এক অবিশ্বাস্য সুন্দর বাংলাদেশের প্রত্যাশায়

সৈয়দ জিয়াউদ্দীন

| শুক্রবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২৪ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

গ্রামটির নাম কাক্কানাড। ভারতের অন্যতম দরিদ্র অঙ্গরাজ্য কেরালার একটি জনবহুল গ্রাম। সমপ্রতি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলাম। কচিন শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরে গ্রামটির অবস্থান। তবে একসময়ের বৈদ্য আয়ুর্ব্বেদিক ও নারিকেল সুপারি অধ্যুষিত এই গ্রামটির আধুনিক অবস্থা দেখে মোটেও মনে হয়নি যে এটা উন্নত শহরের চেয়ে কোনো অংশে কম। দারিদ্রপীড়িত বিপুল সংখ্যক ভারতীয় লোক কর্মসংস্থান ও ভাগোন্নয়নের লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী প্রবাস জীবন যাপনে অভ্যস্থ এবং তার মধ্যে কেরালার অবস্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেরালার প্রায় প্রতিটি পরিবারের লোক মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে কর্মরত এবং সেখানকার উপার্জিত সামার্থ্যই নিঃসন্দেহে তাদের বর্তমান সামাজিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। কেরালা অনেকটা আমাদের দেশের সাইজের ভারতের ছোট্ট রাজ্য হলেও সেখানে চার চারটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর প্রতিদিন প্রায় তাদেরই যাত্রি পারাপারে জমজমাট থাকে। সম্পূর্ণ সোলার বিদ্যুতে পরিচালিত কচিন এয়ারপোর্ট সেগুলোর অন্যতম ব্যস্ত বিমান বন্দর এবং সেখান থেকে মেট্রোরেল ও রাস্তায় সংযুক্ত শহরতলি ও গ্রামগঞ্জের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো। কেরালার পর্যটনও আধুনিক এবং অনেকগুলো উন্নতমানের হাসপাতাল ও বৈদ্যশালা বা আয়র্ু্বেদিক চিকিৎসালয়ের কারণে সেখানে ভিনদেশীদের পদচারনাও উল্লেখযোগ্য। কাক্কানাড গ্রামের এক প্রান্তে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রোগীর সমাগমে ব্যস্ততম রাজাগিরী নামের একটি আধুনিক হাসপাতাল ও অন্যপ্রান্তে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সম্ভবত একই পরিবারভুক্ত রাজাগিরী বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি উন্নতমানের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিতে শিশুদের কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের র্স্বোচ্চ শিক্ষার সুব্যবস্থা বিদ্যমান। বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা আবাসিক হোস্টেলগুলোও সুরম্য ও সুন্দর। মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে আমার সেখানে যাওয়া। এলাকার প্রায় প্রতিটি অলিগলিতেই রেস্টুরেন্ট, শপিংমল, মানিএক্সেইঞ্জের অফিস দর্শনীয় ও সহজলভ্য। প্রধান সড়কের পাশেই বহুতল বিশিষ্ট আমাদের আবাসিক হোটেল। গাড়ি পার্কিং, রেস্টুরেন্ট, সুইমিংপুল নিয়ে হোটেলটি সুসজ্জিত ও আধুনিক। চব্বিশঘণ্টা অনকল উবার ও ট্যাক্সির নিরাপদ ব্যবস্থা চোখে পড়ার মত। আজকাল দেশের বাইরে কোথাও ভালো কিছু দেখলেই নিজের দেশের সাথে তুলনা করা বা মিলিয়ে দেখার এক ধরনের কুঅভ্যাস হয়ে গেছে তাই কিছুটা অবিশ্বাস্য ও অসহনীয় লাগছিল কাক্কানাডকে। কেন নারিকেল অধ্যুষিত গ্রামটিতে বিশ পঁচিশতলা বিল্ডিং গিজগিজ করবে। হোটেল ভর্তি এত বিদেশীই বা কেন? বিস্ময় কাটাতে এক সময় হোটেলের ম্যানেজার জোসেফের কাছে কারণটি জানতে চাইলাম। জানতে চাইলাম কেন হোটেলের সামনে বা রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে না। কেন রাস্তায় গাড়ি থামায়না বা যাত্রি উঠা নামা করে না। রাস্তার পাশে নির্দিষ্ট একটি জায়গায় সাধারণ একটি সেডের নিচে পার্ক করা এতগুলো মোটর সাইকেলইবা পাহারা দেয় কে ইত্যাদি ইত্যাদি। জোসেফ খুব গর্বের সাথে বললো এটাই কাক্কানাডের নিয়ম আর এমন সুশৃঙ্খল নিয়মের প্রধান কারণ সেখানে একটি ইকোনোমিক জোন ও একটি হাইটেক পার্ক রয়েছে। বহুতল উঁচু ইমারতগুলো সেখানকার দেশি বিদেশি স্টাফদের হাউজিং এবং বিদেশিদের সুবিধার্থে এইসব হোটেল, মানি এক্সচেঞ্জ অফিস ইত্যাদির সুব্যবস্থা। মাত্র দুই লেনের রাস্তা বলে পার্কিং বা যত্রতত্র গাড়ি থামানো নিষিদ্ধ। অফিস টাইমে স্টাফদের অগ্রাধিকারের কারণে স্থানীয় সাধারণ মানুষও এই নিয়মে অভ্যস্থ। নিয়ম ভঙ্গের সাজার বিধান প্রশ্নাতীত। আইনের প্রতি বিশ্বস্ত ও শ্রদ্ধাশীল জোসেফের আস্থা ও গর্ববোধের তৃপ্তি দেখে খুব ভালো লাগলো এবং চোখের সামনে দেখে মোটেও বুঝতে কষ্ট হলো না যে সরকার ও জনগণের সদিচ্ছা ও সহযোগিতায় একটি ইকোনোমিক জোন ও একটি হাইটেক পার্ক আমাদের চেয়েও ঢের অনুন্নত একটি গ্রামকে কত সহজে আমূল পরিবর্তন করে সুশৃঙ্খল আধুনিক নগরীতে পরিণত করতে পারে।

