ঋত্বিক ঘটক-কে জেনেছি সেই শৈশবে

খন রঞ্জন রায় | শনিবার , ২২ নভেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

তিতাস একটি নদীর নাম। গোকর্ণ গ্রাম, অদ্বৈত মল্লবর্মণ আর ঋত্বিক ঘটক একাকার হয়ে আছে। এক জায়গায়, একত্রে, নজরকাড়া ঐতিহাসিক বৈচিত্র্যে। আর আমার শৈশবে স্মৃতিতে। হুমায়ুন আহমেদএর গভীর ভালোবাসার সেই পঙক্তিটি মনে পড়লোদিঘির জলে কার ছায়া গো / তোমার নাকি আমার? তোমার কি আর মন চায় না /এই কথাটা জানার…….

ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে যৎকিঞ্চিত লিখতে গিয়ে আমার শৈশবের সেই কথাটা দীপশিখার মত ধপ করে প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠলো। ‘এত সুর আর এত গান/ যদি কোনদিন থেমে যায়/ সেইদিন তুমিও তো ওগো/ জানি ভুলে যাবে যে আমায়……..।’

গোকর্ণ গ্রাম আমার মাসীর বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়ের কথা। আমার কপালে থ্যাবড়ানো কাজল মেখে কোলে কোলে করে ঘুরিয়েছিল সেই গ্রামে। তিতাস নদীর কূল ঘেঁষেই আমার মাসীর বাড়ি। আমাদেরও এর কাছাকাছি। তিতাসের উৎপত্তিস্থল মেঘনাতিতাস মোহনার বাম পাশে।

নবীনগরগোকর্ণ একমাত্র বাহন লঞ্চ। দুতলা, তিন তলা লঞ্চ। উত্তাল মেঘনার মোহনা পাড়ি দেওয়ার মতো যাত্রীবাহী নৌকার সাহস হতো না। তখন তো নৌকায় ইঞ্চিন লাগেনি। গুণটানা, পালতোলা, লগিবৈঠার প্রচলন। পরিবেশবান্ধব।

তিতাস একটি নদীর নাম।

মায়াময় সেই তিতাসের ঢেউ, আর উত্তাল মেঘনার মোহনা লঞ্চে করে পার হতে সময় লাগত দেড় ঘণ্টা। লঞ্চের ‘ভেঁপু’ আর ‘বিলাসের ভাড়া দেড়গুণ’ এইসব শব্দ আর নীতিবাক্যের লেখা পড়তে পড়তেই আদরে আদরে ভাসিয়ে লঞ্চ পৌঁছে যেতো নির্দিষ্ট গন্তব্যে। গোকর্ণঘাটে। প্রকৃতির প্রতি রহস্যময়ী যে ভাবনায় তাড়িত হই, হয়তো তিতাসই আমাকে সেই ভাবনায় কুপোকাত করেছে। প্রীতি ও প্রেমের পুণ্যবাঁধনে মিলে যাবে পরস্পরে / স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়ে ঘরে।

বাস্তবিক। নদী পাড়ের মানুষের জীবনযাত্রা, শান্ত জলের উপর সোনালী সূর্যের আলো, সবুজে ঘেরা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য, সকালদুপুরবিকেলসন্ধ্যায় আলাদা আলাদা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনমুকুরে চিরপ্রশান্তি এঁকে দেয়। লঞ্চ যখন ধীরলয়ে চলে কত রকমের যে জলচর পাখি এর পিছনে পিছনে উড়ে বেড়ায়! তার ঠিকঠিকানা নাই।

হররোজ এইসব স্বপ্নময় দৃশ্য দেখতে দেখতে কিছু পাখ পাখালির নাম জানা হয়ে গিয়েছিল। সাদাবক, গাংচিল, পানকৌড়ি, শঙ্খচিল, বালিহাঁস, মাছরাঙার নাম মনে আছে। বাকীসব স্মৃতির অতল গহ্‌বরে হারিয়ে গেছে। শহরের রুক্ষ, রুষ্ট ধোঁয়াধূসর পরিবেশে জলাধার আর সবুজ মাঠ উধাও হয়ে দেখা দিয়েছে উন্নয়নের ঠাটবাট।

