একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুবুল আলম চৌধুরীর জীবনসঙ্গী, বাংলাদেশের উন্নয়ন আন্দোলনে নারীর ক্ষমতায়নে প্রথমভাগের সফল উদ্যোক্তা জওশন আরা রহমান ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় থেকে বৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। পরীক্ষার ফল প্রকাশ হবার আগেই মাহবুবুল আলম চৈাধুরীর সাথে বিবাহ–বন্ধনে আবদ্ধ হন। যার লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধায় লেখা প্রথম কবিতা। বিয়ের পর নিয়মিত লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে জওশন আরা রহমান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রী সংসদের চট্টগ্রাম জেলা শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে বি.এ পাস করেন। সমাজকল্যাণ বিভাগে চাকরিতে থাকাকালীন ১৯৬৪–১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে কলম্বো প্ল্যান স্কলারশিপ নিয়ে দু’বছরের জন্য নিউজিল্যান্ডে যান। ওয়েলিংটনে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে সোস্যাল সায়েন্স–এ পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে চাকরিরত অবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে তৎকালীন ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল ওয়েলফেয়ার থেকে এমএ পাস করেন।
সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে শহর সমাজকল্যাণ অফিসার হিসেবে চাকরি আরম্ভ করে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে ডেপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে ‘মাদার্স ক্লাব’ প্রতিষ্ঠা করে ১৯৭৯–তে ইউনিসেফ–এ যোগ দেন। ইউনিসেফেও তিনি প্রথমে নারী উন্নয়ন কর্মসূচি প্রধান এবং পরে প্রোগ্রাম প্ল্যানিং সেকশনের প্রধান হিসেবে সাড়ে সতেরো বছর নারীর উন্নয়নে কাজ করেন।
এসব কর্মসূচিতে নারীকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। শিশু ও নারীর অধিকার রক্ষার ব্যাপারে তিনি একটি ইনস্টিটিউশন। তিনি আমাদের চট্টগ্রামের গর্ব। উন্নয়ন সংগঠক হিসেবে তাঁর কৃতিত্ব অনন্যসাধারণ। দেশের দুই প্রধান উন্নয়ন চিন্তাবিদ ও সংগঠক প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ও স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে সমপর্যায়ে সম দক্ষতায় তিনি কাজ করেছেন।
উনিশ শতকে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার চুনতী গ্রামের একটি আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে জওশন আরা রহমানের জন্ম। জওশন আরা রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান ছিলেন বিভাগ–পূর্ব বাংলার চট্টগ্রাম জেলার প্রথম জেলা রেজিস্ট্রার; মাতা সাদীদা খানম, তিনিও বিদূষী নারী ও একজন লেখক। নানা তৈয়ব খান ছিলেন জমিদার এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। মামা সাহিত্যিক কামালউদ্দিন খান ও কবি সুফিয়া কামাল মামি। জওশন আরা রহমান খাস্তগীর স্কুলে অধ্যয়নকালে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে শহরে ট্রাক মিছিল করেন, ভাষার দাবিতে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দেন। চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যয়নকালে জওশন আরা রহমান ১৯৫৫–৫৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন ‘অন্বেষা’ সম্পাদনা ও প্রথম বাংলায় প্রকাশ করেন। সে সময় চট্টগ্রাম কলেজ থেকে সহপাঠী, নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস সহ দু’পাতা নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। এছাড়া চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কার্যক্রমে নারীর অংশগ্রহণের অগ্রদূতই ছিলেন তিনি।
পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানও ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরা নিজেদের মধ্যে প্রথম ঘরোয়াভাবে শুরু করেছিলেন দেওয়ান বাজারে তাঁদের বাড়ির পেছনের উঠোনে। যে যুগে মুসলিম নারীদের সীমানা কেবল ঘর হতে বিদ্যালয় প্রাঙ্গন আর বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে পড়ালেখা শেষ হবার আগেই গৃহিণী সেখানে তিনি ছিলেন উল্টো রথের যাত্রী। বাংলাদেশে তিনি প্রথম নারী যার নেতৃত্বে দেশের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় নারী ও শিশুদের জন্য আলাদা করে উন্নয়নমূলক অধ্যায় সংযোজিত হয়, যার ফলাফল আজ সারা দেশের নারী ও শিশু ভোগ করছে। বর্তমানে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নারী অংশগ্রহণের যে প্রয়োজনীয়তা দেশ অনুভব করছে এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ানোর কাজ করছে তার সূত্রপাত ছিল তাঁর সেই আন্দোলনের আর আন্তরিক চেষ্টার ফল।