শনিবার সন্ধ্যায় কাক্কানাডকে বিদায় জানিয়ে দেশে ফিরবো। তাই সকাল বেলা হোটেলের কাছাকাছি অবস্থিত ইকোনোমিক জোনটি দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। প্রধান সড়ক থেকে প্রায় পঞ্চাশ মিটার দূরত্বে অনাড়ম্বর রঙ্গিন গেইটটির সামনে নোম্যানস ল্যান্ডের এক পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের অবস্থা দেখার চেষ্টা করলাম। মনে হলো কড়া নিরাপত্তাধীন এলাকা ও ভেতরের অবস্থা অনেকটা আমাদের ইপিজেডের মতোই। রাস্তার মোড় পেরিয়ে কিছুটা দূরে হাইটেক পার্কটিরও একই ব্যবস্থা। বাইরে থেকে যতটুকু সম্ভব দেখে হোটেলে ফেরার পথে নিজেদের কথা ভাবছিলাম। দেশের কথা ভাবছিলাম। ভাবছিলাম আমাদের দেশেও সরকারিভাবে একশটি ইকোনোমিক জোন ও বারটি হাইটেক পার্ক নির্মাণের কথা শুনেছিলাম এবং অনেক জায়গায় তার কাজও হয়তো চলমান। সারাদেশে এই প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠলে বাংলাদেশের চেহারাও হয়তো নিঃসন্দেহে পাল্টে যাবে। যোগাযোগ ও আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে সংযোজিত সেতু, টানেল, গভীর সমুদ্র বন্দর বা বিমান বন্দরের মত প্রকল্পগুলোর ব্যবহারে আমূল পাল্টে যাবে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা। শুনেছি বরিশাল হয়ে ঢাকার মালবাহী ট্রেন পায়রা বন্দরে যাবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথেও হয়তো চোখে পড়বে উৎপাদনমুখর এশিয়ার সর্ববৃহৎ মিরেরসরায় ইকোনোমিক জোন। মহিপালের ফ্লাইওভার থেকে দেখা যাবে ফেনীর অত্যাধুনিক হাইটেক পার্ক। হয়তো দেখা যাবে চট্টগ্রামের পাশঘেষে নতুন সম্ভাবনার ঢালি নিয়ে গজিয়ে উঠেছে নতুন দ্বীপ নতুন শহর নতুন বাংলাদেশ চট্টগ্রামের ঈড়ঁংরহ ষধহফ আমার স্বপ্নের সমুদ্রগ্রামটিও।

