আম্মার হামায়েল। ১৩ বছরের এক ফিলিস্তিনি কিশোর। তার স্বপ্ন ছিল থাই বক্সিংয়ের (মুয়াই থাই) জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার নাম হবে উজ্জ্বল। সে চেয়েছিল জয়ের জন্য পরিচিত হতে, না যে কারণে এখন তাকে মনে রাখা হচ্ছে এক নির্মম ট্র্যাজেডির জন্য। গত ২৩ জুন, সোমবার সন্ধ্যায়, রামাল্লাহর উত্তর–পূর্বের গ্রাম কাফর মালিকের এই কিশোর তার বাইসাইকেলে চড়ে যাচ্ছিল, তখন একজন ইসরায়েলি সেনা তাকে গুলি করে। রক্তাক্ত অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থাকলেও তাকে চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। ক্ষতবিক্ষত আম্মার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে, এবং শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও কিছু সময় তার মরদেহ আটকে রাখে দখলদার বাহিনী। রামাল্লাহভিত্তিক ‘ফাইটিং জোন’ নামক মুয়াই থাই ক্লাবে আম্মার নিয়মিত অনুশীলন করত। তার কোচ আহমাদ আবু দুখান জানান, আম্মার শুধু একজন ছাত্র নয়, ছিল এক প্রাণবন্ত সঙ্গী, এক তরুণ যোদ্ধা, যে আজ তার দলের সবার অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে।
‘আম্মার ছিল এক ব্যতিক্রমী শিশু। সবসময় হাসিখুশি। ওর মুখে কখনো দুঃখ দেখিনি। ওর মধ্যে একটা অদ্ভুত শক্তি ছিল, যেকোনো বিষন্নতা দূর করে দিতে পারত। সাহসী, বিনয়ী, এবং অসম্ভব লক্ষ্যনিষ্ঠ, ‘কণ্ঠে কান্না চেপে বলেন আবু দুখান। আবু দুখান আরও বলেন, ‘প্রতিযোগিতায় ভয় পেত না সে। যেকোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হতো, যত শক্তিশালীই হোক না কেন। ও শুধু চ্যাম্পিয়ন হতে চায়নি, ওর মধ্যে ছিল দেশের প্রতিনিধিত্ব করার গর্ব।’ ঘটনার দিন, দুপুর ২টার দিকে আম্মার কোচকে মেসেজ করেছিল। আবু দুখান তখন ব্যস্ত ছিলেন, পরে উত্তর দেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। ঘণ্টা খানেক পরে মেসেজটি মুছে ফেলে আম্মার যা আজও একটা অপূর্ণতা হয়ে রয়ে গেছে দুখানের জন্য। বিকেল ৪টায় কোচকে ফোন করে আম্মারের খালা বলেন, ‘ওকে গুলি করেছে… আমরা জানি না কতটা খারাপ অবস্থা।’ কোচ তখনো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। পরে একটি অনলাইন সংবাদে আম্মারের ছবি দেখে হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যায়। ‘সে তো একটা বাচ্চা ছিল… কোনো সংঘর্ষও ছিল না। আমি ভেঙে পড়েছিলাম, কিন্তু দলের সামনে নিজেকে ধরে রেখেছিলাম। সবাই তখন কাঁদছিল,’ আবু দুখান বললেন। যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা আম্মারের মরদেহ দেখতে পান, তখনো কোচ অবিশ্বাসে স্তব্ধ হয়ে ছিলেন। সমর্থকরা তাকে চুমু খাচ্ছে, বিদায় জানাচ্ছে এই দৃশ্য দেখে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলেন তিনিও। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক মুহূর্ত আসে যখন আম্মারের মা এসে পৌঁছান। সেই মুহূর্তের কথা স্মরণ করে দুখান বলেন, ‘তিনি (আম্মারের মা) কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘ও তোমার কথাই বলছিল সবসময়। বলছিল, তোমার বিয়েতে যাবে, আবার ট্রেনিংয়ে ফিরবে।’
আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি।’ দুই দিন পরেই ছিল আবু দুখানের বাগদান। প্রথমে তিনি অনুষ্ঠান বাতিল করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু আম্মারের মা তাকে বার্তা দেন ‘আম্মার তার পোশাক ঠিক করে রেখেছিল। যদি তুমি অনুষ্ঠান বাতিল করো, ও কষ্ট পাবে।’ এমনকি আম্মারের ছোট ভাইও এখন মুয়াই থাই শেখার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, ভাইয়ের স্বপ্ন বয়ে নিয়ে চলতে চায় সে। আন্তর্জাতিক মুয়াই থাই ফেডারেশন (আইএফএমএ) আম্মারের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে এক আবেগঘন বার্তায় বলে,‘আম্মার শুধু একজন অ্যাথলেট নয়, ছিল এক স্বপ্নবাজ, যে প্রতিটি লড়াইয়ে নিজের দেশকে বুকে নিয়ে লড়তো।’
তারা ঘোষণা করেছে, আম্মারের স্মরণে এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হবে এবং ফেডারেশনের পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। আবু দুখান বলেন, ‘ও ছিল এক সত্যিকারের নায়ক আর সেটাই তাদের ভয় পাইয়ে দিয়েছিল। ওর কণ্ঠ চুপ করাতে চেয়েছিল ওরা। আমার কোনো বার্তা নেই দুনিয়ার কাছে। কারণ এই দুনিয়া আম্মারকে বাঁচাতে পারত কিন্তু তারা চুপ ছিল।’ শেষে, কোচের একটাই কথা : ‘আমার বীর, বিশ্রাম নাও শান্তিতে। তুমি চেয়েছিলে নায়ক হতে আজ তুমি সত্যিই এক নায়ক। বিশ্ব জানে তোমার নাম। আমরা কখনো তোমাকে ভুলব না।’