নগরের কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির অর্থায়নে শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত প্রকল্প গ্রহণ করতে যাচ্ছে চসিক। দুই ধাপে বাস্তবায়ন করা হবে সম্ভাব্য প্রকল্প। প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে দক্ষিণ কোরিয়া তাদের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন কোরিয়া এনভায়রনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের (কেইআইটিআই) মাধ্যমে চসিককে ১৩ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান দেবে। দ্বিতীয় ধাপে অনুদানের পাঁচ থেকে দশ গুণ ঋণ সহায়তা দেয়া হবে চসিককে। এ প্রকল্পে সম্পৃক্ত হবে বিশ্বব্যাংকও। পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দূর হবে চসিকের দীর্ঘদিনের সমস্যা ল্যান্ডফিল (আবর্জনাগার) সংকট। কারণ আরেফিন নগরের একটি ল্যান্ডফিল থেকেই পুরো শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হবে। স্থায়ীভাবে বন্ধ হবে হালিশহর আনন্দবাজার আবর্জনাগার।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে প্রকল্পের প্রাক্সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ করেছে কেইআইটিআই। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় রিপোর্টটি উপস্থাপন করা হয়। রিপোর্টটি পর্যালোচনা করে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার চসিককে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অনুদান দিতে ইচ্ছে পোষণ করে। এছাড়া চসিককে একটি প্রজেক্ট কনসেপ্ট প্রপোজলের (পিসিপি) ড্রাফট হস্তান্তর করে। একইসঙ্গে অনুদান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে চাইলে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ঢাকাস্থ কোরিয়ান দূতাবাসে প্রকল্প প্রস্তাব জমা দেয়ার শর্ত দেয়া হয়। চসিক গত বুধবার বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে পরবর্তী নির্দেশনা চেয়েছে। জানা গেছে, দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রাক্সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন উপস্থাপনের দিন উপস্থিত ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, চসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম ও প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি। উল্লেখ্য, প্রকল্প ঘিরে গত ১০ থেকে ১৬ জানুয়ারি দক্ষিণ কোরিয়া সফর করেন মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা।
কী থাকবে অনুদান প্রকল্পে : অনুদান প্রকল্পে চারটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত। প্রথমত প্রকল্পের আওতায় সৃষ্টি হবে এমআরএফ (ম্যাটেরিয়াল রিকভারি ফ্যাসিলিটি) সুবিধা। এ সুবিধার মাধ্যমে সংগৃহীত প্লাস্টিক, পিচবোর্ড, কাগজ (সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অফিসের কাগজ, মিশ্র কাগজ), কাচের বোতল এবং জার, অ্যালুমিনিয়াম এবং স্টিলের ক্যানসহ ধাতব পাত্র মেশিনের মাধ্যমে পৃথক করা হবে। এরপর সেগুলো ম্যাটেরিয়াল রিকভারি কারখানায় কম্প্যাক্ট করে প্রয়োজন অনুসারে কাজে লাগানো হবে। এছাড়া ছোট আকৃতির বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা হবে। জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির জন্য প্রচারণা এবং পরিচ্ছন্নকর্মীদের বিভিন্ন পর্যায়ে প্রশিক্ষণ, সচেতনভাবে বর্জ্য সংগ্রহ করা, ডোর টু ডোর সংগ্রহের জন্য আধুনিক উপকরণ সরবরাহ করা হবে।
মূল প্রকল্পে যা থাকছে : ঋণ সহায়তায় যে প্রকল্প সেটাই সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মূল প্রকল্প। এর আওতায় বাস্তবায়ন করা হবে আরেফিন নগরে স্যানিটারি ল্যান্ডফিলের উন্নয়ন প্রকল্প, একটি আবর্জনাগার বন্ধ করা, ফিকেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট, ফুড ওয়েস্ট প্ল্যান্ট, এমআরএফ প্ল্যান্ট এবং বড় আকারের বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট করা হবে।
মূল প্রকল্পে বর্জ্য পরিবহনের বিষয়টি আরো আধুনিকায়ন করবে। এর অংশ হিসেবে বর্জ্য পরিবহনে কম্পেক্টর (বিশেষ যান) সরবরাহ করবে। সংগ্রহ পদ্ধতিও উন্নত করা হবে। এছাড়া ফুড ওয়েস্ট প্ল্যান্টে পরিচ্ছন্নকর্মীদের সংগৃহীত সবজি (উচ্ছিষ্ট) এবং খাদ্য বর্জ্যকে দুইভাবে কাজে লাগানো হবে। এর মধ্যে একটি অংশ দিয়ে সার এবং অপর অংশ দিয়ে তৈরি করা হবে বায়োগ্যাস।
