এক ফেরিঘাট, ভোগান্তি ৩৮ বছরের

চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান

কাজী মোশাররফ হোসেন, কাপ্তাই | বৃহস্পতিবার , ১৭ এপ্রিল, ২০২৫ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ

চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান ফেরিঘাটে দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সর্বস্তরের জনগণ। বছরের পর বছর গড়ালেও এই ভোগান্তি দূর করার কোন পদক্ষেপ কেউ নিচ্ছে না। বাংলাদেশে অনেক বড় বড় প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হলেও লিচুবাগান ফেরিঘাটের দুরবস্থা নিরসনে কেন কেউ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না এই প্রশ্ন এখন সর্বস্তরের জনগণের। বিগত সরকারগুলোর সময়ে প্রতিটি সরকার কমবেশি তিন পার্বত্য জেলার সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখলেও চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটের সমস্যা সমধানে কোনো সরকার কেন এগিয়ে আসেনি এটা কেউ ভেবেই পাচ্ছেন না। বৃহত্তর তিন পার্বত্য জেলার সার্বিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেমে আছে এই চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে এসে। সারাপথ নির্বিঘ্নে আসলেও চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাটে আসার পর সবাইকে থমকে যেতে হয়। এখানে আসার পর কখনো ফেরি পাওয়া যায় না। কখনো ফেরি নষ্ট থাকে, কখনোবা কাপ্তাই লেকের পানি ছেড়ে দেবার ফলে পানির প্রবল তোড়ের কারণে ফেরি চালানো যায় না। কখনো ভারি বৃষ্টির সময় ফেরির দুই পাশের পল্টুন পানিতে তলিয়ে যাবার কারণেও ফেরি চলাচল করা সম্ভব হয় না। আবার কখনো কোথাও কোন সমস্যা না থাকলেও জোয়ারের কারণে হঠাৎ ফেরির পল্টুন ডুবে যায়। এর ফলেও সর্বস্তরের জনগণকে অকল্পনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

রাঙ্গামাটি সরকারি কলেজের ছাত্র কিরন চাকমা বলেন, গতকাল বাঙ্গালহালিয়ায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সকালে নির্বিঘ্নে ফেরি পার হই। কিন্তু বিকাল ৪টার সময় ফেরি পার হতে গিয়ে দেখি ফেরির একপাশের পল্টুন কোমর সমান পানিতে ডুবে আছে। এই পানির উপর দিয়ে প্রাইভেট কার চালিয়ে আসার সময় আমার গাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর কী কষ্ট করে যে ফেরি পার হলাম তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

সিএনজিচালিত টেঙিচালক মো. আলমগীর হোসেন বলেন, দুইশ টাকার ভাড়ায় যাত্রী নিয়ে পানির মধ্য দিয়ে ফেরির পল্টুন পার হতে গিয়ে আমার টেঙি পানিতে বন্ধ হয়ে যায়। পরে কয়েকজন যুবক ১০০ টাকার বিনিময়ে ধাক্কা দিয়ে আমার গাড়ি উপরে তুলে দেয়। আর গ্যারেজে গাড়ি ঠিক করতে লাগে আড়াইশ টাকা। তাছাড়া এই ঘটনায় ৩ ঘণ্টা গাড়ি বন্ধ রাখতে হয়। একই সমস্যার কথা জানালেন মোটরসাইকেল চালক মাহবুব হোসেন। তিনিও পানিতে ডুবে থাকা ফেরির পল্টুনে ভোগান্তি নিয়ে পার হয়েছেন বলে জানান।

জানা গেছে, ১৯৯১ সাল বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে সর্বপ্রথম লিচুবাগান ফেরিঘাটে একটি সেতু নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী কর্নেল অলি আহমদ লিচুবাগান ফেরিঘাট এলাকা পরিদর্শন করে এখানে একটি সেতু নির্মাণের যৌক্তিকতা প্রত্যক্ষ করেন। এজন্য প্রয়োজনীয় টাকাও বরাদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে লিচুবাগান ফেরিঘাটে সেতু নির্মাণ না করে সেই বরাদ্ধকৃত টাকায় রাঙ্গুনিয়ায় কর্ণফুলী নদীর উপর শরফভাটায় সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল।

এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। ২০০১ সালে পুনরায় বিএনপি সরকার গঠন করে। ২০০৮ সাল থেকে টানা ৩ মেয়াদে পুনরায় আওয়ামী লীগ সরকারে ছিল। কিন্তু চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান ফেরিঘাটে সেতু নির্মিত হয়নি। ২০১৫ সালে তৎকালীন সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কাপ্তাই সফরে এসে বলেছিলেন, এখানে সেতু নির্মিত হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বিঘ্নিত হবে। তাই তিনি সেতু নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন না। আওয়ামী লীগ সরকারে ৩ মেয়াদে প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন ড. হাসান মাহমুদ। তিনি বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়, তথ্য মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকা অবস্থায় অসংখ্যবার এই ফেরিঘাট দিয়ে যাতায়াত করেছেন। কিন্তু তিনিও কখনো এখানে সেতু নির্মাণ বিষয়ে ভেবেও দেখেননি। আওয়ামী লীগ সরকারের পার্বত্য মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুরও অসংখ্যবার লিচুবাগান চন্দ্রঘোনা ফেরির উপর দিয়ে যাতায়াত করেছিলেন। কিন্তু এখানে যে একটি সেতু নির্মাণ করা জরুরি এটা তিনি ভাবনায়ও আনেননি।

সকলের অবহেলার কারণে দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ভোগ করে লিচুবাগান চন্দ্রঘোনা ফেরি পারাপার হচ্ছেন। এতে কষ্ট ভোগ ও অর্থ ব্যয়ের পাশাপাশি ফেরিঘাটে এসে কখনো কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় নষ্ট করতে হয়। আর কত কষ্ট ও দুর্ভোগ পোহানোর পর চন্দ্রঘোনা লিচুবাগান ফেরীঘাটে সেতু নির্মিত হবেজানতে চেয়েছেন খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আলতাফ হোসেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানিতে আগাম কর প্রত্যাহার
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে টমটমের পেছনে বাসের ধাক্কা, কিশোর নিহত