ছোট বেলায় বাংলার পরিচিতিতে ইতিহাসবিদের লেখায় বাংলার ঐতিহ্যের কথা পড়েছিলাম এমনকি পরিব্রাজক ইবনে বতুতার স্মৃতিগ্রন্থেও বাংলার ঐশ্বর্যের উল্লেখ আছে। এখনো ভারত উপমহাদেশে সম্ভ্রান্ত সুন্দর ঘরটিকে বাংলা বলেই সম্বোধন করে। বাংলার হৃত গর্বের কথা মনে করে ভাবতাম একদা এমন দিনও ছিল আমাদের। মসলিনের এই বাংলায় জারী সারি ভাটিয়ালীর সুরে মুখরিত থাকতো গ্রামবাংলার রাত। নবান্নের ঘ্রাণ ভেসে বেড়াত গ্রাম থেকে গ্রামে। এই সবের কিছু কিছুর সাক্ষী আমরাও। বাড়ির পেছনে কাকন, বিন্নি, আউশ ধানের ক্ষেত, অনাবাদি জমি, কচুরিপানায় ঢাকা ডাহুক ডাহুকির প্রেমগাথা জলাশয়। আজ তার অনেক কিছুই প্রায় বিলুপ্ত। কালের প্রয়োজনে সেই অনাবাদী, পরিত্যাক্ত বলতে তেমন কিছু থাকার কথাও নয় তারপরও ভাবনা বলে কথা। ভাবনা আর জাবর কাটায় বাঙালিদের নাকি জুড়ি নেই। ভাবতাম আবারো কি সেই হারানো দিনগুলো ফিরে আসবে? বাংলার আধুনিক জামদানী কি মসলীনের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবে? ইতিহাসের পরিক্রমায় আজ দেখছি সেই দূর্বাঘাসের গেঁয়োপথ, কাঁচামাটি বা ভেন্না পাতার কুড়েঘর কিংবা রূপকথার নদী পারাপারে সাম্পানের নয় যান্ত্রিকতায় আধুনিকতায় বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছে আবারো সে হারানো দিন। মসলীনের বাংলা আজ গার্মেন্টসে বিশ্বের সেরা দেশের অবস্থানে। দেশ আজ খাদ্যোৎপাদনে অগ্রণী অবস্থানে। একদার মঙ্গা পীড়িত অঞ্চলে এখন চার ফসলি চাষাবাদে সচ্ছল মানুষ। নবান্নোৎসব ফিরে এসেছে কৃষকের ঘরে। মাছ তরকারী উৎপাদনেও দেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। আধুনিক পদ্ধতির মাছ চাষে পরিপূর্ণ একদার পতিত ও পরিত্যাক্ত পুকুর দিঘি জলাশয়। খামারীদের পালিত পশুতেই মিটছে লক্ষ লক্ষ কোরবানির পশুর চাহিদা। আক্ষরিক অর্থেই আবারো ফিরে এসেছে ভাতে মাছে বাঙালি জীবনের স্বাদ। আজকাল বিদেশিদের মুখেও দেশের চলমান উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে অনেক প্রশংসা শোনা যায়। জাতিসংঘের উন্নয়নের সূচকে প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। জিডিপির গ্রোথ সহ মাথাপিছু আয়ের অংকটি প্রতিবেশী দেশের উপরে। আর্থিক অগ্রযাত্রার রূপরেখায় দরিদ্রতম দেশের কাতার থেকে মধ্যম আয়ের দেশ ও উন্নত অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাই প্রত্যাশার দিনটি হয়তো খুব দূরে নয় আমরাও শুনতে পাবো বিমোহিত পর্যটক পরম তুষ্টিতে বলছে ‘এই এক অবিশ্বাস্য সুন্দর বাংলাদেশ’।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন সময়ের দাবি
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা