তরুণ মজুমদার একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যদি ৮০ বছর বাঁচি তবে সেই ৮০ বছর পর্যন্ত সিনেমা করে যেতে চাই।’ তিনি ৯১ বছর বেঁচেছেন এবং সেই ৯১ বছর পর্যন্ত সিনেমা করে যেতে পেরেছেন। সার্থকনামা এই শিল্পী চিরতরুণই ছিলেন। মৃত্যুর অল্পকিছুদিন আগে তিনি অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। কয়েকমাস আগে তিনি তাঁর নতুন ছবির কাজে হাত দিয়েছিলেন। লোকেশনও দেখে রেখেছিলেন। শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে সেই ছবির নাম ছিল ‘জনপদ বধূ।’ চিত্রনাট্যের খসড়াও করেছিলেন। কিন্তু কাজ শুরু করতে পারলেন না। ৪ জুলাই সকাল ১১টা ১৭ মিনিটে যশস্বী এই নির্মাতার চিরতারুণ্যের অবসান ঘটলো তাঁর জন্ম ও কর্মের শহর কলকাতার এক হাসপাতালে।
তরুণ মজুমদারের জন্ম ১৯৩১ সালের ৮ জানুয়ারি কলকাতায় মামার বাড়িতে। তরুণ বাবুদের আদিবাড়ি বাংলাদেশের বগুড়া শহরে। তাঁদের পরিবার ছিল রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। তরুণ বাবুর বাবা বীরেন্দ্রনাথ খাসনবীশ ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী আন্দোলনের একজন সক্রিয়কর্মী। বীরেনবাবু এবং তাঁর ভাইয়েরা বেশিরভাগই কারাগারে বন্দী থাকতেন। মায়ের সাহচর্যেই কৈশোর অবধি বেড়ে উঠেছেন বগুড়ায়। এরপর থেকে কলকাতায়। তাঁদের পারিবারিক উপাধি ছিল মজুমদার। চলচ্চিত্রে আসার পর তরুণবাবু সেটাই লিখতেন। দেশভাগের পর খাসনবীশ বা মজুমদারদের একান্নবর্তী পরিবার বিভক্ত হয়ে কলকাতা ও জলপাইগুড়িতে স্থিত হন। তরুণ বাবুরা কলকাতায় স্থিত হলেও বগুড়াকে ভুলতে পারেননি আজীবন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’ যেটি তাঁর মৃত্যুর বছর খানেক আগে প্রকাশিত হয়েছে সেখানে বগুড়ার কথা বার বার এসেছে। কাজ পাগল এই মানুষটি আত্মজীবনীতে কেবলই তাঁর সারাজীবনের কাজের কথা বলে গেছেন। ব্যক্তিগত জীবনের কথা নেই-ই বলতে গেলে।
কলকাতায় স্কুল ও কলেজজীবন শেষ করেই তরুণ মজুমদার সিনেমার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে কাজ শুরু করেন সিনেমার প্রচার প্রচারণায় তাঁর মামার প্রতিষ্ঠানে। সিনেমার নেশা তাঁকে পেয়ে বসেছিল বগুড়ার কৈশোর জীবনে।
আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ঘটনাচক্রে খুব অল্পবয়সেই এ চত্বরে ঢোকার ছাড়পত্রটা হাতে এসে গিয়েছিল। কলেজের পাঠ চুকিয়ে যখন ভাবছি কী করব, কোন পথ ধরা যায়, এমন সময় বলা নেই কওয়া নেই মনের মধ্যে একটা পুরনো পোকা কুটুস করে কামড় বসাল। সিনেমার পোকা।’ ঢুকে গেলেন মামার সিনেমা পাবলিসিটি অফিসে। সেখানে কর্মসূত্রে অভিনেত্রী প্রযোজক কানন দেবীর সঙ্গে পরিচয়। তাঁর আমন্ত্রণে তাঁর প্রযোজনা সংস্থা শ্রীমতি পিকচার্সে শিক্ষানবীশ সহকারী পরিচালক হিসেবে সেই যে সংযুক্ত হলেন তারপর ক্রমশ এগিয়ে চলা। জীবনের শেষ সুস্থদিন (অসুস্থ ছিলেন মাত্র একমাস) পর্যন্ত। সাত দশকের বেশি সময়ের সে অবিরাম চলাচল। এত পরম সৌভাগ্য খুব কম শিল্পীর জীবনে মেলে। একের পর এক নির্মাণ করে গেছেন শিল্পমণ্ডিত ও জননন্দিত সব চলচ্চিত্র। যার মধ্যে পাঠ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে পড়ানো হয়, ‘বালিকা বধূ’, সংসার সীমান্তে ও গণদেবতা।
পিতৃভূমি বাংলাদেশের প্রতি স্বভাবতই টান ছিল তরুণবাবুর। জসিম উদ্দিনের একমাত্র উপন্যাস বোবাকাহিনীর চিত্ররূপ নির্মাণের জন্যে অনেকদূর এগিয়েও শেষপর্যন্ত ১৯৭৫ এর পটপরিবর্তনের কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। এই কাজের জন্যে তিনি সে সময় বেশ কয়েকবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৯০ এবং ১৯৯৪ সালে তাঁর সঙ্গে আমার দু’বার সাক্ষাতের সৌভাগ্য হয়েছিল কলকাতায়। একজন নম্র শান্ত মানুষের সান্নিধ্যে এসে রীতিমত বিমোহিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের সব খবরই তিনি রাখতেন। বগুড়ার কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে জানতে চাইতেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। বলেছিলেন, মূলধারার চলচ্চিত্রকে শক্তিশালী করে রাখতে না পারলে বিকল্পধারাও বাধাগ্রস্ত হবে এবং পুরো ইন্ডাস্ট্রিই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। তাঁর সেই আশঙ্কা আজ সত্যি হয়েছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছেনা। বাংলাদেশের সিনেমা সে সময় অশ্লীলতায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। তিনি কলকাতায় থেকেও তা লক্ষ্য করতেন এবং তাঁর শঙ্কার কথা বলেছিলেন।
তরুণ মজুমদার যখন পরিচালনায় আসেন তখন বাংলা সিনেমার শ্রেষ্ঠত্রয়ী সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেন বেশ দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। তাঁদের পরে ছিলেন তপন সিন্্হা। আরো বেশ কয়েকজন দাপুটে পরিচালক থাকলেও তরুণ মজুমদার আবির্ভুক্ত হলেন পঞ্চম পান্ডব হয়ে। তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, সহজ সরল নির্মিতি পরিমিতিবোধ এবং সংযমী প্রয়োগ কৌশল তাঁকে এক পৃথক আসনে অধিষ্ঠিত করলো। প্রথম চারটি ছবি চাওয়া পাওয়া (১৯৫৯), স্মৃতিটুকু থাক (১৯৬০), কাঁচের স্বর্গ (১৯৬২) এবং পলাতক (১৯৬৩) পরিচালনা করেছিলেন অন্য দুই সহযোগী শচীন মুখোপাধ্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে যাত্রিক-এর ব্যানারে। তাঁদের চলচ্চিত্র পরিচালনার নেপথ্যে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিলেন উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন। প্রথম ছবিতে দুজনই অভিনয় করেন। তবে পলাতক ছবিটি বলতে গেলে তরুণবাবু একাই করেছিলেন এবং প্রযোজনা করেন ভারত বিখ্যাত পরিচালক প্রযোজক মুম্বাইয়ের ভি. শান্তারাম। এই ছবিটির অসাধারণ সাফল্য তরুণ মজুমদারকে প্রতিষ্ঠা এনে দেওয়ার পাশাপাশি তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়। এরপর থেকে তিনি এককভাবে পরিচালনা শুরু করেন। একে একে নির্মাণ করেন আলোর পিপাসা (১৯৬৫), একটুকু বাসা (৬৫), বালিকা বধূ (৬৭), রাহগীর (পলাতকের হিন্দিরূপ, ৬৯), নিমন্ত্রণ (৭১), কুহেলি (৭১), শ্রীমান পৃথ্বীরাজ (৭৩), ঠগিনী (৭৪), ফুলেশ্বরী (৭৪), সংসার সীমান্তে (৭৫), বালিকা বধূ (হিন্দি, ৭৬), গণদেবতা (৭৮), দাদার কীর্তি (৮০), শহর থেকে দূরে (৮১), মেঘমুক্তি (৮১), খেলার পুতুল (৮২), অরণ্য আমার (৮৪), অমর গীতি (৮৪), ভালোবাসা ভালোবাসা (৮৫), পথভোলা (৮৬), আগমন (৮৮), পরশমণি (৮৮), আপন আমার আপন (৯০), পথ ও প্রাসাদ (৯১), সজনী গো সজনী (৯১), কথা ছিল (৯৪), অকুহা কথা (উড়িয়া ৯৪), আলো (২০০৩), ভালোবাসার অনেক নাম (২০০৫), চাঁদের বাড়ি (২০০৭), এবং ভালোবাসার বাড়ি (২০১৮)। বঙ্কিম চন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে একমাত্র টিভি ধারাবাহিক ‘দুর্গেশনন্দিনী’ নির্মাণ করেন ২০১৪ সালে।
