বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ডান চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুর্বিষহ দিন পার করছেন চবি শিক্ষার্থী মো. শুভ হোসেন। তিনি চবির বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তার সহপাঠীরা চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা দিচ্ছে কিন্তু তার দিন কাটছে চার দেয়ালের কোণায়। বিভাগের শিক্ষকরা তার পরীক্ষা পরের বছর নিবে বলে আশ্বাস দিলেও শুভর দিন কাটছে অনিশ্চিতভাবে। গুলি মাথার মধ্যে রয়ে যাওয়ায় প্রায়ই ব্যথা হয়। আশপাশে আওয়াজ হলে সহ্য করতে কষ্ট হয়, এজন্য থাকতে হয় নিরিবিলি জায়গায়। ডাক্তার জানিয়েছেন সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হবে এ গুলি। গত ১৬ জুলাই বিকালে চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নেয় শুভ। সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের। ছাত্রদের ওপর ছোঁড়া হয় গুলি। ছাত্ররাও প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সেদিন বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অস্ত্রধারীদের ছোড়া একটি গুলি লাগে মো. শুভ হোসেনের ডান চোখে। চোখের তিনটি স্তর ভেদ করা সেই ছররা গুলি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন শুভ। সেদিনের পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শুভ আজাদীকে বলেন, ১৬ জুলাই বিকাল তিনটার দিকে আমি মোবাইলে ফেসবুকে চালাচ্ছিলাম। এ সময় দেখলাম চট্টগ্রামে রাফিকে আটক করা হয়েছে। তখন আমার বাসার অন্যরা আমাকে বলল চলেন আন্দোলনে যাই। তখন আমার মেয়র গলির বাসা থেকে বের হয়ে দেখি মানুষ জটলা হয়ে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা ২০ জনের মতো ছিলাম। আমার এক বন্ধুকে কল দিলাম তার সাথেও ৩০ জনের মতো লোক ছিল। আমরা ভাবলাম ষোলশহর ছাত্রলীগের দখলে আমরা মুরাদপুর চলে গেলে ভালো হবে। আমরা ভিতরের রাস্তা দিয়ে মুরাদপুর চলে গেলাম। তিনি বলেন, মুরাদপুর গিয়ে দেখি ছাত্রলীগ–যুবলীগ এবং পুলিশের সঙ্গে মুখোমুখি শিক্ষার্থীরা। তখন আমাদের সাথে প্রায় দুই ঘণ্টা ছাত্রলীগ–যুবলীগের সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হলো। এতে অনেকেই চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হতে দেখলাম। আমার আত্মবিশ্বাস ছিল যে আমার গায়ে গুলি লাগবে না। কয়েকজনের গায়ে গুলি লেগেছে আমি তাদের দিকে তাকালাম। এই মূহুর্তে আমার ডান চোখে গুলি এসে লাগে। গুলি লাগার সাথে সাথে আমি চিৎ হয়ে পড়ে যায়। তখন কি করবো আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। তখন আমি এক হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে আশপাশের লোকজনকে আমাকে হাসতাপালে নিয়ে যেতে বললাম। কেউ আমাকে নিচ্ছে না। সবাই দৌঁড়ে বহদ্দারহাটের দিকে যাচ্ছে। এদিকে ছাত্রলীগের ওরা আসছিল দা নিয়ে। পরে ভয়ে কোনোমতে দৌঁড় দিলাম। ওখানে গিয়েও বললাম আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। কেউ নেয়নি। তখন নিজেই হাঁটা শুরু করলাম। ভাবলাম হারানোর আর কিছু নেই। কোনোমতে চট্টগ্রাম মেডিকেল হাসপাতারে গেলাম। শুভ বলেন, সেখানে ডাক্তার আমাকে ঢাকায় চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ওই রাতেই ঢাকা চলে গেলাম।
এখন পর্যন্ত শুভর দুবার অস্ত্রোপচার করাতে হয়েছে। তবু চোখের ভেতর থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়নি। গত ১৭ জুলাই জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে প্রথম অস্ত্রোপচার হয় তার। পরে ৮ অক্টোবর রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয়েছে। বর্তমানে তিনি সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসক লেফটেন্যান্ট কর্নেল বিল্লাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। আগামী মাসে তার চোখে তৃতীয়বারের মতো অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা রয়েছে। তিনি ডান চোখে দেখতে পাবেন কি না, ওই অস্ত্রোপচারের পর নিশ্চিত হওয়া যাবে। তবে ডাক্তারের বরাত দিয়ে শুভ বলেন, ডাক্তার বলেছে এ চোখ আর ভালো হবে না। এখন আমাকে বাকি জীবন এটা নিয়েই কাটাতে হবে।
শুভর বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার সদর উপজেলার তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নে। বাবা মো. আকবর হোসেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসী। তিন ভাইয়ের মধ্যে শুভ সবার ছোট। তিনি জানান, ডান চোখে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে তার। এরপরও শেষ চেষ্টায় রয়েছেন। আগামী মাসে তৃতীয় অস্ত্রোপচারের পর যদি চোখের উন্নতি না হয়, তবে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নেবেন তিনি। তার আক্ষেপ, তাকে সরকার কিংবা স্থানীয় প্রশাসনের কেউ কোনো অর্থসহায়তা দেননি। এমনকি তার সঙ্গে কেউ যোগাযোগ পর্যন্ত করেননি। বর্তমানে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে টাকা না লাগলেও যাতায়াত, থাকা ও খাওয়া বাবদ অনেক টাকা ব্যয় হচ্ছে। অনেকবার চেষ্টা করেও প্রধান উপদেষ্টার সাথে দেখা করতে পারেননি বলেও জানান শুভ। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের সমন্বয়কদের কারো সাথে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ অবস্থায় শুভর ভবিষ্যত নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর থেকে বাংলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। শুভর সহপাঠীরা পরীক্ষা দিতে পারলেও তিনি রয়েছেন অনিশ্চয়তায়। শুভ বলেন, চোখের সমস্যার কারণে তিনি পড়তে পারছেন না। ৫ মিনিট পড়লেই চোখে পানি চলে আসে। এখনো চোখে গুলি থাকায় মাঝেমধ্যে ব্যথা দেখা দেয়। পরীক্ষা শুরুর কথা শুনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তিনি নিজে গিয়ে উপ–উপাচার্যের (প্রশাসন) সঙ্গে ২৫ অক্টোবর যোগাযোগ করেছেন। পরে সমস্যার কথা জানালে তাকে লিখিত আবেদনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্রকে আলোকিত করতে নিজে এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বলে জানান তিনি। তিনি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে নিজের সমস্যার কথা জানাতে চান। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কোনো একটা কর্মসংস্থান যাতে করা হয়। তার স্বপ্ন ভঙ্গ হয়েছে। তবে তিনি জীবনের হাল ছাড়ছেন না। নিজের এক চোখের আলো হারালেও দেশে আলো আসুক এটিই তার চাওয়া।