিতি নির্দিষ্ট একটি মহলেই সীমাবদ্ধ। অথচ তাঁর আলোকচিত্র এদেশকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করেছে কমনওয়েলথ প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক প্রাপ্তিতে। এই গর্ব কেবলমাত্র দেশের নারী আলোকচিত্রীদেরই নয়; আমাদেরও, দেশের অগণিত মানুষের। আর ১৯৯৩ সালেই জানতে পারি প্রয়াত মৃণাল সরকারের কাছে, ডলি আনোয়ার ‘সাতদিন’ নামে একটি সাপ্তাহিক সম্পাদনা করেছেন।

এমন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ডলি আনোয়ারের আকস্মিক স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন, যা রীতিমতো দুঃখজনক।

তিনি আমাদের মাঝে আজও থাকলে সাংস্কৃতিক জগৎ অনেক সমৃদ্ধ হতো। ডলি আনোয়ারের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ – এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধবহু ভাষাবিদ ও জ্ঞানতাপস