তরুণবাবুর ছবি লক্ষী ও সরস্বতী উভয়েরই বরধন্য। ছবিগুলি সাধারণ ও প্রাগ্রসর উভয় ধরনের দর্শকদের পরিতৃপ্ত করতো। শ্যাম ও কূল দুটোই সমানভাবে রাখতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। প্রযোজকেরা সর্বদাই তাঁর ছবির প্রযোজনায় আগ্রহী থাকতেন। ভারতবিখ্যাত অনেক প্রযোজকের প্রযোজনায় তিনি ছবি পরিচালনা করতে পারেননি ক্রমাগত ব্যস্ততার করণে।
তরুণ মজুমদার ছবি তৈরির সময় কাহিনী অভিনয় এবং সঙ্গীতের উপর বেশি জোর দিতেন। গানের পিকচারাইজেশন করতেন নিজে। কাঁচের স্বর্গ ছাড়া সবকটি ছবিই ছিল সাহিত্য নির্ভর। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল সকল সাহিত্যিকে গল্প উপন্যাস নিয়ে তিনি কাজ করেছেন যাদের মধ্যে রয়েছেন দুই বিভুতিভূষণ, তারাশংকর, শৈলজানন্দ, মনোজ বসু, প্রেমেন্দ্র মিত্র, বিমল কর। সবার উপরে ছিল তাঁর নিজের লেখা অত্যন্ত গতিশীল চিত্রনাট্য। তেমনি সাবলীল ও প্রাণবন্ত অভিনয় ছিল তাঁর ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
কম বাজেটে সিনেমা তৈরি করলেও লোকেশন, চিত্রগ্রহণ এবং সম্পাদনার ক্ষেত্রে তিনি সমঝোতা করতেন না। আউটডোর স্যুটিং পছন্দ করতেন বেশি। লোকেশন এবং সেট তৈরিতে বংশী চন্দ্রগুপ্ত ও রবি চট্ট্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্প নির্দেশক, চিত্রগ্রহণে সৌমেন্দু রায়ের মতো সিনেমাটোগ্রাফার এবং সম্পাদনায় দুলাল দত্তের মতো সম্পাদক তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন যাঁরা কাজ করতেন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। সংগীতি পরিচালক হিসেবে শুরু থেকে পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে হেমন্তর জীবদ্দশা পর্যন্ত। বাংলা চলচ্চিত্র জগতের সেরা সব অভিনয় শিল্পীকে পেয়েছেন তাঁর ছবির অভিনয়ে। আবিষ্কার করেছেন অনেক অভিনয় শিল্পী যাদের মধ্যে মৌসুমী, মহুয়া, দেবশ্রী, অয়ন, তাপস পাল অন্যতম। সন্ধ্যা রায় ও অনুপ কুমারের প্রকৃত আবিষ্কর্তাও তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে সন্ধ্যা রায় তাঁর স্ত্রী, যদিও রাজনৈতিক এবং পারিবারিক মতান্তরে জীবনের শেষ তিনটি দশক তাঁরা পৃথক জীবন যাপন করে গেছেন। এই দম্পতি ছিলেন নিঃসন্তান।
তরুণ মজুমদারের জীবনের শেষ কাজ দুই খণ্ডে রচিত তাঁর বিশাল আত্মজীবনী ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’। অসাধারণ এই যুগল গ্রন্থে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কথা তেমন বলেননি। বলেছেন তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের কথা যাতে ধরা আছে বাংলা চলচ্চিত্র জগতেরও সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। ছত্রে ছত্রে বর্ণিত আছে এক কর্মচঞ্চল তরুণের কথা।