লঞ্চ গোকর্ণঘাটের কাছাকাছি এলে শতশত ডলফিন, সীল, শুশুক, আনন্দবেদনা না কষ্টে! লাফালাফি করে লঞ্চভর্তি যাত্রীদের আনন্দের খোরাক যোগাত। নিজেরা নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পীড়াদায়ক অনুভূতির প্রকাশ না বেঁচে থাকার আর্তি জানাতো তা বড়ই রহস্যময়। এখনতো সেই ধন্দ আর নেই। নেই কানাঘুষা, ভাবনা পরিষ্কার; তারা নিঃশেষ।

পঁচাত্তর পূর্ববর্তী ঠিক সময়ে যখন কিছুটা বুঝতে শিখেছি লঞ্চ গোকর্ণঘাটের নিশানা পেলেই নড়েচড়ে বসতাম। খা খা সূর্যেও ছাঁদে ওঠে যেতাম। মাথার ওপর কড়া রোদ তেতে উঠত। দুই পাশে বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি থাকলেও বারবার দৃষ্টি চলে যেতো সেই লাফালাফির দৃশ্যে।

আহা রে, কী রূপ; অপরূপ।

কখনো কখনো ভয়ার্ত ভাব চলে আসতো। গায়ে ঝিম ধরত। কিন্তু প্রবল ও ঔৎসক্যের কাছে তার পরাজয় ঘটত। জন্ম ও জীবনের সার্থকতা এখানেই।

ঘাটে নেমে একটু বাম পাশের মূল গলিতে উঠলেই আমার মেসোর গদিঅফিস। আমার আত্মার আত্মীয় আমার মঙ্গলাকাক্সক্ষী মনীন্দ্রবাবু। বহুমাত্রিক বিদ্যার অধিকারী। এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। মূলত ট্রান্সপোর্ট ব্যবসা। মালামাল পরিবহন। জলপথের সেই সময়ের আকাশছোঁয়া জনপ্রিয় এই জলপথের পরিবহন ব্যবসা। ট্রাকট্রেনের নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনার কাছে নৌকায় মালামাল আনা নেওয়া অপরিহার্য। গোকর্ণঘাট তখন নদীবন্দর। প্রয়োজনীয় ট্রানজিট এলাকা।

তখনকার সময়কে জয় করে এগিয়ে চলা মনীন্দ্র মেসোকে প্রণাম জানিয়ে বাড়িতে ঢুকতাম। একটু ফ্যাসফ্যাসে গলায় কী সিগ্ধ! সুন্দর ভঙ্গিতে কাছে টেনে নিতেন। আরও ছোট থাকতে কোলে তুলে নিতেন। কখনো কিছু বোঁচকাপ্যাটরা থাকত হাতে ও কাঁধে। মা তার বোনের জন্য প্রিয়সব খাবার রান্না করে; কখনো বা গাছে নতুন ধরা পেঁপে, শসা, নারকেল, কলা, কালোজিরা চাল, বিন্নি ধান অল্প করে আমার কাঁধে তুলে দিতেন। কেনাবেচার জগতে তাবৎ সামগ্রীর রমরমা ব্যবসা তখনও শুরু হয় নাই।

সনতারিখ মনে নাই। ৭৪৭৫ হবে। তবে মাঘ মাসের কচি রাত। সবাই ঘুমের প্রস্তুতিতে। আমিও বিছানায় লেপের ভিতরে। আলগাঘরে। বাড়ির বছরকি কাজ করা মামাকে ডাকলেন। মেসো এবং বাঁহাতি মামা আমাদের ঘুমঘরের দরজা ধাক্কা দিয়ে ঢুকলেন। মেসোর স্বভাবসুলভ বিনয়ী ভঙ্গিতে মামাকে বললেন

তুমি কাল সকালে ওদেরকে অদ্বৈত মল্লবর্মণের বাড়ি ঘুরিয়ে আনবা’।

আমি আর আমার সমবয়সী মশাতো ভাই ছিলাম এক লেপের ভিতরে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে একটু সায় দিলাম। ৯১০ বছর বয়স আমার। এই নাম শুনেছি বলে মনে পড়ে না। আগামাথা কিছু না বুঝে, মাথার ওপর লেপ টেনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

দুপায়া কাঁচা মেটোপথ মাড়িয়ে কয়েকটি বাড়ি পার হলেই আরেকটি পাড়া। বাড়িঘর জরাজীর্ণ একেবারে। তখনকার দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপটের চেয়েও ঢের বেশি। একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম আমরা। প্রায় অর্ধবসনা এক কাপড়পরা মহিলারা মাছধরার জাল টানা হেঁচড়া করছে। সম্ভবত রৌদ্রে মেলে দেওয়ার জন্য।

আমাদের দেখে তরজার লড়খড়ে বেড়ার ছনের ছাউনির ঘর থেকে কয়েক কিশোরকিশোরী পাশ থেকে আরো কিছু বালকবালিকা দৌঁড়ে বেড়িয়ে এলো। বেশির ভাগই বস্ত্রহীন। একেবারে উলঙ্গ। কী ছেলে কী মেয়ে। সে এক অদ্ভুত আশ্চর্য দৃশ্য।

মামা জানালেনএই বাড়িতেই জন্মেছিলেন সাংবাদিক, লেখক, উপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ। যে সিনেমাটি সারাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তায় হাউসফুল হয়ে চলছে সেটি উনার বই থেকে বানানো হয়েছে। সিনেমাটি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’।

আমি নির্বাক দর্শক। কীসের কী, কিছুই বুঝিনি। মনে হলো আমার সাথে থাকা ভাইটিও।

পড়ন্ত বিকালে আমি একা হাঁটতে হাঁটতে মেসোর গদির দিকে এগুলাম। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্য তিতাস নদীর ঢেউগুলোতে প্রতিফলিত হচ্ছিল। রক্তবর্ণের আভায় ঝলমল করছিল সেই ঢেউ। মনীন্দ্র ট্রান্সপোর্টের সাইবোর্ডে চোখ পড়তেই দেখি সামনের রুমটি গরগগল ধূপের ধোঁয়ায় অন্ধকারচ্ছন্ন। ভেতর থেকে ভেসে আসছে ওঁ নমো: শিবায়:…….. ওঁ নমো: শিবায়: । ধবধবে ধুতির সাথে ঘিয়ে রঙের ফতোয়া পরা গায়ে পশমি চাদর মাথায় উলের গরম টুপি, দীর্ঘদেহি গৌরবর্ণের মেসো আরো কতরকম মন্ত্র উচ্চারণের সাথে ব্রহ্মাচারীর মতো ঘুরতে লাগলেন। আমাকে আলাজিলায় দেখে এক কর্মচারীকে ইশারা দিলেন। আমাকে ভিতরে নিয়ে বসানো হলো।

একটু পড়ে মেসো আরো দুই কর্মচারীসহ এখানে ঢুকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে কর্মচারীদের কিছুটা আদেশের সুরে বললেন

তিতাস একটি নদীর নামসিনেমাটি কোন হলে চলে খোঁজ নাও। ওকে দেখাতে হবে’।

আচ্ছা! বলে কর্মচারীরা বেরিয়ে গেলো।

মেসো বিড়বিড় করে ‘বাবা ভোলানাথ অবশ্যই প্রকট হবেন’ এই ধরনের কিছু একটা বলছিলেন।

আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্নের আকারে জিজ্ঞাসা করলেন? ঋত্বিক ঘটকের নাম শুনেছো?

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম।

উত্তরের সুযোগ না দিয়ে বললেন, তিনি বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। বাংলাদেশেরই মানুষ, থাকেন কোলকাতায়। আমাদের প্রিয় নদী তিতাস আর এলাকার মানুষের দুঃখদুর্দশার কাহিনি নিয়ে লেখা উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। লিখেছেন আজ সকালে যার বাড়িতে গিয়েছিলে; তিনি। অবশ্য মাবাবাহারা অদ্বৈতও অল্প বয়সে মারা গেছেন।

এই উপন্যাসটিকে সিনেমা বানাতে ঋত্বিক বাবু বাংলাদেশে এসেছিলেন; ছিলেন কিছুদিন। আমাদের সামনে যে নৌকাঘাট এরপর জেলেপল্লী ও জেলেদের ঘাট এইসব স্থানে অনেক দিন ধরে শুটিং হয়েছিল। সিনেমাটি মুক্তিও পেয়েছে গেলো বছর। দেখবো দেখবো করে দেখা হয় নাই। ভাবছি তোমাকেসহ আমরা সবাই মিলে হলে গিয়ে দেখবো।

আমার শিশুদেহ মনে আলাদা করে শিহরণ জাগল। অবাক হলাম। জীবনে অনন্যঅন্যরকম অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত হয়ে থাকলো।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সংগঠক, সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকদিন সূর্যের আলো হবো
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে