একজন ঘিনুয়া এবং একজন সখিনা

শাহরিয়ার আদনান শান্তনু | সোমবার , ১২ মে, ২০২৫ at ১০:১৯ পূর্বাহ্ণ

ঘিনুয়া এবং সখিনাদুই চরিত্র আমাদের দুই রকম অনুভূতির সৃষ্টি করে। একদিকে ‘ঘিনুয়া’ প্রতিবাদী চরিত্র, অন্যদিকে ‘সখিনা’ গ্রামের সহজ সরল এক নারী চরিত্র। মৃণাল সেনের ‘মৃগয়া’ এবং ‘আমার ভুবন’ সিনেমায় এই দুই চরিত্র একেবারেই ভিন্ন ধরনের। কিন্তু পরাবাস্তববাদী দর্শন মেলে এই দুই চরিত্রে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, মৃণাল সেন কিভাবে এই দুই চরিত্রের মাঝে মনুষ্য জীবনের পরাবাস্তববাদী দর্শন মেলে ধরেছেন। এখানেই বোধকরি মৃণাল সেনের স্বকীয়তা। যিনি তাঁর প্রতিটি সিনেমায় নিজেকে ভেঙেছেন। নিজেকে তিনি ভাঙতে ভালবাসেন। তাই তাঁর প্রতিটি সিনেমা এবং চরিত্র ভিন্নতার আবরণে উপস্থাপিত হয়েছে। দর্শকের মনে আজও দাগ কাটে ‘ঘিনুয়া’ ও ‘ সখিনা’।

মৃগয়া’ সিনেমাটি ১৯৩০ সালের পটভূমিতে নির্মিত। স্থান উড়িষ্যার একটি ছোট্ট গ্রাম। যেখানে আদিবাসীদের বসবাস। ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর নানান ষড়যন্ত্রে আদিবাসীআদিবাসীদের মধ্যে নানান দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়। আর আদিবাসী যুবক ‘ঘিনুয়া’ হয়ে উঠে প্রতিবাদী। বিশ্বজুড়ে আমরা যে প্রতিবাদী চরিত্রের মানুষকে দেখেছি, তাদের পরিণতি হয়েছে মৃত্যু। তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে। যেমন: সূর্য সেনের মতো বিপ্লবী ও প্রতিবাদী চরিত্রগুলোকে ইংরেজরা হত্যা করেছে। ‘মৃগয়া’তেও তাই ঘটেছে। মৃণাল সেনের প্রতিবাদী যে সত্তা, তা তাঁর সিনেমাতেও তুলে ধরেছেন বিভিন্নভাবে। ‘ঘিনুয়া’ আজও আমাদের সমাজে আছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা তাকে দেখতে পাই। বুর্জোয়া শাসনের বিরুদ্ধে এক আদিবাসী যুবকের যে লড়াই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চারতা কিন্তু আজও বিশ্বময়।

মৃগয়া’ সিনেমাটি আজও দেখলে মনকে নাড়া দেয়। এই প্রসঙ্গে মৃণাল সেন নিজেই বলেছেন, “যে কোনো সময়ে যে কোনো জায়গায় ঘটতে পারে”। আর সদ্য সিনেমার জগতে আসা মিঠুনের অভিনয় দেখে কে বলবে, এটি তাঁর প্রথম সিনেমা?

আমার ভুবন’ সিনেমায় মৃণাল সেনকে আবিষ্কার করি আরেকভাবে। যেখানে শাশ্বত ও সুন্দর হয়ে উঠে এসেছে ‘সখিনা’ চরিত্রটি। একজন সখিনার যে অনুভূতি আছে, চাওয়াপাওয়া আছে, ভালো লাগা আছেতা কি আমরা সচেতনভাবে কখনো ভেবেছি? এক মুসলমান সমপ্রদায়ের বধূ সখিনা। যার বিবাহ বিচ্ছদ হয়ে গেছে নূরের সাথে। আবারও বিয়ে করেছে কৌশিককে। এখানেও সখিনার নীরব প্রতিবাদী সত্তা খুঁজে পাই। সাধারণত গ্রামীণ সমাজে তেমন দেখা যায় না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের একটি গ্রামে এমনটাই ঘটেছে। “আমার ভুবন” এ আমরা দেখতে পাই আগের স্বামী নূর বিদেশ চলে যাওয়ার পর আবারও ফিরে আসে গ্রামে। দেখা করতে যায় সখিনার সাথে। দেখে সখিনার অভাবঅনটনের সংসার। হাত বাড়িয়ে দেয় সহায়তার। বিচ্ছেদের তিক্ততা ভুলে। এখানে মৃণাল সেন জীবনকে দেখিয়েছেন অন্যভাবে। সখিনা ও নূরের বিচ্ছেদ মুখ্য নয়। জীবনটাই মুখ্য। দুই সত্তার দুই মানুষের মেলবন্ধন। এখানে সখিনা’র চরিত্রে নন্দিতা দাশ অনবদ্য। নন্দিতাকে সখিনায় পরিণত করেছেন। নন্দিতার দৈহিক সৌন্দর্য, সারল্যকে সুনিপুণ ভাবে তৈরি করতে পেরেছেন। তাই নন্দিতাকে পুরো সিনেমায় শুধু সখিনাই মনে হয়েছে। যে সখিনা হয়ে উঠে ‘আমার ভুবন’এ ভুবনমোহিনী। “আমার ভুবন” সিনেমাটিতে জীবনের পরাবাস্তবতাকে নতুনভাবে তুলে ধরেছেন মৃণাল সেন। জীবন যে একেবারে ছক বেঁধে চলে না, ছক ভেঙ্গে নতুন আলোর পথে চলেচলতে হয়, এটাই যেন ‘আমার ভুবন’ সিনেমার মধ্য দিয়ে প্রতিভাত হয়েছে।

মৃণাল সেন এমনই এক মানুষ, যিনি কারোর দ্বারা প্রভাবিত নয়, নিজের স্বকীয়তায় এগিয়ে গেছেন। গল্প বাছাই, সিনেমা নির্মাণ কিংবা বাজেটযাই বলি না কেন, এই বিষয়গুলো ভাবলেই যেন অন্য এক মৃণাল সেনকে খুঁজে পাই। যিনি আজও প্রতিবাদী চরিত্রের ভাস্কর্য হয়ে আছেন আমাদের মাঝে। ১৪ মে মৃণাল সেনের ১০২তম জন্ম বার্ষিকী। তাঁর প্রতি রইলো আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বাসের বন্ধনে বাঁধা, ভালোবাসার পথে চলা!
পরবর্তী নিবন্ধনাছিরাবাদ ওষখাইনীরি নুরীয়া বিষু দরবারে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প