চূড়ার ঠিক ২০০ মিটার দূরেই চোখ মেলে পড়ে আছে একটি মৃতদেহ। উপরের দিকে ওঠার সময় দেখা মিলেছে প্রাণহীন এমন আরও অনেক পর্বতারোহীর। কারো ভাঙা পা, কারো হয়তো মাথা নেই। ‘হিংস্র পর্বত’ নামে পরিচিত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এবং বিপদসংকুল পর্বতশৃঙ্গ ‘কে-টু’ জয়ের পর দেশে ফিরে ওয়াসফিয়া নাজরীন জানালেন, সেখানে মানসিক শক্তিটাই বেশি জরুরি। গতকাল বুধবার নেপালের কাঠমান্ডু থেকে দেশে পৌঁছানোর পর রাজধানীর শেরাটন হোটেলে একটি সংবাদ সম্মেলনে দুই মাস ধরে কারাকোরাম পবর্তমালার সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অভিযানের বিষয়ে কথা বলেন এই পর্বতারোহী। খবর বিডিনিউজের। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গত ২২ জুলাই ৮ হাজার ৬১১ মিটার উঁচু বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ পাকিস্তানের ‘কে টু’ জয় করেন ওয়াসফিয়া। রোমাঞ্চকর সে যাত্রার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যখন ৪০ এ পা দেয়, তখন আমি সেভেন সামিট জয় করার যাত্রা শুরু করি। দেশের ৫০ বছরে আমি চেয়েছিলাম কে-টু জয় করতে। এজন্য আমি ১০ বছর ধরে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে কে-টু যাত্রার জন্য তৈরি করেছি। যারা কে-টু’তে গেছেন, তাদের থেকে ট্রেনিং নিয়েছি। আমার পরিকল্পনা ছিল, গতবছর করার, কিন্তু কোভিডের জন্য পারিনি।
প্রায় পিরামিডের মত ঢাল এবং অনিশ্চিত আবহাওয়ার কারণে পর্বতারোহীদের কাছে এটি এভারেস্টের (৮৮৪৮ মিটার) চেয়েও দুর্গম উল্লেখ করে তিনি বলেন, কে-টু আমার আরোহণ করা সবচেয়ে দুর্গম পর্বত। এভারেস্টে আরোহন করার জন্য নেপালে যেমন টি হাউজ আছে, লজ আছে; কিন্তু কে-টুতে নাই, ওখানে কেউ মরলে কাকপক্ষীও আসে না। প্রতি পদক্ষেপে সেখানে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। একবারের চেষ্টায় ‘কে-টু’ জয় করে ফিরে আসা অল্প কিছু পর্বতারোহীর মধ্যে রয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, কে-টু’র মতো পর্বতারোহনের জন্য শারীরিক শক্তির চেয়েও মানসিক শক্তি রাখা গুরুত্বপূর্ণ।
১৯৫৪ সালের পর দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ কে-টু’তে মাত্র ৪০ জন নারী পর্বতারোহী আরোহণ করেন। আর, এখন পর্যন্ত এর চূড়ায় সর্বমোট পা রাখতে পেরেছেন মাত্র ৪শ পর্বতারোহী, যাদের অনেকেই আর নিচে নামার সুযোগ পাননি। ওয়াসফিয়া বলেন, কে-টু সামিটের জন্য মেন্টাল, ফিজিক্যাল, অ্যাল্টিচ্যুড ট্রেনিং লাগে। তবে মেন্টাল স্কিলটা বেশি জরুরি কারণ অনেক অ্যাথলেট আছে যারা হাই-অ্যাল্টিচ্যুডে গেলে তাৎক্ষণিক ডিসিশন নিতে পারে না। আর কে-টু তে অনেক ভাঙা ডেডবডি আছে। দেখা যাবে, একটা বডির চোখ খোলা, সামিটের ঠিক ২০০ মিটার দূরে। কোনোটার ভাঙা পা। মাথাহীন শরীর। ইট’স ভেরি ইজি টু লুজ ইওর মেন্টাল স্ট্রেংথ…।
কে-টু জয়ের রোমাঞ্চ আর দুঃসহ সব স্মৃতির কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, সামিটের পর আমি ঘুমাতে পারতাম না। ডাক্তার আমায় অনেকগুলি ওষুধ দিয়েছে, কারণ এই ডেডবডিগুলি এখনো আমার চোখে ভাসে। কারণ যাদের ব্যাপারে এত পড়েছি, জেনেছি, তারা এখন ওখানে ওভাবে পড়ে আছে, চাইলেও তাদেরকে নিয়ে আসা সম্ভব না… এখানে গেলে প্রতিমুহূর্তে মনে হবে, নেক্সট বডিটা বোধহয় আমি হতে যাচ্ছি…।
পৃথিবীতে ১৪টি ডেথ জোন পাহাড় থাকার কথা জানিয়ে বাংলাদেশের দ্বিতীয় নারী হিসেবে এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া বলেন, কথিত আছে, ডেথ জোনে যত ট্র্যাভেল করবা, তুমি তত বোকা হয়ে যাবা। অনেক পর্বতারোহীকে চিনি, যারা বছরের পর বছর চেষ্টা করে ফিরে এসেছে কিন্তু সামিট করতে পারেনি।
৩৯ বছর বয়সী ওয়াসফিয়া গত ১৭ জুলাই রাতে পর্বতারোহী মিংমা তেনজি শেরপা, মিংমা ডেভিড শেরপা ও নির্মল পুরজার নেতৃত্বে ১২ জনের দলের সঙ্গে ‘কে-টু’ চূড়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন। এই দলে ৬ জনই ছিলেন নারী। প্রথমত এত নারী একসাথে কোনোদিন সামিট করেনি। প্রায় ১৮-২০ জন নারী সামিট করেছি। বাংলাদেশ থেকে প্রথম কোনো নারী করল, হোপফুলি এরপর কোনো পুরুষ করবে।
ওয়াসফিয়াই প্রথম বাংলাদেশি যিনি পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পর্বতারোহণ এবং ট্রেকিং করার অনুমতি পেয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, এ ব্যাপারে পাকিস্তানের অনেক কিংবদন্তি পর্বতারোহী কাজ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কে-টু’র বরফ কমে গেছে বলে জানান ওয়াসফিয়া। এছাড়া, পর্বতে অনেক ময়লা পড়ে থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের প্রতি নির্দেশনা ছিল, ওখানে যা নিবা, তা নিয়ে চলে আসবা।
পর্বতারোহীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, এই ধরনের পর্বতারোহণ ছেলেখেলা না। ইউ রিয়েলি হ্যাভ টু লাভ ইট। আপনি হয়ত ট্রেকিং পছন্দ করতে পারেন, কিন্তু এই ধরনের মাউন্টেনিয়ারিং আসলেই টাফ। ডেথ জোনের পর্বত একটা নেশা। আমার পরিচিত অনেক নারী আছে যারা বান্দরবান গিয়ে সেলফি তুলতে চান, কিন্তু হার্ড ওয়ার্ক করতে চান না। কিন্তু যদি কোনো নারী আসলেই করতে চান, প্লিজ কাম ফরোয়ার্ড। ওয়াসফিয়া বলেন, আমাদের দেশে বড় কোনো পাহাড় নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে রাজনীতি কেন্দ্রিক মাউন্টেনিয়ারিং করতে চাই না। আমি মনে করি, পাহাড় আলাদা করে রাখা উচিত…।