জানা গেছে, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে চসিকের বায়েজিদ আরেফিন নগর আবর্জনাগারে। এক্ষেত্রে কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করে আবর্জনাগারটি আরো সম্প্রসারণ করে পুরোটা স্যানিটারি ল্যান্ডফিল করা হবে। সেখানে ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন করা হবে। বর্জ্য থেকে বিষাক্ত যে পানি বের হয় সেটা ভূ–গর্ভে চলে গেলে ভূ–গর্ভস্থ পানিকেও দূষিত করে। এ দূষণ রোধ করার জন্য ট্রিটমেন্ট করা হবে।
চসিকের পরিচ্ছন্ন বিভাগ জানায়, নগরে দৈনিক তিন হাজার টনের বেশি বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে দুই হাজার টন বর্জ্য সংগ্রহ করে চসিক। সংগৃহীত এসব বর্জ্য ফেলা হয় বায়েজিদ ও হালিশহরের পৃথক দুটি ল্যান্ডফিলে (বর্জ্যাগার)। শঙ্কার কথা হলো, এ দুটো ল্যান্ডফিল ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। তাই নতুন ল্যান্ডফিল গড়তে নতুন জায়গা খুঁজছে চসিক।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এ সমস্যা থাকবে না। কারণ মূল প্রকল্পের আওতায় হালিশহর আনন্দবাজার আবর্জনাগারটি বন্ধ করে দেয়া হবে। এক্ষেত্রে বিদ্যমান বর্জ্য থেকে প্রথমে গ্যাস উৎপাদন করা হবে। নির্দিষ্ট সময়ে সেটা মাটি দিয়ে ভরাট করে বাগান করা হবে।
উল্লেখ্য, বিদ্যমান চসিকের ল্যান্ডফিল দুটির মধ্যে হালিশহরের আনন্দবাজার ল্যান্ডফিলটি গড়ে উঠেছে ৯ একর ভূমির উপর। এ ল্যান্ডফিলে নগরের ৪১ ওয়ার্ডের মধ্যে ২২ থেকে ২৩টি ওয়ার্ড থেকে সংগৃহীত বর্জ্য ফেলা হয়। এছাড়া ১১ একর জায়গার উপর গড়ে ওঠা বায়েজিদ আরেফিন নগরের ল্যান্ডফিলে ১৮ থেকে ১৯টি ওয়ার্ড থেকে সংগৃহীত বর্জ্য ফেলা হয়।
সংশ্লিষ্টরা যা বললেন : প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয় আজাদীকে নিশ্চিত করেন চসিকের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা মুহাম্মদ আবুল হাশেম। তিনি বলেন, কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানটি প্রি–ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে। ওটা উপস্থাপন করার জন্যই মেয়রসহ প্রতিনিধিদলকে কোরিয়ায় নিয়ে গিয়েছিল। পুরো প্রকল্পে অর্থায়ন করবে দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের পরিবেশ মন্ত্রণালয়।
ঋণ প্রকল্পের বিষয়ে তিনি বলেন, ঋণের মাধ্যমে মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। শূন্য দশমিক ০১ শতাংশ করে ঋণটা পরিশোধ করতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ১৫ বছর পর থেকে। পুরো ঋণ পরিশোধের জন্য ৪০ থেকে ৫০ বছর সময় দেয়া হবে। এত দীর্ঘ সময় দেওয়ার কারণ হয়তো এটাও হতে পারে, একটা সময় এসে ঋণ মওকুফ করে দেওয়া হতে পারে। তাছাড়া জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন ২৭–এর সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এটা গ্রিন ফান্ড হিসেবে দেওয়া হবে। তিনি বলেন, মূল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন আসবে। কারণ এর মাধ্যমে পুরো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি চলে আসবে।
সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে পারিবারিক, শিল্প, বাণিজ্যিক ও স্ট্রিট বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ দিন দিন ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মোট বর্জ্যের পরিমাণ প্রতি বছর বেড়েই চলছে। বিশাল জনসংখ্যার এই চট্টগ্রাম শহরের পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর রাখতে আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানের প্রাক্সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে মাধ্যমে আমরা অনেক কিছু অবহিত হয়েছি। এর মধ্যে যা অপরিপূর্ণতা আছে তা পর্যবেক্ষণ করে একটি টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করব। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে একটি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।