ইউনূস সুহৃদ, চট্টগ্রাম থেকে ‘চিটাগাং সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ গড়ে তুলেছিলো বীর চট্টলার একঝাঁক সময়ের সাহসী সন্তান। আমাদের গর্বের ইউনূসের মেধা যোগ্যতায় তিলে তিলে গড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রশক্তির অযাচিত হস্তক্ষেপ সেদিন বীর চট্টলার ইউনূস সুহৃদ মেনে নিতে পারেনি। ২০২৪ এর ৩৬ জুলাইয়ে ছাত্র জনতার সফল গণ–অভ্যুত্থানের পর তিন শূন্যের প্রবক্তা, নোবেলজয়ী মজলুম মানুষটি ক্ষতবিক্ষত জন্মভূমি বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নিলে দেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়। ৮৪ বছর বয়স্ক মানুষটি শত প্রতিকুলতার মাঝেও দায়িত্ব প্রাপ্তির এক বছরে দেশের মৌলিক সংস্কার, অর্থনীতির চাকাকে সচল করা, মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দেন। প্রফেসর ড. ইউনুসের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের একবছরের সময়কালে জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তব প্রাপ্তির মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
প্রত্যাশা: একটি নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। রাজনৈতিক সহিংসতা ও দমন–পীড়নের অবসান, দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশাসনের সূচনা, মানবাধিকার ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বেকারত্ব হ্রাস, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার সংবিধান, নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একত্রিত একটি গ্রহণযোগ্য পথ নকশা।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক পুরোপুরি আস্থা তৈরি না হলেও মৌলিক কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে ঐক্য সংহতি গড়ে তুলতে ইউনূস সরকার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ প্রত্যাশা ছিল গণতন্ত্রের নতুন সূচনা, প্রাপ্তি হলো কিছু সাহসী পদক্ষেপ, কিন্তু এখনও অর্ধেক পথ বাকি। এই সরকার অন্তর্র্বর্তীকালীন চরিত্রে দায়িত্বশীল আচরণ করেছে, তবে মানবাধিকার রক্ষা ছাড়া তা টেকসই হবে না। দরিদ্রমুক্ত বিশ্ব গড়তে সামাজিক ব্যবসাতত্ত্বের উপস্থাপক বীর চট্টলার কৃতী সন্তান নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার সাথে পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করছেন এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে একটি ফ্যাসিস্ট বিরোধী কমন প্লাটফর্ম সৃষ্টির কারিগর হিসেবে কাজ করে অনেকটা সফল হয়েছেন। প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছরের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জগুলো নিম্নরূপ–
সাফল্যসমূহ: ১.সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় সংস্কার উদ্যোগ– ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়, যার মধ্যে রয়েছে সংবিধান, নির্বাচন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও প্রশাসনিক সংস্কার। – ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ও ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন যা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়। ২. অর্থনৈতিক কূটনীতি ও বাণিজ্য উন্নয়ন– যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক ৩৭% থেকে ২০% এ নামিয়ে আনা হয়, যা পোশাক শিল্পের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। – ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্য ৬ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ৩. ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন– স্পেস এক্স–এর স্টার লিংক–এর সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, যা গ্রামীণ ও প্রান্তিক অঞ্চলে ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করবে। ৪. দুর্নীতি দমন ও অর্থ পুনরুদ্ধার– বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়, যার আওতায় ১১ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। ৫. আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপন– বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি করা হয়, যা দক্ষিণ এশীয় সহযোগিতা সংস্থা সার্ক পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টার অংশ। চ্যালেঞ্জ ও সমালোচনা– ১. রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতা– ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামে একটি অভিযান চালু করা হয়, যার আওতায় ১১,০০০–এর বেশি ব্যক্তি গ্রেপ্তার হন। – বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে যা পুলিশ প্রশাসনের নির্লিপ্ততা অপরাধী চক্রকে দমনে বেগ পেতে হচ্ছে। ২. সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা বিধানে সাম্প্রদায়িক উস্কানি সৃষ্টির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ, যা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো। ৩. রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ আন্দোলনের মুখে– আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচ্য।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পন: ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। – ‘জুলাই সনদ’–এর মাধ্যমে রাজনৈতিক সংস্কার ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের রূপরেখা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সাফল্য ও চ্যালেঞ্জগুলো বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা ও প্রভাবকে প্রতিফলিত করে। জালিম সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চট্টলবাসী প্রফেসর ড. ইউনূসের নেতৃত্বে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলো তা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের ত্যাগ, জীবন ও রক্তের বিনিময়ে সৃষ্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আমাদের চাটগাঁইয়া ইউনূস আজ দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনে চমৎকার যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছেন। শত প্রতিকূলতা ও দীর্ঘ সময় ধরে বিগত সরকারের গড়ে তোলা আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোকাবেলায় তাঁকে সকলে আশানুরূপ সহযোগিতা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ির মাঝেও তিনি ধৈর্যের সাথে সব কিছু সামাল দিচ্ছেন। আমরা আরো আনন্দিত আমাদের আরেক সহযোদ্ধা ও নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ই আজম বীর প্রতীককে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে সংশ্লিষ্ট সকলে মিলে গড়ে তুলে ছিলেন ‘চট্টগ্রাম সোশ্যাল বিজনেস সেন্টার’ নামক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি। আমরা আন্তর্জাতিক সোস্যাল বিজনেস সামিটগুলোতে অংশ নিয়ে আমাদের কার্যক্রম তুলে ধরি।‘ বর্তমানে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক উক্ত প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি আমির হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের দায়িত্ব পালন করছেন। ইউনূসের চিন্তাধারা বিশ্ববাসীকে আলোড়িত করলে–ও এদেশের মানুষকে সচেতন করতে, ঐক্যবদ্ধ করতে যে রাজনৈতিক সহযোগিতা প্রয়োজন। মানুষকে আপন করে নেয়ার এক জাদুকরি শক্তি তাঁর মাঝে কাজ করে। ইউনূসের নোবেল বিজয়ে সেদিন মনে হয়েছে কেনো ব্যক্তি নয় ‘বাংলাদেশ নোবেল পেয়েছে। তিনি এদেশের অর্থনীতিকে জোরদার করে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে গড়ে তুলতে যে সংগ্রাম শুরু করেছেন, তা আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। কেননা স্বাধীনতা অর্জন অপেক্ষা তাকে রক্ষা করা আরো কঠিন এবং মহান দায়িত্ব। সামাজিক ব্যবসায় পৃথিবীতে অনন্য বিপ্লব সৃষ্টিকারী, দারিদ্র্য বিমোচন প্রবক্তা এবং শান্তিতে নোবেল বিজয়ী চট্টলার গৌরব এতদসঙ্গে ইউনূস বাঙালি জাতির অহংকার। পতিত সরকার না পারলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বীর মুক্তিকামী শিক্ষার্থীরা তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদায় ভূষিত করেছে। তিনিও তাঁর সন্তানদের আহ্ফিরিয়ে দিতে পারেননি। আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের যথোপযুক্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেকে একটি মর্যাদাবান সম্মানিত জাতি ও মুক্ত চিন্তার দেশ হিসেবে পরিচিত ঘটাই। ড. ইউনূস দীর্ঘজীবী হোন।
লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট ও পরিচালক,
চিটাগাং সোস্যাল বিজনেস সেন্টার লি :।